অনুসন্ধিৎসু ধৃতরাষ্ট্রের বনগমনোদ্যত পাণ্ডবদিগের অবস্থা শ্রবণ
ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, সব্যসাচী, নকুল, সহদেব, ধৌম্য এবং যশস্বিনী দ্রৌপদী কি প্রকারে গমন করিতেছেন, বল; আমি তাহাদিগের বিচেষ্টিত সকল শুনিতে ইচ্ছা করি।”
বিদুর কহিলেন, “মহারাজ! যুধিষ্ঠির বসন দ্বারা আপনার মুখমণ্ডল আচ্ছাদিত করিয়া এবং ভীমসেন বিশাল বাহুদ্বয় অবলোকন করিয়া গমন করিতেছেন; সব্যসাচী বালুকা বপন [বালুকা বিকিরণ—বালী ছড়ান] করিতে করিতে যুধিষ্ঠিরের পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতেছেন; সহদেব আলিপ্ত-মুখে ও পরমসুন্দর নকুল আকুলহৃদয়ে ও ধূলিধূসরিত কলেবরে জ্যেষ্ঠের অনুগামী হইয়াছেন। আয়তলোচনা সুকুমারী দ্রুপদকুমারী আলুলায়িত কেশপাশে মুখমণ্ডল অবগুষ্ঠিত করিয়া রোদন করিতে করিতে রাজার অনুগমন করিতেছেন। পুরোহিত ধৌম্য যাম্য, সাম ও রৌদ্র মন্ত্রসকল গান করিতে করিতে পথে তাহাদিগের সমভিব্যাহারী হইলেন।
ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে বিদুর! পাণ্ডবগণ বিবিধ রূপধারণ করিয়া গমন করিতেছেন, ইহার কারণ কি?”
বিদুর কহিলেন, “হে রাজন্! ধীমান যুধিষ্ঠির আপনার পুত্ৰগণ কর্তৃক শঠতাপূর্ব্বক হৃতরাজ্য ও হৃতসর্ব্বস্ব হইলেও তাঁহার বুদ্ধি ধর্ম্ম হইতে বিচলিত হয় নাই। তিনি দুৰ্য্যোধনাদির প্রতি নিয়ত করুণা প্রকাশ করিতেন, তথাপি তাঁহারা তাঁহাকে ছলপূর্ব্বক রাজ্যভ্ৰষ্ট করিল, এই ক্ৰোধে তিনি নেত্রদ্বয় নিমীলিত করিয়াছেন; এই দারুণ দৃষ্টিপাতে কাহাকেও দগ্ধ হইতে না হয়, এই ভাবিয়া তিনি মুখমণ্ডল আবৃত করিয়া গমন করিতেছেন। বাহুধনদর্পিত ভীমসেন বাহুবলে আমার সমান কেহই নাই, এই মনে করিয়া শক্ৰগণের প্রতি বাহুবলের অনুরূপ কর্ম্ম করিতে ইচ্ছা করিয়া বাহুদ্বয় প্রসারিত করিয়া যাইতেছেন। ধনঞ্জয় শরবর্ষণ উদ্দেশে বালুকা বর্ষণ করিতেছেন; তিনি দুঃসহ বালুকাবৰ্ষণের ন্যায় অরাতিগণের প্রতি শরবর্ষণ করিবেন। কেহ চিনিতে না পারে, এই জন্য সহদেব আলিপ্ত-মুখ [আনতবদন] হইয়াছেন। নকুল স্ত্রীগণের মনোমোহিনী মূর্তি গোপন করিবার আশয়ে সর্ব্বাঙ্গ পাংশুলিপ্ত করিয়াছেন। রজস্বলা শোণিতার্ন্দ্ৰ-বসনা মুক্তকেশী দ্রৌপদী রোদন করিতে করিতে কহিতেছেন, “আমি যাহাদের নিমিত্ত এই দারুণ দশান্তর প্রাপ্ত হইলাম, চতুর্দশ বর্ষে তাহাদের রজস্বলা ভাৰ্য্যারা, পতি, পুত্র ও বন্ধুবান্ধব বিনষ্ট হইলে শোণিতদিগ্ধাঙ্গী, মুক্তকেশী ও কৃততর্পণা হইয়া হস্তিনানগরে প্রবেশ করিবে।’ কুশহস্ত ধৌম্য পুরোহিত ‘ভরতকুল নিহত হইলে কুরুকুলের গুরুগণ এইরূপ সাম গান করিবে’ এই কথা কহিয়া সাম ও যাম্য গান করিতে করিতে অগ্ৰে অগ্ৰে গমন করিতেছেন। পৌরগণ সাতিশয় দুঃখার্ত হইয়া এইরূপ পরিতাপ করিতেছেন যে, হা! দেখ, আমাদের রক্ষাকর্তারা গমন করিতেছেন! কুরুবৃদ্ধগণের চেষ্টা নিতান্ত বালকের ন্যায়; অতএব তাঁহাদের আচরণে ধিক; তাহারা লোভপরতন্ত্র হইয়া পাণ্ডুর উত্তরাধিকারিগণকে রাষ্ট্র হইতে নির্ব্বাসিত করিলেন। আমরা পাণ্ডবিহীন হইয়া অনাথ হইলাম, দুর্বিনীত লুব্ধপ্রকৃতি কৌরবগণের প্রতি আমাদের প্রীতি কোথায়?” পুরবাসিগণ এইরূপে বিলাপ ও পরিতাপ করিতেছে; পাণ্ডবেরাও আকার ও ইঙ্গিত দ্বারা মনোগত অভিপ্ৰায় প্রকাশ করিতে করিতে বনগমন করিলেন। সেই মহাপুরুষেরা হস্তিনা হইতে প্রস্থান করিলে পর বিনা মেঘে বিদ্যুৎপ্রকাশ, ভূমিকম্প ও নগরমধ্যে উল্কাপাত হইতে লাগিল এবং রাহুগ্রহ বিনা পূর্ব্বে [পূর্ণিমা অমাবস্যা ব্যতিরেকে] দিবাকরকে গ্ৰাস করিল; মাংসভোজী গৃধ্র, গোমায়ু ও বায়সগণ দেবালয়, অশ্বত্থাদি বৃক্ষ, প্রাচীর ও অট্টালিকাতে নিনাদ করিতেছে। মহারাজ! আপনার দুৰ্ম্মন্ত্রণায় ভরতিকূল-বিনাশের নিমিত্ত এই সকল অশিবসূচক লক্ষণ আবির্ভূত হইতেছে।”
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে জনমেজয়! ধীমান বিদুর ও রাজা ধৃতরাষ্ট্র এইরূপ কথোপকথন করিতেছেন, এমত সময়ে মহর্ষিপরিবৃত দেবর্ষিসত্তম নারদ সভামধ্যে কুরুগণের পুরোভাগে উপস্থিত হইয়া ভয়ঙ্করবাক্যে কহিলেন, “অদ্য হইতে চতুর্দ্দশ বর্ষে দুৰ্য্যোধনের অপরাধে এবং ভীমার্জ্জুনের বলে কুরুকুল নির্মূলিত হইবে।” তিনি এই কথা কহিয়া ব্ৰাহ্মশোভা ধারণপূর্ব্বক শীঘ্র আকাশপথ অবলম্বন করিয়া অন্তহিত হইলেন।
দ্রোণের পাণ্ডবরাজ্যপালন—দুৰ্য্যোধনাদির সতর্কীকরণ
তদনন্তর দুৰ্য্যোধন, কর্ণ এবং সুবলনন্দন শকুনি দ্রোণাচাৰ্য্যকে প্রধান অবলম্বন বিবেচনা করিয়া পাণ্ডবদিগের সমুদয় রাজ্য তাঁহাকেই প্ৰদান করিলেন।
দ্রোণাচাৰ্য্য অসহিষ্ণু দুৰ্য্যোধন, দুঃশাসন ও কর্ণ প্রভৃতি সকলকে কহিলেন, “দ্বিজাতিগণ দেবপুত্ৰ পাণ্ডবদিগকে অবধ্য বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন, কিন্তু আমি শরণাগত, সর্ব্বপ্রযত্নে অনুরক্ত ধাৰ্তরাষ্ট্রদিগকে পরিত্যাগ করিতে পারি না। যাহা হউক অতঃপর দৈবই মূলাধার। পাণ্ডবগণ ধর্ম্মতঃ পরাজিত হইয়া বনে গমন করিতেছেন, তাহারা অরণ্যে দ্বাদশ বৎসর ব্ৰহ্মচৰ্য্য আচরণ করিয়া পরে দুঃখজন্য রোষ ও অমর্যাপরবশ হইয়া বৈরানিৰ্য্যাতন করিবেন। আমিও সখিবিদ্রোহে [বন্ধুতা-প্রত্যাখ্যান সম্পর্কে সঙঘটিত সমরে] দ্রুপদী রাজাকে রাজ্যভ্ৰষ্ট করিলে, তিনি আমার প্রাণসংহারের নিমিত্ত যজ্ঞ করিয়াছিলেন। এইরূপ যাগ, উপযাগ ও তপস্যা দ্বারা ধনু, কবচ ও শরধারী অগ্নিবৰ্ণ ধৃষ্টদ্যুম্ন পুত্র ও ক্ষীণমধ্যা অনিন্দিতা দ্রৌপদী কন্যা লাভ করিলেন; সেই দেবদত্ত ধৃষ্টদ্যুম্ন পাণ্ডবগণের শ্যালক; তিনি তাহাদিগের প্রিয়তর হইয়াছেন; এই নিমিত্ত আমি মর্ত্যধর্ম্ম [মরণ—ধর্ম্মরূপ মানবতা] প্ৰযুক্ত তাহা হইতে ভয় প্রাপ্ত হইয়াছি। ‘ধৃষ্টদ্যুন্ন দ্রোণের মৃত্যুস্বরূপ’ এই কথা বিশেষরূপে প্রথিত আছে, দ্রুপদানন্দন আমার বধের নিমিত্ত উৎপন্ন হইয়াছে, ইহা অনেকেই শ্রবণ করিয়াছে; এক্ষণে তাহার বৈরানিৰ্য্যাতনের উত্তম অবসর উপস্থিত হইয়াছে, অতএব শীঘ্র সাবধান হও। বিশেষতঃ শত্রুঘাতী দ্রুপদ তাহাদের পক্ষ হইয়াছেন। হে কৌরবগণ! যে অর্জ্জুন রখী এবং মহারথগণনা সময়ে অগ্রগণ্য হইয়া থাকেন, যিনি আমার নিতান্ত প্রীতিপাত্ৰ, তাঁহার সহিত যুদ্ধ করা অপেক্ষা পৃথিবীমধ্যে অধিকতর দুঃখের বিষয় আর কি আছে? যাহা হউক, তোমার এই সুখ হেমন্তকালীন তালচ্ছায়ার ন্যায় মুহূর্তমাত্র স্থায়ী; অতএব প্রধান প্রধান যজ্ঞের অনুষ্ঠান কর, ভোগ কর এবং দান কর, ত্ৰয়োদশ বর্ষ অতীত হইলেই তোমাকে বিপন্ন হইতে হইবে।”
ধৃতরাষ্ট্র দ্রোণবাক্য শ্রবণপূর্ব্বক বিদুরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে ক্ষত্তঃ! আচাৰ্য্য মহাশয় যথার্থ কহিতেছেন, অতএব তুমি পাণ্ডবগণকে প্রত্যাবৃত্ত কর। যদি তাহারা প্রত্যাবৃত্ত না হয়, তাহা হইলে তাহাদিগকে শস্ত্র, রথ, পদাতি ও ভোগ দ্বারা সৎকৃত করিয়া বিদায় কর।”