পাণ্ডবগণের বনবাসে উদ্যোগ—বনবাসে উদযোগী পাণ্ডবপ্রতি দুঃশাসন-দুরুক্তি
বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর পাণ্ডবেরা দ্যূতে পরাজিত হইয়া বনবাসে কৃতসঙ্কল্প হইলেন এবং যথাক্রমে অজিন উত্তরীয় গ্রহণ করিলেন। এই অবসরে দুঃশাসন তাহাদিগকে অজিনসংবৃত, বনবাসার্থ দীক্ষিত ও রাজ্যভ্ৰষ্ট দেখিয়া কহিলেন, “এক্ষণে একমাত্র দুর্য্যোধনেরই রাজ্য হইল, পাণ্ডবেরা পরাজিত হইয়া একান্ত দুরবস্থাপন্ন হইল। অদ্য পাণ্ডবেরা দীর্ঘকাল অনন্ত নরকে পাতিত, সুখচ্যুত ও রাজ্যভ্রষ্ট হইল। যে পাণ্ডবেরা ধনমদে মত্ত হইয়া ধৃতরাষ্ট্ৰপুত্রদিগকে উপহাস করিয়াছিল, এক্ষণে তাহারাই নির্জিত ও হৃতসর্ব্বস্ব হইয়া বন্যপ্ৰবেশ করিতেছে। ইহাদিগের বিচিত্র বর্ম্ম ও অতিভাস্বত্ব দিব্যাম্বর বলপূর্ব্বক উন্মোচিত কর এবং পূর্ব্বপ্রতিজ্ঞানুসারে রুরুচর্ম্ম পরিধান করাইয়া দাও। যাহারা ত্ৰিলোকমধ্যে অস্মদ্সদৃশ ব্যক্তি নাই বলিয়া প্রতিপন্ন করিয়াছিল, অদ্য তাহারাই বৈপরীত্যে আপনাদিগকে দীন জ্ঞান করিতেছে। মহাপ্রাজ্ঞ যজ্ঞসেন পাণ্ডবদিগকে কন্যা দান করিয়া কিছুমাত্ৰ পুণ্য সঞ্চয় করিতে পারেন নাই, কারণ, তাহারা ক্লীব। হে দ্রৌপদী! তুমি নির্ধন অমৰ্য্যাদাভাজন অজিনোত্তরীয়সম্পন্ন পাণ্ডবদিগকে বনে বনে ভ্ৰমণ করিতে দেখিয়া কি প্রীতি লাভ করিবে? এক্ষণে যাহাকে ইচ্ছা হয়, পতিত্বে বরণ করা। এই সমস্ত ধনধান্যসম্পন্ন ক্ষান্ত দান্ত কৌরবসভামধ্যে সমবেত আছেন, তুমি ইহাদিগের একজনকে পতিত্বে বরণ কর, তাহা হইলে তোমাকে আর এইরূপ দূরদৃষ্টভাগিনী হইতে হইবে না। যাদৃশ ষণ্ডতিল ও চর্ম্মময় মৃগ নিম্প্রয়োজন, পাণ্ডবেরাও সেইরূপ হইয়াছে। ষণ্ডতিলের উপাসনার ন্যায় এক্ষণে পতিত পাণ্ডবদিগের উপাসনা করিলে তোমার সকল শ্রমই বিফল হইবে।
কৌরবকুলনাশে পাণ্ডবপ্রতিজ্ঞা
মহারাজ! এইরূপ সেই নৃশংস দুঃশাসন অশেষ পরুষবাক্য প্রয়োগপূর্ব্বক পাণ্ডবগণকে ভৎসনা করিল। ভীমসেন তাহার নিতান্ত দুঃসহ বাক্যসকল শ্রবণ করিয়া ক্ৰোধে অধীর হইয়া উঠিলেন এবং উচ্চৈঃস্বরে যথোচিত ভৎসনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, “রে ক্রূর! পাপাচারপরায়ণ লোকে যে সকল কথা উচ্চারণ করিয়া থাকে, তুই সেই সমস্ত কথা প্রয়োগ করিতেছিস ; তুই রাজগণমধ্যে গান্ধারবিদ্যাপ্রভাবে আত্মশ্লাঘা করিলি, এক্ষণে তুই যাদৃশ বাক্যরূপ ছুরিকা দ্বারা আমাদিগের মর্ম্ম ভেদ করিতেছিস রণস্থলে আমিও এইরূপে তোর চর্ম্মচ্ছেদ করিব। যাহারা ক্রোধ ও লোভের বশবর্তী হইয়া তোর অনুবৃত্তি করিতেছে, তাহাদিগকেও সত্বর যমালয়ে গমন করিতে হইবে।”
নির্লজ্জ দুঃশাসন অজিনধারী নির্ব্বাসিত ভীমসেনকে ‘গরু গরু’ বলিয়া আহ্বান করিতে করিতে চতুর্দিকে নৃত্য করিতে আরম্ভ করিল।
ভীমসেন কহিলেন, “রে নৃশংস দুঃশাসন! শঠতাপূর্ব্বক ধনসম্পত্তি অপহরণ করিয়া পরুষবাক্যপ্রয়োগ বা আত্মশ্লাঘা করা কি উচিত? যদি সংগ্রামে তোর বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করিয়া শোণিত পান না করি, তবে কুন্তীপুত্র বৃকোদার যেন পুণ্যলোকে গমন না করে। আমি তোর সাক্ষাতে এই কহিতেছি যে, অচিরকালমধ্যে সমুদয় ধাৰ্ত্তরাষ্ট্র এবং কপটাচারী সমস্ত ধনুৰ্দ্ধরকে শমনসদনে প্রেরণ করিয়া শান্তি লাভ করিব।”
পাণ্ডবগণ সভা হইতে বহির্গত হইতেছেন, পশ্চাদ্ভাগে নরাধম দুৰ্য্যোধন ভঙ্গী করিয়া সিংহগতি ভীমসেন ও অন্যান্য কৌন্তেয়গণের অনুসরণ করিতে লাগিলেন। অভিমানী ভীমসেন আপনাকে অবমানিত দেখিয়াও ক্রোধাবেগ সংবরণপূর্ব্বক নিষ্ক্রান্ত হইতে হইতে অৰ্দ্ধকায়া পরিবর্তিত করিয়াও দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন “রে মূঢ়! আমি তোমাদিগকে সবংশে নিহত করিয়াছি মনে করিয়া ইহার প্রত্যুত্তর দিতেছি, তুমি এ সকল কাৰ্য্য দ্বারা আমাদিগের কিছুমাত্ৰ করিতে পরিবে না। আমি এই সভামধ্যে পুনরায় মুক্তকণ্ঠে কহিতেছি, যদি আমাদের যুদ্ধঘটনা হয়, তাহা হইলে দেবতারা ইহা অবশ্যই সফল করিবেন। আমি দুৰ্য্যোধনকে নিহত করিব এবং ধনঞ্জয় কর্ণকে ও সহদেব অক্ষশঠ [কপট পাশক ক্রীড়াকারী] শকুনিকে বিনষ্ট করিবে, আর আমিই গদাযুদ্ধে এই পাপাত্মা দুৰ্য্যোধনকে সংহার করিব, ইহার আপাদমস্তক ভূমিতলে অধিশায়িত করিব এবং সিংহের ন্যায় আমি এই উপহাস্যরসিক নিষ্ঠুর দুরাত্মা দুঃশাসনের রক্তপান করিব।”
অর্জ্জুন কহিলেন, “হে ভীম! সাধু লোকের অধ্যবসায় বাক্য দ্বারা সম্যক অবগত হওয়া যায় না, ত্ৰয়োদশ বর্ষ অতীত হইলে যাহা হইবে, উহারা তাহা দেখিতেই পাইবে।” ভীমসেন কহিলেন “পৃথিবী দুৰ্য্যোধন ও দুঃশাসন, কর্ণ ও শকুনি এই দুষ্ট-চতুষ্টয়ের শোণিত পান করিবেন।” অর্জ্জুন কহিলেন, “হে ভীমসেন! তোমার বিয়োগানুসারে আমি হিংসাদ্বেষ-পরবশ, বক্তা, আত্মশ্লাঘাপরায়ণ কর্ণকে রণস্থলে সংহার করিব। এক্ষণে আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, ভীমসেনের প্রিয়ানুষ্ঠান করিবার নিমিত্ত আমি শর দ্বারা কর্ণ ও কর্ণের অনুগত লোকদিগকে রণস্থলে সংহার করিব। যে সরল রাজা বুদ্ধিমোহবশতঃ আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হইবে, আমি বাণ দ্বারা তাহাদিগকে যমালয়ে প্রেরণ করিব। যদি হিমাচল বিচলিত হয়, সূৰ্য্য নিষ্প্রভ হন, চন্দ্রের শৈত্যগুণ অপগত হয়, তথাচ আমার প্রতিজ্ঞা অন্যথা হইবার নহে। ত্রয়োদশ বর্ষ অতীত হইলে দুৰ্যোধন আমাদিগকে সৎকার করিয়া যদি রাজ্য প্রত্যপণ না করে, তাহা হইলে সত্যই এই সমস্ত ঘটিবে।”
অর্জ্জুন এই কথা কহিলে মাদ্রীতনয় সহদেব সৌবলের বধসাধন করিতে ইচ্ছা করিয়া ক্ৰোধাভরে দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক কহিলেন, “রে সৌবল! তুই এই সকলকে অক্ষ বলিয়া বিবেচনা করিতেছিস, ফলতঃ ইহা অক্ষ নহে, নিশিত বাণ, রণস্থলে তুই এই সমস্তকে বরণ করিয়াছিস। ভীম তোকে ও তোর বন্ধুবান্ধবদিগকে উদ্দেশ করিয়া যাহা কহিলেন, আমি সেই সমস্ত কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিব। রে ক্রূর! যদি তুই ক্ষাত্রধর্ম্মানুসারে যুদ্ধে থাকিস তাহা হইলে আমি তোকে ও তোর বন্ধুবান্ধবদিগকে বলপূর্ব্বক হনন করিব।”
অনন্তর সহদেবের বাক্য শ্রবণ করিয়া নকুল কহিলেন, “যে ধৃতরাষ্ট্ৰপুত্রেরা দুৰ্য্যোধনের প্রিয়ানুষ্ঠান করিবার নিমিত্ত দূতক্ৰীড়াপ্রসঙ্গে দ্ৰৌপদীর প্রতি অতি কঠোর বাক্য প্রয়োগ করিয়াছে, আমি প্রতিজ্ঞা করিলাম, মুমূর্ষুকালপ্রেরিত ঐ সকল দুর্ব্বত্তদিগকে যমালয়ে প্রেরণ করিব। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের আদেশানুসারে অচিরকাল মধ্যে পৃথিবীকে ধাৰ্তরাষ্ট্রশূন্য করিব।”
এইরূপে পাণ্ডবেরা বহুতর প্রতিজ্ঞা করিয়া ধৃতরাষ্ট্রসন্নিধানে গমন করিলেন।