৭২. অনুদ্যূত-পর্ব্বাধ্যায়

অনুদ্যূত-পর্ব্বাধ্যায়

জনমেজয় কহিলেন, হে তপোধন! ধনরত্ন-সমন্বিত পাণ্ডবগণ ধৃতরাষ্ট্র কর্তৃক অনুজ্ঞাত হইয়াছেন, ইহা অবগত হইয়া তৎপুত্ৰ দুৰ্য্যোধনাদির মন কিরূপ হইল? বৈশম্পায়ন প্রত্যুত্তর করিলেন, মহারাজ! দুঃশাসন ধীমান ধৃতরাষ্ট্র কর্তৃক পাণ্ডবেরা অনুজ্ঞাত হইয়াছেন, ইহা অবগত হইয়া অনতিবিলম্বে নিজ সহোদর সমন্ত্রী দুৰ্য্যোধনের নিকট উপস্থিত হইয়া দুঃখিত মনে কহিলেন, “হে মহারথ! আমরা অতীব ক্লেশে যে সমস্ত দ্রব্য সঞ্চয় করিয়াছি, বৃদ্ধ রাজা তৎসমুদয় নষ্ট করিতেছেন, অধিকাংশ শত্রুদিগেরও হস্তগত হইয়াছে, এক্ষণে ভাল মন্দ যাহা হয়, তোমরা বিবেচনা কর।”

কৌরবগণের পুনঃ দূতমন্ত্রণা

এই কথা কৰ্ণগোচর করিয়া দুৰ্য্যোধন, কর্ণ ও শকুনি পাণ্ডবদিগের উপর একান্ত অভিমানপরতন্ত্র হইয়া দ্রুতগমনে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রসন্নিধানে উপনীত হইলেন এবং বিনীতবাক্যে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! দেবপুরোহিত বৃহস্পতি ত্ৰিদশাধিপতি ইন্দ্ৰকে হিতোপদেশ-প্ৰদানকালে যে কথা কহিয়াছিলেন, বোধ হয়, আপনি তাহা অবগত নহেন। হে শত্রুনিসূদন! সমস্ত উপায় দ্বারা শত্ৰু সংহার করা অতীব কর্তব্য। তাহারা যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগপূর্ব্বক আপনার অনিষ্ট চেষ্টা করিতেছে, অতএব যদি এক্ষণে আমরা পাণ্ডবলব্ধ ধন দ্বারা প্ৰীতিসম্পাদন করিয়া মহীপালগণকে যুদ্ধে প্রবর্তিত করি, তাহা হইলে আমাদিগের হানি কি? দেখুন, প্ৰাণসংহারোদ্যত ক্ৰোধান্বিত ভুজঙ্গদিগকে কণ্ঠ ও পৃষ্ঠদেশে রাখিয়া কে পরিত্ৰাণ পাইতে পারে? পাণ্ডবেরা অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ ও রথারোহণপূর্ব্বক ক্রোধান্ধ ভুজঙ্গের ন্যায় আপনার বংশনাশ করিতে উদ্যত হইয়াছে। শুনিলাম, অর্জ্জুন তৃণীর ও বর্ম্ম গ্রহণপূর্ব্বক রণস্থলে গমন করিতেছে এবং গাণ্ডীবা ধারণ করিয়া বারংবার দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক ইতস্ততঃ দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতেছে। ভীম অবিলম্বে রথ যোজনা করিয়া গুর্বী গদা উদ্যত করিয়া যুদ্ধাৰ্থ দ্রুতপদে নিৰ্গত হইয়াছে। যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেব ইহারা খড়্গ ও অৰ্দ্ধচন্দ্ৰাকার চর্ম্ম গ্ৰহণ করিয়া ইঙ্গিত করিতেছে। ইহারা সকলেই অস্ত্রশস্ত্ৰ গ্ৰহণ করিয়া হস্তী অশ্ব সংহারপূর্ব্বক সৈন্য আক্রমণের নিমিত্ত নিৰ্গত হইয়াছে। আমরা তাহাদিগের একবার অপকার করিয়াছি, আর তাহারা আমাদিগকে ক্ষমা করিবে না। দ্রৌপদীর পরাভব-রূপ ক্লেশ কে সহ্য করিয়া থাকিবে? হে মহারাজ ! আমরা বনবাস পণ করিয়া পুনরায় পাণ্ডবদিগের সহিত পাশক্রীড়া করিব। আপনার মঙ্গল হউক, এইবারেই আমরা পাণ্ডবদিগকে নিরুত্তর করিয়া রাখিব। তাহারা বা আমরাই হই, দ্যূতিনিজ্জিত হইলে বল্কলাজিন পরিধানপূর্ব্বক দ্বাদশ বৎসরের নিমিত্ত বন্যপ্রবেশ করিব। এক বৎসর অজ্ঞাত ও দ্বাদশ বৎসর জ্ঞাত এই ত্ৰয়োদশ বৎসর তাহারা বা আমরাই হই, পরিজনগণ-সমভিব্যাহারে অরণ্যে বাস করিব, অতএব আপনি দ্যূতে অনুমতি প্ৰদান করুন। পাণ্ডবদিগকে অক্ষনিক্ষেপপূর্ব্বক পুনর্ব্বার দ্যূতক্ৰীড়া করিতে হইবে। ফলতঃ এক্ষণে দ্যূতক্ৰীড়াই আমাদিগের একমাত্র কর্তব্য। শকুনি অক্ষাবিদ্যায় বিলক্ষণ দক্ষতা লাভ করিয়াছেন, হে মহারাজ! আমরা মিত্ৰ সংগ্ৰহ করিয়া পরমদূর্লভ মহাবল বাহিনীগণকে সৎকার করিয়া রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছি। এক্ষণে যদি পাণ্ডবেরা ত্ৰয়োদশ বৎসর ব্রতসাধন করিতে পারে, তাহা হইলে আপনার ইচ্ছানুসারে তাহাদিগকে পরাজয় করিতে পারিব।”

ধৃতরাষ্ট্রের অনুমোদন-যুধিষ্ঠিরাহ্বান

ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “বৎস! তুমি অবিলম্বে পাণ্ডবদিগকে আনয়ন কর, তাহারা আসিয়া পুনরায় দ্যূতক্ৰীড়ায় প্রবৃত্ত হউক।” এই কথা কহিবামাত্ৰ দ্রোণ, সোমদত্ত, বাহ্লীক, বিদুর, দ্রোণপুত্ৰ অশ্বত্থামা, বৈশ্যাপুত্র যুযুৎসু, ভূরিশ্রবাঃ, শান্তনুনন্দন ভীষ্ম ও বিকৰ্ণ প্রভৃতি সভাস্থগণ ধৃতরাষ্ট্রকে নিষেধ করিয়া কহিলেন, “মহারাজ। সর্ব্বত্র শান্তিসঞ্চার হউক।” তখন পুত্রবৎসল মহারাজা ধৃতরাষ্ট্র অর্থদশীর্ সুহৃদবৰ্গকেও অনাদর করিয়া পাণ্ডবদিগকে আহ্বান করিলেন।