৭২তম অধ্যায়
যজ্ঞায়োজন—দিগ্বিজয়ে অর্জ্জুনের নির্ব্বাচন
ভগবান্ বাসুদেব এই কথা কহিলে, রাজা যুধিষ্ঠির বেদব্যাসকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহর্ষে! এক্ষণে আপনি অশ্বমেধযজ্ঞের প্রকৃত কাল বিবেচনা করিয়া আমাকে যজ্ঞে দীক্ষিত করুন। আমার যজ্ঞ আপনারই আয়ত্ত।”
বেদব্যাস কহিলেন, “রাজন! যে সময়ে যে কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে হইবে, পৈল, যাজ্ঞবল্ক্য ও আমি, আমরা তিন জনে নিশ্চয়ই তাহা সম্পাদন করিব। চৈত্র-পৌর্ণমাসীতে তোমায় যজ্ঞ আরম্ভ করিতে হইবে। অতএব তুমি এক্ষণে যজ্ঞীয় সামগ্রীসমুদয় আহরণ এবং অশ্ববিদ্যাবিশারদ সারথি ও ব্রাহ্মণগণকে যজ্ঞীয় অশ্ব পরীক্ষা করিতে আদেশ কর। ঐ অশ্ব শাস্ত্রানুসারে উন্মুক্ত হইয়া সসাগরা পৃথিবী পরিভ্রমণপূৰ্ব্বক তোমার প্রদীপ্ত যশঃশশাঙ্কের জ্যোতি বিস্তার করিয়া প্রত্যাগমন করিবে।”
মহর্ষি বেদব্যাস এই কথা কহিলে, রাজা যুধিষ্ঠির তাঁহার আদেশানুসারে সমুদয় কাৰ্য্য করিতে লাগিলেন। ক্রমে ক্রমে সমুদয় যজ্ঞীয় সামগ্রী সমাহৃত হইলে, তিনি বেদব্যাসকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! যজ্ঞীয় উপকরণসমুদয় প্রস্তুত হইয়াছে।” তখন মহর্ষি কহিলেন, “আমরাও যথাকালে তোমাকে যজ্ঞে দীক্ষিত করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত রহিয়াছি। এক্ষণে ঐ যজ্ঞে কুর্চ্চ [যজ্ঞীয় কুশ-কাশ প্রভৃতি] প্রভৃতি আর আর যে সমুদয় দ্রব্যের আবশ্যক হইবে, তুমি তৎসমুদয় সুবর্ণ দ্বারা নির্ম্মাণ করাও। অদ্যই তোমাকে শাস্ত্রানুসারে যজ্ঞীয় অশ্ব উন্মুক্ত করিতে হইবে। ঐ অশ্ব যেন সুরক্ষিত হইয়া পৃথিবী পর্য্যটন করে।”
তখন যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভগবন্! সেই অশ্বকে কিরূপে উন্মুক্ত করিতে হইবে এবং তুরঙ্গম পৃথিবী পৰ্য্যটন করিতে আরম্ভ করিলে কে তাহাকে রক্ষা করিবে, আপনি তদ্বিষয়ে আদেশ করুন।”
ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এই কথা কহিলে, মহর্ষি বেদব্যাস তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “রাজন্! ভীমসেনের কনিষ্ঠ, ধনুর্দ্ধরাগ্রগণ্য, আজানুলম্বিতবাহু, অভিমন্যুর পিতা, নিবাতকবচান্তক, মহাবীর অৰ্জ্জুনই ঐ অশ্বকে রক্ষা করিবেন। তিনি অনায়াসে সসাগরা পৃথিবী পরাজয় করিতে পারেন। তাঁহার নিকট দিব্য অস্ত্রশস্ত্র, দিব্যশরাসন ও দিব্যতূণীর বিদ্যমান আছে। তিনি ধার্ম্মিক ও সৰ্ব্বশাস্ত্ৰপারদর্শী; অতএব তাঁহারই উপর এই গুরুভার সমর্পণ করা কর্ত্তব্য। ভীমসেন ও নকুল ইঁহারাও পরম তেজস্বী ও অমিত পরাক্রমশালী; অতএব ঐ বীরদ্বয় রাজ্য প্রতিপালন করুন এবং সহদেব কুটুম্বগণের তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত হউন।”
মহাত্মা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন এই কথা কহিলে মহারাজ যুধিষ্ঠির অৰ্জ্জুনকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভ্রাতঃ! তুমি এই-যজ্ঞীয় অশ্বের প্রতিপালনে নিযুক্ত হও। তুমি ভিন্ন আর কেহই এই অশ্বরক্ষায় সমর্থ নহে। যে যে ভূপতি তোমার সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত আগমন করিবেন, তুমি সাধ্যানুসারে তাঁহাদিগের সহিত বিবাদ না করিবার চেষ্টা এবং তাঁহাদিগের নিকট আমার এই যজ্ঞের বিষয় কীৰ্ত্তন করিও। অতঃপর তুমি নির্দ্দিষ্ট সময়ে অশ্ব লইয়া গমন কর।”
রাজা যুধিষ্ঠির ধনঞ্জয়কে এইরূপ আদেশ করিয়া ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি গ্রহণপূৰ্ব্বক ভীমসেন ও নকুলের প্রতি রাজ্যভার এবং সহদেবের প্রতি কুটুম্বদিগের তত্ত্বাবধানের ভার সমর্পণ করিলেন।