৮৪তম অধ্যায়
শকুনিতনয়ের পরাভব—গান্ধারজয়
বৈশম্পায়ন বলিলেন, তখন শকুনির পুত্র মহারথ গান্ধাররাজ অর্জ্জুনকে অধিকারমধ্যে সমাগত দেখিয়া তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিবার মানসে চতুরঙ্গিণী সেনাসমভিব্যাহারে ধ্বজপতাকা উড্ডীন করিয়া ধাবমান হইলেন। ঐ সময় গান্ধারনগরে যেসমুদয় যোদ্ধা ছিলেন, তাঁহারা সকলেই শকুনির বধবৃত্তান্ত স্মরণ করিয়া শরাসনধারণপূৰ্ব্বক পাণ্ডুতনয়ের অভিমুখে আগমন করিতে লাগিলেন। তখন ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মা ধনঞ্জয় তাঁহাদিগের নিকট বিনীতভাবে যুধিষ্ঠিরের বাক্য কীৰ্ত্তন করিয়া তাঁহাদিগকে যুদ্ধ করিতে নিবারণ করিলেন, কিন্তু উঁহারা ঐ বাক্য অগ্রাহ্য করিয়া ক্রোধাবিষ্টচিত্তে অশ্বকে পরিবেষ্টনপূৰ্ব্বক তাঁহার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন অম্লানবদনে গাণ্ডীবনির্ম্মুক্ত শাণিতক্ষুরদ্বারা তাঁহাদিগের শিরচ্ছেদন করিতে আরম্ভ করিলেন। অনন্তর গান্ধারদেশীয় যোধগণ তাঁহার শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া ভয়ে সেই যজ্ঞীয় অশ্ব পরিত্যাগপূৰ্ব্বক তাঁহাকে দৃঢ়রূপে আক্রমণ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া গাণ্ডীবনির্ম্মুক্ত শাণিতশরনিকরে তাঁহাদের অনেককেই শমনসদনে প্রেরণ করিলেন।
এইরূপে গান্ধারদেশীয় যোধগণ পার্থশরে নিতান্ত নিপীড়িত ও নিহত হইলে শকুনিনন্দন স্বয়ং অর্জ্জুনের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। মহাত্মা ধনঞ্জয় গান্ধারপতিকে সংগ্রামে প্রবৃত্ত দেখিয়া যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞানুসারে তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “গান্ধাররাজ! মহারাজ যুধিষ্ঠির আমাকে সংগ্রামে ভূপতিদিগের প্রাণসংহার করিতে নিষেধ করিয়াছেন। অতএব আজ তুমি যুদ্ধে নিবৃত্ত হও।”
মহাত্মা ধনঞ্জয় এই কথা কহিলে, গান্ধারপতি অজ্ঞানবশতঃ যুদ্ধে ক্ষান্ত না হইয়া তাঁহার প্রতি শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন তদ্দর্শনে নিতান্ত কোপাবিষ্ট হইয়া অর্ধচন্দ্রাকার বাণদ্বারা গান্ধারপতির মস্তক হইতে শিরস্ত্রাণ অপনীত করিলেন। শিরস্ত্রাণ পার্থশরে অপনীত হইয়া জয়দ্রথের মস্তকের ন্যায় বহুদূরে নিপতিত হইল। গান্ধারদেশীয় বীরগণ ঐ ব্যাপার-দর্শনে নিতান্ত বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া নিশ্চয় বুঝিতে পারিলেন যে, অর্জ্জুন রাজা বলিয়া গান্ধারপতির প্রাণসংহার করিলেন না। তখন গান্ধাররাজ পার্থের সেই অসাধারণ কাৰ্য্যদর্শনে যারপরনাই শঙ্কিত হইয়া যোধগণের সহিত সংগ্রাম হইতে পলায়ন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় গান্ধারগণকে বেগে পলায়ন করিতে দেখিয়া নতপর্ব্বভল্লদ্বারা তাঁহাদিগের মস্তকচ্ছেদন করিতে আরম্ভ করিলেন। সেই সময় অনেকানেক বীর নিতান্ত শঙ্কিতচিত্তে পলায়ন করিতে করিতে গাণ্ডীবনির্ম্মুক্ত শরনিকরদ্বারা আপনাদিগের বাহুসমুদয় ছিন্ন হইলেও তাহা অবগত হইতে পারিলেন না। পরিশেষে সেই চতুরঙ্গ গান্ধারসৈন্য নিতান্ত ভীত হইয়া বারংবার সংগ্রামস্থলে পরিভ্রমণ করিতে লাগিল; কেহই অগ্রসর হইয়া অৰ্জ্জুনের পরাক্রম সহ্য করিতে পারিল না।
এইরূপে গান্ধারসৈন্যগণ নিতান্ত নিপীড়িত ও নিঃশেষিতপ্রায় হইলে গান্ধাররাজ শকুনিতনয়ের জননী অর্দ্ধহস্তে বৃদ্ধ মন্ত্রিগণসমভিব্যাহারে পুর হইতে বহির্গত হইয়া সত্বর সংগ্রামস্থলে আগমনপূর্ব্বক পুত্রকে যুদ্ধ হইতে নিবারণ করিয়া অৰ্জ্জুনের যথোচিত সৎকার করিলেন। তখন মহাত্মা ধনঞ্জয় মাতুলানীকে [মামীকে] সমরাঙ্গনে সমাগত দেখিয়া প্রযত্নসহকারে তাঁহার পূজা করিয়া শকুনিনন্দনকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভ্রাতঃ! তুমি সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া আমার নিতান্ত অপ্রিয় কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছ। যখন আমার সহিত তোমার ভ্রাতৃসম্বন্ধ বিদ্যমান আছে, তখন তুমি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া বুদ্ধিমানের কার্য্য কর নাই। আমি কেবল জননী গান্ধারী ও জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রকে স্মরণ করিয়াই তোমাকে বিনাশ করিলাম না। যাহা হউক, তোমার এইরূপ বুদ্ধি যেন আর কদাচ উপস্থিত না হয়। এক্ষণে তুমি বৈরভাব পরিত্যাগ করিয়া স্বীয় ভবনে প্রস্থান কর। মহারাজ যুধিষ্ঠির চৈত্রী-পূর্ণিমাতে অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিবেন। ঐ দিবস হস্তিনানগরে গমন করিও।”