যুধিষ্ঠির কর্তৃক ক্রুদ্ধ ভীমের সান্ত্বনা
কৰ্ণ কহিলেন, “আমরা যে-সকল অসামান্যরূপবর্তী কামিনীগণের কথা শ্রবণ করিয়াছি, তন্মধ্যে কোন স্ত্রীলোকের এতাদৃশ কর্ম্ম শ্রুতিগোচর হয় নাই। পাণ্ডব ও কৌরবগণ সকলেই সমধিক ক্ৰোধপরতন্ত্র হইয়াছিলেন, এক্ষণে দ্রৌপদী কুন্তীগণের শান্তিস্বরূপ হইলেন। পাণ্ডবগণ দুস্তর জলপ্লাবনে নিমগ্ন হইতেছিলেন, পাঞ্চালী তরণী হইয়া তাহাদিগকে পার করিয়া দিলেন।’
অসহিষ্ণু ভীমসেন কর্ণের বাক্য শ্রবণে দুর্ম্মনায়মান হইয়া কহিলেন, “হাঁ! স্ত্রী পাণ্ডবগণের গতি হইল!” এই কহিয়া ধনঞ্জয়াকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে ধনঞ্জয়! দেবল কহিয়াছেন যে পুরুষ গত প্ৰাণ, অপবিত্র এবং জ্ঞাতিগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হইলে অপত্য, কর্ম্ম ও বিদ্যা এই ত্ৰিতয় জ্যোতিঃ তাহার সাহায্য করে। এক্ষণে আমাদের ধর্ম্মপত্নী দ্রৌপদী দুঃশাসন কর্তৃক অভিমৃষ্টি [বলপূর্ব্বক আকৰ্ষিত] হওয়াতে এই অভিমৃষ্টিজ সন্তান কি প্রকারে জ্যোতিঃস্থানীয় হইবে, অতএব আমাদের প্রথম জ্যোতিঃ বিনষ্ট হইল।
অর্জ্জুন কহিলেন, “হীন ব্যক্তি পুরুষবাক্য বলুক আর নাই বালুক, উত্তম পুরুষেরা তাহা লইয়া জল্পনা করেন না। তাঁহারা কেবল সৎকাৰ্য্যেরই স্মরণ করেন; কেহ বৈরাচরণ করিলেও তাহারা তাহা স্মৃতিপথে উদিত হইতে দেন না।”
ভীম অর্জ্জুনের বাক্যাবসানে যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে রাজেন্দ্ৰ! আমাদিগের যে-সকল শত্রু এখানে সমাগত হইয়াছে, তাহাদিগের এই সভাতেই কিংবা এস্থান হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া সমূলে উন্মলিত করিব অথবা বিবাদ বা বাগবিতণ্ডায় আর প্রয়োজন কি? অদ্য এই সভাতেই সমুদয় শত্রুকে শমনের হস্তে সমর্পণ করি, আপনি এই পৃথিবী প্রশাসন করুন।” ভীমসেন এই কথা কহিয়া কনিষ্ঠ ভ্রাতৃগণের সহিত মৃগসমাজবিরাজিত মৃগরাজের ন্যায় মুহুর্মুহুঃ ঊৰ্দ্ধাদিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। অক্লিষ্টকর্ম্মা পার্থ তাহাকে দর্শন করিয়া সান্ত্বনা করিলে, তিনি অন্তর্দাহে দগ্ধ হইয়া উঠিলেন, রোষবশে তাহার শ্রোত্ৰাদি দেহরন্ধ্র হইতে সুমস্ফুলিঙ্গ ও শিখাসহিত হুতাশন বিনির্গত হইতে লাগিল, তাহার মুখমণ্ডল ভ্রূকুটি-ভয়ঙ্কর হইয়া যুগান্তরকালীন কৃতান্তের ন্যায় রূপ ধারণ করিল।
যুধিষ্ঠির ভীমবাহু ভীমসেনকে ‘নিবৃত্ত হও’ বলিয়া নিবারণ করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে ধৃতরাষ্ট্রকে কহিতে লাগিলেন।