৮৭তম অধ্যায়
কর্ণসহ অর্জ্জুন যুদ্ধে কৃষ্ণের অভয়বাণী
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! তখন পুরুষপ্রধান বাসুদেব দেবগণেরও দুর্নিব্বার্য্য মহাকায় সূতপুত্রকে উদ্বেল মহোদধির ন্যায় গর্জন করিয়া সমাগত হইতে দেখিয়া হাস্যমুখে অর্জ্জুনকে কহিলেন, ‘সখে! যাহার সহিত তোমাকে যুদ্ধ করিতে হইবে, ঐ সেই কর্ণ শল্যসঞ্চালিত শ্বেতাশ্বযুক্ত রথে আরোহণ করিয়া আগমন করিতেছে; অতএব তুমি এক্ষণে স্থির হও। ঔ দেখ মহাবীর কর্ণের কিঙ্কিণীজালজড়িত, নানা-পতাকাপরিবৃত, শ্বেতাশ্বযুক্ত রথ আকাশস্থিত বিমানের ন্যায় সমাগত হইতেছে। উহার শত্ৰুচাপসন্নিভ [ইন্দ্রধনুকতুল্য] নাগকক্ষ [হাতীর হাওদা চিহ্নিত] ধ্বজ যেন আকাশমার্গ উল্লিখিত করিতেছে। ঐ দেখ, সূতনন্দন দুর্য্যোধনের হিতচিকীর্ষায় বারিধারাবর্ষী জলদের ন্যায় শরজাল বর্ষণ করিয়া সমাগত হইতেছে। মদ্ররাজ শল্য উহার রথে অবস্থিত হইয়া অশ্বসঞ্চালন করিতেছেন। ঐ চতুর্দ্দিকে দুন্দুভিধ্বনি, শঙ্খনিঃস্বন ও বিবিধ সিংহনাদ শ্রবণগোচর হইতেছে। কর্ণের কোদণ্ডনিঃস্বন[ধনুকশব্দ]সমুদয় মহাশব্দ তিরোহিত করিয়াছে। মহারণ্যে মৃগগণ যেমন কোপাবিষ্ট সিংহকে দর্শন করিয়া পলায়ন করে, তদ্রূপ মহারথ পাঞ্চালগণ সূতপুত্রকে নিরীক্ষণ করিয়া সৈন্যগণসমভিব্যাহারে ইতস্ততঃ ধাবমান হইয়াছে। অতএব এক্ষণে তুমি সম্পূর্ণ যত্ন করিয়া সূতপুত্রকে নিপাতিত কর। তুমি ভিন্ন আর কেহই কর্ণের বাণ সহ্য করিতে সমর্থ নহে। আমি বিশেষরূপ অবগত আছি যে, তুমি দেবাসুরগন্ধর্ব্বসম্বলিত তিন লোক জয় করিতে পার। দেখ, জটাজুটধারী ভীষণাকার ত্রিনয়ন মহাদেবের সহিত যুদ্ধ করা দূরে থাকুক, কেহ তাঁহাকে দর্শন করিতে সমর্থ নহে; কিন্তু তুমি সেই সর্ব্বভূতের মঙ্গলপ্রদ মূর্তিমান্ দেবদেবের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া তাঁহাকে প্রীত করিয়াছ। অন্যান্য দেবগণও তোমাকে বরপ্রদান করিয়াছেন। এক্ষণে তুমি সেই শূলপাণির প্রসাদে ইন্দ্র যেমন নমুচিকে নিহত করিয়াছিলেন, তদ্রূপ সূতপুত্রকে সংহার কর। তোমার সর্ব্বদা মঙ্গল ও সংগ্রামে জয়লাভ হউক।’
“তখন অর্জ্জুন কহিলেন, ‘হে সখে! তুমি সর্ব্বলোকের গুরু। তুমি যখন আমার প্রতি পরিতুষ্ট হইয়াছ, তখন অবশ্যই আমার জয়লাভ হইবে। অতএব এক্ষণে তুমি রথসঞ্চালন কর, অর্জ্জুন কর্ণকে সমরে নিপাতিত না করিয়া কদাচ প্রতিনিবৃত্ত হইবে না। আজ তুমি হয় আমার বাণে কর্ণকে না হয় কর্ণের বাণে আমাকে ক্ষতবিক্ষত ও নিহত নিরীক্ষণ করিবে। যতদিন পৃথিবী বর্ত্তমান থাকিবে, ততদিন লোকে এই উপস্থিত ভয়ঙ্কর যুদ্ধের বিষয় কীৰ্ত্তন করিবে।’
“হে মহারাজ! মহাবীর ধনঞ্জয় বাসুদেবকে এই কথা বলিয়া মাতঙ্গের অনুগামী মাতঙ্গের ন্যায় কর্ণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। অনন্তর তিনি পুনরায় বাসুদেবকে কহিলেন, ‘হে কৃষ্ণ! সময় অতিবাহিত হইতেছে; অতএব অবিলম্বে অসঞ্চালন কর।’ মহাত্মা বাসুদেব অর্জ্জুনকর্ত্তৃক এইরূপ কথিত হইয়া তাঁহাকে জয়াশীর্ব্বাদ করিয়া তাহার মনোমারুতগামী অশ্বগণকে মহাবেগে সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। তখন অর্জ্জুনের রথ ক্ষণকালমধ্যেই কর্ণরথের অগ্রে উপনীত হইল।”