৮৫তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের প্রত্যাগমন—যজ্ঞস্থাননির্ম্মাণ
বৈশম্পায়ন বলিলেন, মহারাজ! মহাবীর অর্জ্জুন শকুনির পুত্রকে এইরূপ কহিয়া পুনরায় সেই কামবিহারী অশ্বের অনুগমনে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন ঐ অশ্ব ক্রমশঃ হস্তিনাভিমুখে আগমন করিতে আরম্ভ করিল। এদিকে ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির চরগণের নিকট অশ্বের আগমন ও অর্জ্জুনের কুশলবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া মহা আহ্লাদিত হইলেন। গান্ধারাদি দেশে অর্জ্জুনের সহিত যেসমুদয় যুদ্ধঘটনা হইয়াছিল, ঐ সময় তৎসমুদয় তাঁহার কর্ণগোচর হওয়াতে তাঁহার আহ্লাদের আর পরিসীমা রহিল না। অনন্তর তিনি উৎকৃষ্ট নক্ষত্রযুক্ত মাঘী-দ্বাদশীতে ভীমসেন, নকুল ও সহদেবকে আপনার সমীপে সমানীত করিয়া বৃকোদরকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভ্রাতঃ! আমি চরমুখে শুনিলাম, তোমার অনুজ অর্জ্জুন অশ্বের সহিত নির্ব্বিঘ্নে আগমন করিতেছেন। মাঘীপূর্ণিমা আগত প্রায়; মাঘমাসও নিঃশেষিত হইল। যজ্ঞানুষ্ঠানের অধিক দিন বিলম্ব নাই; অশ্বও এক্ষণে নিকটবর্ত্তী হইয়াছে। অতএব বেদপারদর্শী ব্রাহ্মণগণকে যজ্ঞের উপযুক্ত স্থান নিরূপণ করিতে আদেশ কর।”
ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির এই কথা কহিলে, মহাবীর বৃকোদর অর্জ্জুনের আগমনবৃত্তান্ত-শ্রবণে মহা আহ্লাদিত হইয়া যজ্ঞকুশল ব্রাহ্মণ ও বিজ্ঞতম স্থপতিদিগের সহিত যজ্ঞভূমি দর্শনার্থ গমন করিলেন এবং অবিলম্বে ব্রাহ্মণগণের মতানুসারে একখণ্ড বৃহৎ ভূমি মনোনীত করিয়া উহার মধ্যে যজ্ঞকাৰ্য্যের উপযুক্ত স্থান বিশুদ্ধ কাঞ্চনদ্বারা মণ্ডিত করাইলেন। তৎপরে স্থপতিগণ তাঁহার নির্দ্দেশানুসারে ঐ ভূমির অন্যান্য স্থানে বিবিধ রত্নবিভূষিত মণিময় কুট্টিম[চাতাল]যুক্ত শত শত প্রাসাদ, কনকময় বিচিত্র স্তম্ভ, বৃহৎ তোরণ এবং অন্তঃপুরচারিণী কামিনী, নানা দেশসমাগত নরপতি ও ব্রাহ্মণগণের বাসোপযোগী গৃহসমুদয় প্রস্তুত করিতে লাগিল।
নিমন্ত্রিত নরপতিগণের আগমন—অভ্যর্থনা
সমুদয় কাৰ্য্য সুসম্পন্ন হইলে, মহাত্মা ভীমসেন যুধিষ্ঠিরের আদেশানুসারে নরপতিদিগের নিকট দূত প্রেরণ করিলেন। নরপতিগণও ধৰ্ম্মরাজের হিতসাধনাৰ্থ বিবিধ রত্ন, স্ত্রী, অশ্ব ও আয়ুধ লইয়া হস্তিনায় আগমন করিতে লাগিলেন। ঐ সকল নরপতি হস্তিনায় উপস্থিত হইয়া শিবির সংস্থাপন করিলে উঁহাদের শিবিরমধ্যে সমুদ্রগর্জ্জনের ন্যায় ঘোরতর গভীর শব্দ সমুত্থিত হইতে আরম্ভ হইল। তখন ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই সমাগত নরপতিদিগের নিমিত্ত অন্ন, পানীয় ও অলোকসামান্য শয্যা এবং বাহনদিগের নিমিত্ত ধান্য, ইক্ষু ও গোরসপরিপূর্ণ বিবিধ গৃহসকল প্রদান করিতে আদেশ করিলেন।
অনন্তর বেদবিদ্যাসম্পন্ন বহুসংখ্যক মুনি ও শ্রেষ্ঠতম ব্রাহ্মণগণ শিষ্যগণসমভিব্যাহারে তথায় সমাগত হইতে লাগিলেন। ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তাঁহাদিগকে দর্শনমাত্র বিনীতভাবে অভ্যর্থনা করিয়া স্বয়ং তাঁহাদের আবাসস্থান পৰ্য্যন্ত তাঁহাদিগের অনুগমন করিলেন। ঐ সময় স্থপতি ও অন্যান্য শিল্পিগণ যজ্ঞোপকরণসমুদয় প্রস্তুত হইয়াছে বলিয়া ধৰ্ম্মরাজের নিকট নিবেদন করিল। ধৰ্ম্মরাজ উহা শ্রবণ করিয়া ভ্রাতৃগণের সহিত যারপরনাই আহ্লাদিত হইলেন।
নৃপতিগণের সভারোহণ
এইরূপে সেই অশ্বমেধযজ্ঞের সমুদয় দ্রব্য প্রস্তুত হইলে হেতুবাদনিরত বাগ্মিগণ সভায় উপবেশনপূৰ্ব্বক পরস্পর পরস্পরের পরাজয়বাসনায় নানাপ্রকার হেতু প্রদর্শন করিয়া তর্কবিতর্ক করিতে লাগিলেন এবং সমাগত নৃপতিগণ সেই ভীমসেনবিহিত যজ্ঞভূমির উপকরণসমুদয় দর্শন করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ যজ্ঞভূমির কোন স্থানে কনকময় বিচিত্র তোরণ, কোন স্থানে বিবিধ শয্যা, আসন ও বিহারসামগ্রী, কোন স্থানে জনতা, কোন স্থানে সুবর্ণময় ঘট, কটাহ [কড়া], কলস ও শরাব [শরা], কোন স্থানে সুবর্ণ বিভূষিত দারুময় [কাষ্ঠময়] ঘূপ, কোন স্থানে স্থলজাত ও জলজাত জন্তুসমুদয়, কোন স্থানে বিবিধ বিহঙ্গম [পক্ষী], কোন স্থানে বৃদ্ধা স্ত্রী-সমুদয় এবং কোন স্থানে উদ্ভিজ [বৃক্ষ] ও নানাপ্রকার পর্ব্বতজ প্রাণীসমুদয় দর্শনে নরপতিগণের বিস্ময়ের আর পরিসীমা রহিল না। ঐ সময় তত্ৰত্য সকল ব্যক্তিই মনে করিতে লাগিলেন যে, বুঝি সমুদয় জম্বুদ্বীপ এই যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞস্থানে সমাগত হইয়াছে। ঐ যজ্ঞস্থলে ব্রাহ্মণ ও বৈশ্যগণের আহারসামগ্রীর কিছুমাত্র অপ্রতুল ছিল না। চতুর্দ্দিকে অন্নের পর্ব্বত, ঘৃত ও দধির নদী এবং রাশি রাশি অন্যান্য রাজভোগ্য সামগ্রীসমুদয় বিদ্যমান ছিল। সুবৰ্ণমাল্যধারী মণিকুণ্ডলমণ্ডিত সহস্র সহস্র ব্যক্তি বিচিত্র পাত্ৰসমুদয়ে সেই সকল ভোজ্যদ্রব্য গ্রহণপূৰ্ব্বক ব্রাহ্মণগণকে পরিবেশন করিতে আরম্ভ করিল। এক এক লক্ষ ব্রাহ্মণের ভোজন সমাপন হইলে, এক একবার দুন্দুভিধ্বনি [স্বৰ্গস্থ ঢাকের বাদ্য] হইতে লাগিল। এইরূপে প্রতিদিন যে কত শতবার দুন্দুভিধ্বনি হইল, তাহার সংখ্যা নাই।