৬৯তম অধ্যায়
পিতৃপ্রশ্নে উত্তরের দেবপুত্রকৃত সমর-কথন
উত্তর কহিলেন, “হে তাত! আমি স্বয়ং সেই সকল বিপক্ষকে পরাজয় করিয়া গোধন প্রত্যাহরণ করি নাই; এক দেবপুত্র ঐ সমুদয় কাৰ্য্য নির্ব্বাহ করিয়াছেন। আমি ভীত হইয়া পলায়ন করিতেছিলাম, তিনি আমাকে নিবারণপূর্ব্বক স্বয়ং রথে অধিষ্ঠান করিয়া কুরুগণকে পরাজয় ও গোধন প্রত্যাহরণ করিলেন। তিনি একাকী শর-সমূহ নিক্ষেপ করিয়া কৃপ, দ্রোণ, অশ্বত্থামা প্রভৃতি ছয়জন রথীকে সমরপরাঙ্মুখ করিয়াছিলেন। তদর্শনে দুৰ্য্যোধন ও বিকৰ্ণ ভয়ে পলায়ন করিতে উদ্যত হইলে, সেই দেবকুমার দুৰ্য্যোধনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “কুরুরাজ! কোথায় পলায়ন করিতেছ? হস্তিনানগরে গমন করিলেও তোমার নিস্তার নাই। এক্ষণে স্বীয় বলবীৰ্য্য প্রকাশ্যপূর্ব্বক সংগ্রাম করিয়া জীবনরক্ষার চেষ্টা কর; তুমি পলায়ন করিলেও কোনক্রমে পরিত্ৰাণ পাইবে না। অতএব আজি যুদ্ধ করিতে প্ৰবৃত্ত হও; যদি তাহাতে জয়লাভ কর, তবে সমুদয় মেদিনীমণ্ডলে একাধিপত্য সংস্থাপন করিবে; আর যদি নিহত হও, তাহা হইলেও পরলোকে স্বর্গলাভ করিতে পরিবে সন্দেহ নাই।”
মানধন [অতিমানী] দুৰ্য্যোধন দেবপুত্রের এইরূপ বাক্য-শ্রবণে ক্ৰোধে অধীর হইয়া সচিবগণ-সমভিব্যাহারে অশনিসদৃশ শরনিকর নিক্ষেপ করিয়া প্রতিনিবৃত্ত হইলেন। তখন ক্রুদ্ধ ভুজঙ্গমের ন্যায় দুৰ্য্যোধনের অতি ভীষণ মূর্ত্তি-সন্দর্শনে আমার রোমহর্ষ ও উরুকম্প [অত্যন্ত কম্পন] হইতে লাগিল। কিন্তু সিংহসদৃশ দেবকুমার একাকী ছয় জন রথীকে পরাজয় করিলেন; পরিশেষে অসংখ্য শরনিকরপ্রহার দ্বারা সমুদয় কুরুগণ ও তাহাদিগের সৈন্যসমূহকে জয় করিয়া কৌরবগণের বসন অপহরণপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে উপহাস করিতে লাগিলেন। অধিক কি, যেমন রোষাভিভূত শার্দ্দুল অনায়াসে বনচর মৃগগণকে বশীভূত করে, তদ্রূপ সেই মহাবলপরাক্রান্ত দেবকুমার অতি অল্পকাল মধ্যেই সসৈন্য কৌরবগণকে পরাজয় করিলেন।”
বিরাট উত্তরের বাক্য শ্রবণানন্তর কহিলেন, “বৎস! যে দেবপুত্ৰ কৌরবগণের নিকট হইতে আমার গোধন ও তোমাকে রক্ষা করিয়াছিলেন, তিনি কোথায়? আমি তাঁহাকে দর্শন ও অর্চনা করিতে অভিলাষী হইয়াছি।”
উত্তর কহিলেন, “হে তাত! তিনি এক্ষণে অন্তর্হিত হইয়াছেন, কল্য হউক বা পরশ্বই হউক, পুনরায় আবির্ভূত হইবেন।” তখন মৎস্যরাজ প্রচ্ছন্নবেশী মহাবীর অর্জ্জুনের বৃত্তান্ত অবগত হইতে পারিলেন না।
অনন্তর মহাবীর অ্জুন বিরাটরাজের আদেশানুসারে স্বয়ং উত্তরার সমীপে গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে সেই অপহৃত বস্ত্ৰসমুদয় প্রদান করিলেন। রাজপুত্রী মহামূল্য বিবিধ বসন প্রাপ্ত হইয়া পরম পরিতুষ্ট হইলেন। পরে ধনঞ্জয় বিরাটপুত্রের সহিত মন্ত্রণা করিয়া ইতিকর্ত্তব্যতা অবধারণপূর্ব্বক ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সমীপে নিবেদন করিলেন, পরিশেষে পঞ্চভ্রাতা একত্ৰ মিলিত হইয়া উত্তরের সহিত হৃষ্ট-মনে মন্ত্রিত্ব বিষয়ের অনুষ্ঠানে প্ৰবৃত্ত হইলেন।
গোহরণপৰ্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত