৬৯তম অধ্যায়
কৃষ্ণকর্ত্তৃক পরীক্ষিতের প্রাণদান
বৈশম্পায়ন বলিলেন, পুত্রশোকাকুলা উত্তরা এইরূপে উন্মত্তার ন্যায় করুণস্বরে বিলাপ করিতে করিতে ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তখন তত্ৰত্য যাবতীয় কৌরবরমণী তাঁহাকে শোকসন্তপ্ত ও মূর্চ্চিত দেখিয়া হাহাকার করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবদিগের সমুদয় গৃহ একেবারে আর্ত্তনাদে পরিপূর্ণ হইল। কিয়ৎক্ষণ পরে বিরাটকুমারী উত্তরা পুনরায় সংজ্ঞালাভপূৰ্ব্বক গাত্রোত্থান করিয়া মৃতপুত্রকে ক্রোড়ে লইয়া কহিলেন, “বৎস! তুমি ধৰ্ম্মপরায়ণ মহাত্মা অভিমন্যুর পুত্র। তোমাতে ত’ অধর্ম্মের লেশমাত্র নাই! তবে আজ তুমি কি নিমিত্ত ভগবান্ বাসুদেবকে দর্শন করিয়াও ইহাকে অভিবাদন করিতেছ না? এক্ষণে তুমি তোমার পিতার নিকট সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিবে, পিতঃ! কাল পরিপূর্ণ না হইলে কাহারও মৃত্যু হইবার সম্ভাবনা নাই, এই জন্য আমার জননী উত্তরা মৃত্যুকে প্রার্থনীয় জ্ঞান করিয়াও আপনার বিরহে নিতান্ত কাতর হইয়া শোকাকুলিতচিত্তে দীনভাবে জীবনধারণ করিতেছেন। অথবা তোমার কথা কহিবারও প্রয়োজন নাই। আজ আমি ধৰ্ম্মরাজের অনুজ্ঞা গ্রহণপূৰ্ব্বক বিষভোজন বা হুতাশনে প্রবেশ করিয়া প্রাণপরিত্যাগ করিব।
“হায়! আমার হৃদয় কি কঠিন! এক্ষণে পতি ও পুত্র উভয়ের বিরহেও উহা সহস্ৰধা বিদীর্ণ হইতেছে না। হা পুত্র! তুমি একবার গাত্রোত্থান কর। তোমার প্রপিতামহী কুন্তী, পিতামহী পাঞ্চালী ও সুভদ্রা এবং জননী আমি, আমরা সকলেই তোমার শোকে ব্যাধবিদ্ধ হরিণীর ন্যায় নিতান্ত কাতর হইয়াছি। ঐ তোমার পিতামহ সখা ভগবান্ বাসুদেব তোমার সম্মুখে সমুপস্থিত রহিয়াছেন, তুমি গাত্রোত্থান করিয়া উহার মুখকমল দর্শন কর।” বিরাটকুমারী উত্তরা এইরূপ বিলাপ করিয়া পুনৰ্ব্বার ধরাতলে নিপতিত হইলে কৌরববনিতারা তাঁহাকে উত্থাপিত করিলেন। তখন উত্তরা ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূৰ্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে ভূমিষ্ঠ হইয়া বারংবার বাসুদেবকে প্রণিপাত করিতে লাগিলেন।
বিরাটতনয়া এইরূপে বহুক্ষণ বিলাপ করিলে মহাত্মা বাসুদেব কৃপাপরতন্ত্র হইয়া আচমনপূর্ব্বক সেই দ্রোণপুত্রনিক্ষিপ্ত ব্রহ্মাস্ত্র প্রতিসংহার করিয়া উচ্চৈঃস্বরে উত্তরাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “বৎসে! আমাকে মিথ্যাবাদী জ্ঞান করিও না। আমি যাহা প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, তাহা কখনই মিথ্যা হইবার নহে। এই দেখ, আমি সৰ্ব্বসমক্ষে তোমার পুত্রকে পুনরুজ্জীবিত করিতেছি।”
ভগবান্ বাসুদেব উত্তরাকে এই কথা কহিয়া সৰ্ব্বসমক্ষে পুনৰ্ব্বার কহিতে লাগিলেন যে, “আমি কদাপি যুদ্ধ হইতে প্রতিনিবৃত্ত হই নাই, সত্য ও ধৰ্ম্ম আমাতে নিত্য প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে; আমি ধৰ্ম্ম ও ব্রাহ্মণের প্রতি সতত ভক্তি প্রদর্শন করিয়া থাকি, প্রিয়সুহৃৎ অর্জ্জুনের সহিত আমার কদাপি বিরোধ হয় নাই এবং আমি ধৰ্ম্মানুসারে কংস ও কেশীকে নিপাতিত করিয়াছি; অতএব আমার সেই সমুদয় পুণ্যবলে এই অভিমন্যুর মৃতপুত্র অচিরাৎ জীবনলাভ করুক।” মহাত্মা বাসুদেব এই কথা কহিবামাত্র সেই উত্তরাগৰ্ভসম্ভূত বালক সচেতন হইয়া স্পন্দিত হইতে লাগিল।