৯০তম অধ্যায়
কর্ণার্জ্জুনযুদ্ধে উভয়পক্ষের বহু বীর বধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মহাবলপরাক্রান্ত পুরুষশ্রেষ্ঠ সূতপুত্র ও অর্জ্জুন পরস্পরের প্রতি শরবর্ষণ করিয়া হিমালয়সম্ভূত উদ্ভিন্নদন্ত[উদ্গত দন্ত-যৌবনপ্রাপ্ত] মত্তমাতঙ্গদ্বয় যেমন করিণীর নিমিত্ত পরস্পর যুদ্ধে মিলিত হয়, তদ্রূপ সেই শঙ্খ ও ভেরীশব্দ সমাকুল সংগ্রামস্থলে মিলিত হইলেন। তৎকালে বোধ হইতে লাগিল যেন, সহসা মহামেঘে মহামেঘে ও পর্ব্বতে পর্ব্বতে সম্মিলিত হইতেছে; যেন নির্ঝর, বৃক্ষ লতা ও ওষধিযুক্ত উন্নতশৃঙ্গ অচলদ্বয় চলিত হইতেছে। তখন সেই মহাবলপরাক্রম বীরদ্বয় পরস্পরের প্রতি অস্ত্রাঘাত করিতে লাগিলেন। সুররাজ ইন্দ্র ও দানবরাজ বলির ন্যায় তাহাদের মহাযুদ্ধ উপস্থিত হইল। উভয়ের শরে উভয়েরই অশ্ব ও সারথির অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হওয়াতে অনবরত শোণিতধারা নিপতিত হইতে লাগিল। হে মহারাজ! তৎকালে সেই বীরদ্বয় ধ্বজসমাযুক্ত রথদ্বয়ে একত্র সমাগত হওয়াতে বোধ হইল যেন, পদ্ম, উৎপল, মৎস্য, কচ্ছপ ও পক্ষিগণে সমাবৃত, বায়ুসঞ্চালিত হ্রদদ্বয় পরস্পর নিকটবর্তী রহিয়াছে। অনন্তর সেই মহেন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী, মহারথ বীরদ্বয় বজ্রসদৃশ সায়কে পরস্পর পরস্পরকে আঘাত করিতে লাগিলেন। বিচিত্র বর্ম্ম, আভরণ ও অস্ত্রধারী উভয়পক্ষীয় চতুরঙ্গ বল মহাবীর কর্ণ ও অর্জ্জুনকে বৃত্র ও বাসবের ন্যায় ঘোর সময়ে প্রবৃত্ত দেখিয়া বিস্ময়াবিষ্ট ও কম্পিত হইয়া উঠিল। ঐ সময় মহাবীর অর্জ্জুন মত্তমাতঙ্গ বধার্থে ধাবমান মত্তমাতঙ্গের ন্যায় অধিরথপুত্রের বিনাশার্থে গমন করিলে, দর্শনাভিলাষী বীরগণ মহা আহ্লাদে সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক অঙ্গুলি সমুত্থিত ও বস্ত্র বিধূনিত [পতাকা কম্পিত] করিতে লাগিল। তখন অর্জ্জুনের পুরোবৰ্ত্তী সোমকগণ চীৎকার করিয়া তাঁহাকে কহিলেন,-‘হে ধনঞ্জয়! তুমি অবিলম্বে কর্ণের মস্তক ছেদন করিয়া দুর্য্যোধনের রাজ্যপিপাসা নিরাকৃত কর।’ হে মহারাজ! তখন আমাদিগেরও অসংখ্য যোদ্ধা কর্ণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে সূতপুত্র! তুমি শীঘ্র গিয়া সুতীক্ষ্ণ শরনিকরে অর্জ্জুনকে বিনাশ কর। পাণ্ডবগণ দীনভাবাপন্ন হইয়া পুনরায় বনগমন করুক।’
“হে মহারাজ! অনন্তর মহাবীর কর্ণ দশশরে অর্জ্জুনকে প্রথমে বিদ্ধ করিলে, তিনিও হাস্য করিয়া সূতপুত্রের বক্ষঃস্থলে শিতধার দশ শর নিক্ষেপ করিলেন। তৎপরে সেই বীরদ্বয় অসংখ্য সুপুঙ্খ সায়ক নিক্ষেপপূর্ব্বক পরস্পরকে ক্ষতবিক্ষত করিয়া পরস্পরের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন মহাধনুর্দ্ধর ধনঞ্জয় বাহুস্ফোটন ও গাণ্ডীবের জ্যা পরিমার্জনপূর্ব্বক অনবরত নারাচ, নালীক, বরাহকৰ্ণা, ক্ষুর, অঞ্জলিক ও অর্দ্ধচন্দ্র বাণ নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। সায়ংকালে বিহঙ্গমগণ যেমন অবাঙ্মখ হইয়া বৃক্ষাভিমুখে গমন করে, তদ্রূপ সেই অর্জ্জুনের শরজাল কর্ণের রথাভিমুখে ধাবমান হইল। মহাবীর কর্ণ তদ্দর্শনে রোষপরবশ হইয়া অবিলম্বে তৎসমুদয় ছেদন করিলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন বারংবার কর্ণের প্রতি বিবিধ শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন; মহাবীর কর্ণও তৎসমুদয় নিরাকৃত করিলেন। এইরূপে অরাতিনিপাতন অর্জ্জুন ভ্রুকুটিবন্ধনপূর্ব্বক তৎকালে যে যে শর পরিত্যাগ করিলেন, সূতপুত্র স্বীয় শরনিকর দ্বারা তৎসমুদয়ই ছেদন করিয়া ফেলিলেন।
“তখন মহাবীর ধনঞ্জয় কর্ণের প্রতি শত্রুঘাতন ভীষণ আগ্নেয় অস্ত্র পরিত্যাগ করিলেন। ঐ অস্ত্র ভূমণ্ডল, আকাশমণ্ডল, দিঙ্মণ্ডল ও সূৰ্য্যমণ্ডল আচ্ছন্ন করিয়া প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। যোধগণ সেই অস্ত্রের প্রভাবে দগ্ধবসন হইয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। ঐ সময় বেণুবন দগ্ধ হইলে যেরূপ শব্দ হয়, সমরাঙ্গনে তদ্রূপ ঘোরতর নিঃস্বন হইতে লাগিল। তখন প্রতাপান্বিত সূতপুত্র সেই প্রজ্বলিত আগ্নেয়াস্ত্র নিরীক্ষণ করিয়া উহার নিবারণার্থে বারুণাস্ত্র নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর কর্ণের সেই মহাস্ত্রপ্রভাবে নভোমণ্ডল মেঘমণ্ডলে সমাচ্ছন্ন হইল এবং অনবরত বারিধারা নিপতিত হইয়া সেই অর্জ্জুনবাণসঞ্জাত অতি প্রচণ্ড অগ্নি নির্ব্বাপিত করিল। ঐ সময় মেঘমণ্ডলে সমুদয় দিগবিদিক্ ও আকাশমার্গ পরিব্যাপ্ত হওয়াতে অন্ধতমস প্রভাবে আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হইল না। মহাবীর অর্জ্জুন তদ্দর্শনে অবিলম্বে বায়ব্যাস্ত্ৰদ্বারা কর্ণের বারুণাস্ত্র নিবারণ করিলেন।
“অনন্তর নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ মহাবীর ধনঞ্জয় গাণ্ডীব, জ্যা ও বিশিখজাল মন্ত্রপূত করিয়া এক বজ্রতুল্যপ্রভাব, দেবরাজের অতি প্রিয়তর অস্ত্র প্রাদুর্ভূত করিলেন। তখন তাহার গাণ্ডীব হইতে অসংখ্য সুতীক্ষ্ণ ক্ষুর, অঞ্জলিক, অৰ্দ্ধচন্দ্র, নালীক, নারাচ ও বরাহকৰ্ণ অনবরত নির্গত হইয়া সূত্ৰপুত্রের দেহ, অশ্ব, শরাসন, যুগ, চক্র ও ধ্বজদণ্ড ভেদ করিয়া গরুড়ভীত ভুজঙ্গের ন্যায় অবিলম্বে ভূতলে প্রবেশ করিল। তখন মহাত্মা সূতপুত্র অর্জ্জুননিক্ষিপ্ত শরনিকরে সমাচ্ছন্ন ও রুধিরলিপ্তকলেবর হইয়া ক্রোধবিবৃত নেত্রে সমুদ্রের ন্যায় গভীর নির্ঘোষসম্পন্ন শরাসন আনত করিয়া ভার্গবাস্ত্র [পরশুরামপ্রদত্ত অস্ত্র] প্রাদুর্ভূত করিলেন। ঐ অস্ত্রপ্রভাবে ধনঞ্জয়বিনির্ম্মুক্ত অস্ত্রজাল বিনষ্ট এবং পাণ্ডবপক্ষীয় অসংখ্য রথী, হস্তী ও পদাতি বিনষ্ট হইল। অনন্তর সূতপুত্র একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া শিলাশিত সুবর্ণপুঙ্খ শরনিকরে পাঞ্চালদেশীয় প্রধান প্রধান যোদ্ধা ও সোমকদিগকে বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন; তাঁহারাও শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া ক্রোধভরে সুতীক্ষ্ণ শরজাল বিস্তারপূর্ব্বক চতুর্দ্দিক্ হইতে তাঁহাকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর সূতপুত্র হর্ষভরে শরনিকরে পাঞ্চালদেশীয় রথী, হস্তী ও অশ্বগণকে বলপূর্ব্বক নিহত, বিদ্ধ ও নিতান্ত নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। তাহারা কর্ণের শরজালে বিদীর্ণকলেবর হইয়া অরণ্যমধ্যে ক্রোধোদ্ধত ভীমপরাক্রম সিংহকর্ত্তৃক নিহত গজযূথের ন্যায় প্রাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক ভূতলে নিপতিত হইল। এইরূপে মহাবীর সূতপুত্র বলপ্রকাশপূর্ব্বক পাঞ্চালগণের প্রধান প্রধান বীরদিগকে বিনষ্ট করিয়া নভোমণ্ডলস্থ প্রচণ্ড দিবাকরের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। হে মহারাজ! তখন আপনার পক্ষীয় বীরগণ ‘সূতপুত্রের জয়লাভ হইল’ এই বিবেচনা করিয়া প্রফুল্লমনে সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন এবং অনুমান করিলেন যে, মহাবীর কর্ণ বাসুদেব ও অর্জ্জুনকে অতিশয় আঘাত করিয়াছেন।
কর্ণবধার্থ ভীমের অর্জ্জুন উত্তেজনা
“ঐ সময় ভীমপরাক্রম ভীমসেন মহারথ সূতপুত্রের পরাক্রম নিতান্ত দুর্ব্বিষহ ও ধনঞ্জয়নিক্ষিপ্ত অস্ত্র প্রতিহত দেখিয়া রোষারুণিত লোচনে করে কর নিষ্পেষণ ও ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক অর্জ্জুনকে কহিলেন,—‘হে বীর! আজ তোমার সমক্ষে এই অধর্ম্মপরায়ণ সূতনন্দন কিরূপে বলপূর্ব্বক পাঞ্চালগণের প্রধান প্রধান বীরদিগকে বিনাশ করিল? পূর্ব্বে রুদ্রদেবের প্রভাবে কালকেয় অসুরগণও তোমাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হয় নাই; আজ সূতপুত্র দশশরে কিরূপে তোমাকে বিদ্ধ করিল? আজ সূতপুত্র তোমার নিক্ষিপ্ত শরনিকর নিরাকৃত করাতে আমি অতিশয় বিস্মিত হইয়াছি। হে অর্জ্জুন! ঐ দুরাত্মা সূতপুত্র দ্রৌপদীকে যেরূপ ক্লেশ প্রদান করিয়াছিল এবং সভামধ্যে, আমাদিগকে ষণ্ডতিল বলিয়া অতি কঠোর বাক্যে যে উপহাস করিয়াছিল, তুমি এক্ষণে তৎসমুদয় স্মরণ করিয়া অবিলম্বে উহাকে সংহার কর। এক্ষণে তুমি কি নিমিত্ত সূতপুত্রের বিনাশে উপেক্ষা প্রদর্শন করিতেছ? ইহা উপেক্ষার প্রকৃত অবসর নহে। পূর্ব্বে তুমি খাণ্ডবারণ্যে ভগবান পাবকের তৃপ্তিসাধনার্থে যেরূপ ধৈৰ্য্য অবলম্বন করিয়া তত্ৰত্য প্রাণীসমুদয়কে বিনষ্ট করিয়াছিলে, এক্ষণেও সেইরূপ ধৈৰ্য্যদ্বারা সূতপুত্রকে বিনাশ কর। ঐ দুরাত্মা তোমার শরে নিহত হইলে আমি উহাকে গদাঘাতে বিপ্রোথিত করিব।
“ঐ সময় মহাত্মা বাসুদেবও কর্ণশরে অর্জ্জুনের অস্ত্রসমুদয় প্রতিহত দেখিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন,—‘হে সখে! আজ সূতপুত্র যে অস্ত্রদ্বারা তোমার অস্ত্রজাল নিরাকৃত করিল, ইহার কারণ কি? হে বীর! তুমি কেন উহার বিনাশে মনোনিবেশ করিতেছ না এবং কেনই বা বিমোহিত হইতেছ? ঐ দেখ, কৌরবগণ তোমার অস্ত্র প্রতিহত দেখিয়া সূতপুত্রের পুরস্কারপূর্ব্বক সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতেছে। অতএব তুমি যেরূপ ধৈৰ্য্য অবলম্বন করিয়া যুগে যুগে তমোগুণপ্রধান ভয়ঙ্কর রাক্ষস ও গর্ব্বিত অসুরগণকে বিনাশ করিয়াছিলে এবং যেরূপ ধৈৰ্য্য অবলম্বন করিয়া ভূতভাবন ভগবান শঙ্করকে সন্তুষ্ট করিয়াছিলে, আজ সেইরূপ ধৈৰ্য্যসহকারে সূতপুত্রকে অনুচরবর্গসমভিব্যাহারে সংহার কর। পূর্ব্বে সুররাজ ইন্দ্র যেমন বজ্ৰদ্বারা দানবরাজ নমুচিকে বিনাশ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ এক্ষণে তুমিও মৎপ্রদত্ত এই ক্ষুরধার সুদর্শনদ্বারা উহার শিরচ্ছেদনপূর্ব্বক ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে গ্রামনগরপরিপূর্ণা সাগরাম্বরা ধরণী প্রদান করিয়া স্বয়ং অসামান্য যশস্বী হও।’
অর্জ্জুনপ্রযুক্ত ব্রহ্মান্ত্রে বহু বিপক্ষ বীরক্ষয়
“হে মহারাজ! মহাবলপরাক্রান্ত অর্জ্জুন ভীমসেন ও বাসুদেবের এইরূপ বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া সূতপুত্রের সংহারে একান্ত অভিলাষী হইলেন এবং আপনার অসাধারণ বিক্রম স্মরণ ও ভূতলে জন্মগ্রহণ করিবার কারণ অনুধাবন করিয়া কেশবকে কহিলেন, ‘হে বাসুদেব! আমি সূতপুত্রের বধ ও লোকের উপকারসাধনের নিমিত্ত অতি ভয়ঙ্কর অস্ত্র প্রাদুর্ভূত করিতেছি; তুমি আমাকে অনুমতি প্রদান কর, আর ভগবান, ব্রহ্মা, রুদ্র এবং বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ও সুরগণ— ইঁহারাও এ বিষয়ে অনুমতি প্রদান করুন।’ হে মহারাজ! মহাবীর অর্জ্জুন এই বলিয়া প্রজাপতি ব্রহ্মাকে প্রণিপাতপূর্ব্বক নিতান্ত দুঃসহ ব্রাহ্ম-অস্ত্র প্রাদুর্ভূত করিলেন। তখন মহারথ সূতপুত্র জলধর যেমন জলধারা বর্ষণ করে, তদ্রূপ অনবরত শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক সেই অর্জ্জুননিক্ষিপ্ত ব্রহ্মাস্ত্র নিরাকৃত করিলেন।’ তদ্দর্শনে মহাবলপরাক্রান্ত ভীম একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সত্যসন্ধ ধনঞ্জয়কে কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন! লোকে তোমাকে ব্রহ্মাস্ত্রবেত্তা বলিয়া নির্দেশ করে, অতএব তুমি অন্য এক ব্রহ্মাস্ত্র যোজনা কর।’
“তখন মহাবীর ধনঞ্জয় ভীমসেনের বাক্যানুসারে পুনরায় ব্রহ্মাস্ত্র প্রাদুর্ভূত করিয়া দিবাকরের করজালসদৃশ সুতীক্ষ্ণ ভুজগের ন্যায় নিতান্ত ভয়ঙ্কর অসংখ্য শরনিকর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন সেই গাণ্ডীবনির্ম্মুক্ত যুগান্তকালীন অনল ও সূর্য্যের ন্যায় প্রদীপ্ত শরনিকর ক্ষণকালমধ্যে দিঙ্মণ্ডল ও সূতপুত্রের রথ সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। অনন্তর অর্জ্জুনের শরাসন হইতে শূল, পরশু, চক্র ও নারাচসমুদয় অনবরত নির্গত হইতে আরম্ভ হইল। তখন কৌরবপক্ষীয় যোধগণ চতুর্দ্দিকে নিহত হইতে লাগিল। ঐ সময় কোন কোন যোদ্ধা অর্জ্জুনশরে অন্যের মস্তক ছিন্ন ও দেহ ভূতলে নিপতিত নিরীক্ষণ করিয়া নিতান্ত ভীত হইয়া প্রাণত্যাগ করিল। কোন বীরের করিশুসদৃশ দক্ষিণ ভুজদণ্ড অর্জ্জুনশরে ছিন্ন হইয়া শাণিত অসির সহিত এবং কোন বীরের বামহস্ত ক্ষুরনিকৃত্ত হইয়া চর্ম্মের সহিত ধরণীতলে পতিত হইল। হে মহারাজ! এইরূপে শরনিকরদ্বারা দুর্য্যোধনের প্রধান প্রধান যোদ্ধৃদিগকে বিনষ্ট করিলেন।
“ঐ সময় মহারথ কর্ণও অর্জ্জুনের প্রতি পর্জ্জন্য [মেঘ] নির্ম্মুক্ত বারিধারার ন্যায় অনবরত শনিকর পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন। পরে তিনি কৃষ্ণ, অর্জ্জুন ও বৃকোদরকে তিন তিন শরে আঘাত করিয়া ঘোররবে সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় সূতপুত্র শরে সাতিশয় ব্যথিত হইয়া ভীম ও জনার্দ্দনকে নিরীক্ষণপূর্ব্বক ক্রোধভরে অষ্টাদশ শর সন্ধান। করিয়া তিনশরে সূতপুত্রকে, একশরে তাঁহার ধ্বজ, চারিশরে মদ্ররাজকে বিদ্ধ করিয়া সুবর্ণবর্ম্ম সমলঙ্কৃত সভাপতির প্রতি দশ দশ শর প্রয়োগ করিলেন। রাজকুমার সভাপতি অর্জ্জুননিক্ষিপ্ত শরে ছিন্নমস্তক, ছিন্নবাহু এবং অশ্ব, সারথি, শরাসন ও কেতুবিহীন হইয়া পরশুনিকৃত্ত শালবৃক্ষের ন্যায় তৎক্ষণাৎ রথ হইতে ভূতলে নিপতিত হইলেন। অনন্তর মহাবীর ধনঞ্জয় পুনরায় ক্রমে ক্রমে তিন, আট, দুই, চারি ও দশশরে কর্ণকে বিদ্ধ করিয়া চারিশত দ্বিরদ, আয়ুধসম্পন্ন আটশত রথী, আরোহিসমবেত সহস্র সহস্র অশ্ব ও আটসহস্র পদাতিকে নিহত করিলেন এবং সুতীক্ষ্ণ শরনিকরে সূতপুত্রকে সারথি, রথ ও কেতুর সহিত অদৃশ্য করিয়া, ফেলিলেন।
“অনন্তর কৌরবগণ ধনঞ্জয়কর্ত্তৃক নিহন্যমান হইয়া চীৎকারপূর্ব্বক সূতপুত্রকে কহিতে লাগিলেন, ‘হে কর্ণ! তুমি অনবরত শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক অবিলম্বে অর্জ্জুনকে বিনাশ কর, নচেৎ ঐ মহাবীর অল্পকালমধ্যেই কৌরবপক্ষীয় সমুদয় বীরগণকে নিহত করিবে।’ মহাবীর সূতপুত্র কৌরবগণকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া পরমযত্নসহকারে অনবরত মর্ম্মচ্ছেদী শরজাল বর্ষণপূর্ব্বক পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণকে আঘাত করিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে সেই ধনুর্দ্বরাগ্রগণ্য মহাবলপরাক্রান্ত বীরদ্বয় মহাস্ত্রজাল বিস্তারপূর্ব্বক উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণকে ও পরস্পরকে নিপীড়িত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
“ইত্যবসরে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির চিকিৎসকগণের সাহায্যে মন্ত্র ও ওষধিদ্বারা বিশল্য হইয়া যুদ্ধসন্দর্শনার্থ সত্বর সংগ্রামস্থলে আগমন করিলেন। তখন সকলে তাঁহাকে অশ্বিনীকুমারযুগলপ্রমুখ স্বৰ্গবৈদ্যগণকর্ত্তৃক চিকিৎসিত, অসুরশরে ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ সুররাজ পুরন্দরের ন্যায়, রাহুর করাল আস্য দেশ হইতে বিমুক্ত অখণ্ড চন্দ্রমণ্ডলের ন্যায় তথায় সমাগত দেখিয়া সাতিশয় সন্তুষ্ট হইল।
কর্ণশরে পাণ্ডবনিপীড়ন
“হে মহারাজ! তৎকালে স্বর্গবাসী ও ভূতলনিবাসিগণ অনিমেষ নেত্রে সূতপুত্র ও ধনঞ্জয়ের সেই ঘোরতর সংগ্রাম। অবলোকন করিতে লাগিলেন। তখন সেই পরস্পর প্রহারে প্রবৃত্ত বীরদ্বয় অনবরত জ্যানিঃস্বন ও তলধ্বনিপূর্ব্বক বিবিধ শরনিকর পরিত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময়ে মহাবীর ধনঞ্জয়ের শরাসনজ্যা অতিমাত্র আকৃষ্ট হওয়াতে ঘোররবে সহসা ছিন্ন হইয়া গেল। এই অবসরে মহাবীর সূতপুত্র একশত ক্ষুদ্রক ও নির্মোকনির্ম্মুক্ত সর্পের ন্যায় কঙ্কপত্রভূষিত তৈলধৌত অপরাপর বাণে ধনঞ্জয়কে সমাচ্ছন্ন করিলেন। তৎপরে তিনি ষষ্টিশরে বাসুদেবকে ও আটবাণে পুনরায় অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিয়া অসংখ্য উৎকৃষ্ট শরে বৃকোদরের মর্ম্মভেদপূর্ব্বক অর্জ্জুনের ধ্বজদণ্ডে শর নিক্ষেপ ও তাঁহার অনুগামী সোমকদিগকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। তখন সোমকগণ ক্রোধভরে ধাবমান হইয়া, মেঘমণ্ডল যেমন সূৰ্য্যকে সমাচ্ছন্ন করে, তদ্রূপ শরনিকরে কর্ণকে আচ্ছন্ন করিল; অস্ত্রবিদ্যাবিশারদ সূতপুত্ৰও অসংখ্যশরে তাঁহাদিগকে নিস্তব্ধ করিয়া তাঁহাদিগের অস্ত্রশস্ত্র নিরাকৃত, হস্তী, অশ্ব ও রথসকল নিপাতিত এবং প্রধান প্রধান সৈন্যদিগকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। বীরগণ সূতপুত্রের শরপ্রভাবে ক্রুদ্ধ সিংহসমুন্মথিত [সিংহকর্ত্তৃক বিদীর্ণদেহ] কুক্কুরগণের ন্যায় আর্ত্তনাদ করিয়া বিগতাসু হইয়া ভূতলে নিপতিত হইল। তখন মহাবীর সূতপুত্র অর্জ্জুনের নিধন। ও তাহার সাহায্যের নিমিত্ত মহাবেগে সমাগত পাঞ্চালগণকে সুনিশিত শরনিকরে নিপাতিত করিলেন। কৌরবগণ তদ্দর্শনে আপনাদিগকে সমরবিজয়ী জ্ঞান করিয়া তলধ্বনি ও সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় সকলেই বোধ করিল যে, এইবার কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে কর্ণের বশবর্তী হইতে হইবে।
অর্জ্জুনযুদ্ধে কৌরবপলায়ন
“তখন সূতপুত্রের শরে ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ মহাবীর ধনঞ্জয় ক্রোধভরে কর্ণের শরসমুদয় নিরাকৃত করিয়া শরাসন হইতে জ্যা অবনমিত করিয়া চাপজ্যা পরিমার্জনপূর্ব্বক কর্ণ, শল্য ও সমস্ত কৌরবগণকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তাঁহার মহাস্ত্রপ্রভাবে অন্তরীক্ষ অন্ধকারসমাচ্ছন্ন হওয়াতে পক্ষিগণের গতিরোধ হইল। ঐ সময় আকাশস্থিত জীবসকল সুগন্ধ সমীরণ সঞ্চালিত করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন হাস্যমুখে শল্যের বর্মোপরি দশ বাণ নিক্ষেপ করিয়া কর্ণকে প্রথমতঃ দ্বাদশবাণে ও পুনরায় সাতশরে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর সূতপুত্র অর্জ্জুনের অশনিসদৃশ শরে সাতিশয় সমাহিত হইয়া রুধিরাক্তকলেবর হইলে তাঁহাকে প্রলয়কালীন শ্মশানমধ্যস্থিত শোণিতদিগ্ধগাত্র রুদ্রদেবের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। অনন্তর সূতপুত্ৰ সুররাজসদৃশ ধনঞ্জয়কে তিনশরে বিদ্ধ করিয়া কৃষ্ণের বিনাশবাসনায় তাঁহার প্রতি ভীষণ ভুজঙ্গসদৃশ প্রজ্বলিত পাঁচ শর নিক্ষেপ করিলেন। ঐ পাঁচ শর তক্ষকপুত্র অশ্বসেনের পক্ষীয় পাঁচটি মহাসৰ্প। উহারা সূতপুত্ৰকর্ত্তৃক নিক্ষিপ্ত হইয়া পুরুষোত্তম বাসুদেবের বর্ম্ম বিদারণপূর্ব্বক মহাবেগে পাতালপ্রবেশ ও ভোগবতীজলে স্নান করিয়া পুনরায় কর্ণাভিমুখে আগমন করিতে লাগিল। মহাবীর ধনঞ্জয় তদ্দর্শনে দশভল্লে তাঁহাদের প্রত্যেককে তিন তিন খণ্ডে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর তিনি কৃষ্ণকে কর্ণনিক্ষিপ্ত নাগাস্ত্রে ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ নিরীক্ষণপূর্ব্বক তৃণদহপ্রবৃত্ত হুতাশনের ন্যায় ক্রোধে প্রজ্বলিত হইয়া আকৰ্ণাকৃষ্ট দেহান্তকর শরনিকরে কর্ণের মর্ম্মস্থল বিদ্ধ করিলেন। সূতপুত্র অর্জ্জুনের শরে গাঢ়বিদ্ধ হইয়া নিতান্ত ক্লেশনিবন্ধন অতিমাত্র বিচলিত হইলেন; কেবল ধৈর্য্যাতিশয়প্রযুক্ত রথ হইতে নিপতিত হইলেন না। হে মহারাজ! ঐ সময় মহাবীর ধনঞ্জয় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলে সমুদয় দিক্, বিদি, সূর্যরশ্মি ও অধিরথনন্দনের রথ এককালে অদৃশ্য হইয়া গেল এবং নভোমণ্ডল নীহারসমাচ্ছন্নের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। তখন অরাতিনিপাতন পার্থ একাকীই ক্ষণকালমধ্যে দুৰ্য্যোধন-প্রেরিত দ্বিসহস্র চক্ররক্ষক, পাদরক্ষক ও পৃষ্ঠরক্ষককে অশ্ব, রথ ও সারথি সহিত শমনসদনে প্রেরণ করিলেন। অনন্তর আপনার পুত্রেরা ও হতাবশিষ্ট কৌরবগণ নিহত ও ক্ষতবিক্ষত আত্মীয়দিগের এবং বিলাপমান পিতা ও পুত্রগণকে পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! ঐ সময়ে মহাবীর সূতপুত্র কৌরবগণ তাঁহাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক ভয়ে দশদিকে পলায়ন করিয়াছে অবলোকন করিয়াও কিছুমাত্র ভীত হইলেন না, প্রত্যুত হৃষ্টচিত্তে অর্জ্জুনের অভিমুখে ধাবমান হইলেন।”