দ্ৰৌপদীর দুঃখে যুধিষ্ঠিরের প্রতি ভীমের ক্ৰোধ
ভীমসেন কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! দ্যূতিপ্রিয় ব্যক্তিরা স্বগৃহস্থিত বেশ্যাগণকেও পণ রাখিয়া ক্রীড়া করে না; তাহারা তাহাদের প্রতিও কিঞ্চিৎ দয়া প্ৰকাশ করিয়া থাকে। দেখ, কাশীশ্বর ও অন্যান্য ভূপালগণ যে সমুদয় ধন, উত্তমোত্তম দ্রব্যজাত ও রত্নসমূহ উপহার দিয়াছিলেন, তৎসমুদয়, রাজ্য, বাহন, কবচ ও আয়ুধ-সকল এবং তোমাকে ও আমাদিগকে শত্ৰুগণ দ্যূতে পরাজয় করিয়াছে; কিন্তু তুমি আমাদের সকলের অধীশ্বর বলিয়া আমি তাহাতেও ক্ৰোধ করি নাই। এক্ষণে দ্রৌপদীকে পণ রাখিয়া ক্রীড়া করা আমার মতে তোমার নিতান্ত অন্যায় হইয়াছে। দেখ, দুরাত্মা ক্ষুদ্রাশয় কৌরবগণ কেবল তোমার দোষেই পাণ্ডবপ্রণয়িনী বালা দ্রৌপদীকে ক্লেশ দিতেছে। আমি এই নিমিত্ত তোমার প্রতি ক্ৰোধান্বিত হইয়াছি; আদ্য তোমার বাহুদ্বয় ভস্মসাৎ করিব। সহদেব! ত্বরায় অগ্নি আনয়ন কর।”
তখন অর্জ্জুন কহিলেন, “হে ভীমসেন! তুমি পূর্ব্বে কখনও ঈদৃশ দুর্ব্বাক্য প্রয়োগ কর নাই। স্পষ্টই বোধ হইতেছে, শত্ৰুগণ তোমার ধর্ম্ম-গৌরব বিনষ্ট করিয়াছে। হে বৃকোদর! শক্রগণের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিও না; ধর্ম্মাচরণ কর। ধাৰ্মিক জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে অপমান করিও না। দেখ, মহারাজ শত্রুগণ কর্তৃক দ্যূতে আহূত হইয়া ক্ষত্ৰিয়ধর্ম্মানুসারে তাঁহাদের অভিলাষানুরূপ ক্রীড়া করিয়াছেন; ইহা আমাদের মহান যশস্কর।” ভীমসেন কহিলেন, “হে ধনঞ্জয়! ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির ক্ষত্রধর্ম্মানুসারে কাৰ্য্য করিয়াছেন বলিয়াই এতাবৎকাল উঁহার বাহুদ্বয় ভস্ম করি নাই।”
দ্রৌপদীপণের বৈধতা বিষয়ে বিকর্ণের প্রশ্ন
ধৃতরাষ্ট্ৰনন্দন বিকৰ্ণ পাণ্ডবগণকে দুঃখিত এবং দ্রুপদনন্দিনীকে কাতরা দেখিয়া সভাসীন ভূপতিগণকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে পার্থিবগণ! যাজ্ঞসেনী যাহা কহিয়াছেন, তোমরা সকলে তাহার বিষয় বিশেষ বিবেচনা করিয়া বল, যথার্থ বিচার না করিলে আমাদিগকে নিরয়গামী হইতে হইবে। কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র ও মহামতি বিদুর, ইহারা আসিয়া এ-বিষয়ে কিছু বলুন। সকলের আচাৰ্য্য দ্রোণ ও কৃপ, ইহারা কোন কথা কহিতেছেন না কেন? আর যে-সকল ভূপাল চতুর্দিকে বসিয়া আছেন, তাহারাও কাম-ক্ৰোধ পরিত্যাগপূর্ব্বক যথামতি বলুন; দ্রৌপদী পুনঃ পুনঃ যাহা কহিয়াছেন, তাহার কোন পক্ষ কাহার অভিপ্রেত, বিবেচনা করিয়া বলুন।” এইরূপে মহাত্মা বিকৰ্ণ যখন দেখিলেন যে, তিনি সভাসদ্বর্গকে যাহার নিমিত্ত বারংবার অনুরোধ করিলেন, তাহাতে কোন ব্যক্তিই সাধু কি অসাধু কিছুই কহিলেন না, তখন তিনি হস্তে হস্ত নিম্পেষণ করিয়া নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিতে করিতে কহিতে লাগিলেন, “এক্ষণে মহীপালেরা বলুন আর নাই বলুন, আমি যাহা ন্যায্য বলিয়া জানি, তাহা অবশ্যই কহিব। মহাপুরুষেরা কহিয়া থাকেন যে, রাজাদিগের ব্যাসন চতুর্বিধ; প্রথম মৃগয়া, দ্বিতীয় সুরাপান, তৃতীয় দুরোদর, চতুর্থ অভব্য [দুর্ঘটনীয়—যাহা সহজে সাধিত হয় না] বিষয়ে অত্যনুরাগ। মনুষ্যেরা এই সকল বিষয়ে অনুরক্ত হইলে ধর্ম্ম হইতে দূরীভূত হয়েন; লোকে তাদৃশ ব্যসনাসক্ত পুরুষের কাৰ্য্য অপ্ৰমাণিক বলিয়া জানেন। কিতবাহূত যুধিষ্ঠির ব্যসনাসক্ত হইয়া দ্রৌপদীকে পণ রাখিয়াছেন, বিশেষতঃ এই অনিন্দিতা রমণী পাণ্ডবগণের সাধারণী ভাৰ্য্যা, অধিকন্তু যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে পণ রাখিবার পূর্ব্বে স্বয়ং পরাজিত হইয়া উহাতে স্বত্ববর্জিত হইয়াছেন। এদিকে শকুনি পণার্থী হইয়া কৃষ্ণের নামোল্লেখ করিতেছেন; এই সকল বিচার করিয়া দেখিলে দ্রৌপদীকে জয়লব্ধ বলিয়া স্বীকার করিতে পারি না।” সভ্যগণ এই কথা শ্রবণমাত্র অতিমাত্ৰ সঙ্কুলরবে [সমস্বরে—একবাক্যে] বিকর্ণের প্রশংসা ও শকুনির নিন্দা করিতে লাগিল।
কৃষ্ণা সম্বন্ধে কর্ণের উক্তি
সেই তুমুল নিনাদ কিছু পরে নিস্তব্ধ হইলে রাধেয় ক্ৰোধপরতন্ত্র হইয়া বিকর্ণের বাহু গ্রহণপূর্ব্বক কহিতে লাগিল, “হে বিকর্ণ! এই সভায় বহুবিধ বিকৃতি দৃষ্ট হইতেছে বটে, কিন্তু অরণি হইতে অগ্নির উৎপত্তির ন্যায় ঐ-সকল যাহা হইতে জন্মিতেছে, তাহাকেই বিনাশ করিবার নিমিত্ত। এই সকল ভূপালেরা দ্রৌপদীর প্রবর্তনাপরতন্ত্র হইয়াও যে কিছু কহিতেছেন না, তাহার কারণ এই যে, ইহারা পাঞ্চালীকে ধর্ম্মতঃ জয়লব্ধ বলিয়াই জানেন। তুমিই কেবল বালস্বভাবসুলভ অসহিষ্ণুতায় অধৈৰ্য্য হইয়া সভামধ্যে স্থবিরোচিত বাক্য প্রয়োগ করিতেছ। তুমি দুৰ্য্যোধনের কনিষ্ঠ, সর্ব্ববিষয়ে যথাবৎ অভিজ্ঞও হও নাই, তজন্যই জয়লব্ধ দ্রৌপদীকে অজিত বলিয়া প্ৰতিপন্ন করিতেছ। যখন যুধিষ্ঠির সভামধ্যে সর্ব্বস্ব পণ করিলেন, আর দ্রৌপদী সেই সর্ব্বস্বের অন্তর্গত, তখন তুমি এই কৃষ্ণা জয়লব্ধ নহে, কি প্রকারে জানিলে? পাণ্ডবদিগের অনুজ্ঞাক্ৰমেই দ্রৌপদীর নাম উল্লেখ করা যাইতেছে, কি নিমিত্ত দ্রৌপদী তোমার মতে অজয়লব্ধ হইতেছে? অথবা একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে সভায় আনয়ন করা হইয়াছে, ইহাই কি অধর্ম্ম বলিয়া প্ৰতিপন্ন করিতেছ? এক্ষণে তাহার কারণও শ্রবণ কর। দেবতারা স্ত্রীলোকদিগের একমাত্র ভর্তাই বিধান করিয়াছেন, দ্রৌপদী সেই বিধি অতিক্রম করিয়া অনেক ভর্তার বশবর্তিনী হইয়াছেন, তখন ইনি বার স্ত্রী, তাঁহার সন্দেহ নাই; সুতরাং বেশ্যাকে সভামধ্যে আনয়ন বা বিবসনা করা আশ্চর্যের বিষয় নহে। দ্রৌপদী ও পাণ্ডবগণের যাহা কিছু আছে, শকুনি সে সমুদয়ই ধর্ম্মতঃ জয় করিয়াছেন; অতএব হে দুঃশাসন! বিকর্ণ অতি বালক, তুমি পাণ্ডবগণের ও দ্রৌপদীর সমুদয় গ্রহণ কর।” কর্ণের কথা শ্রবণমাত্ৰ পাণ্ডবগণ আপনাদিগের উত্তরীয়বস্ত্রগুলি প্ৰদান করিয়া সভামধ্যে উপবিষ্ট হইলেন।
বস্ত্রহরণে দ্ৰৌপদীর কৃষ্ণস্তব-কৃষ্ণ কর্তৃক দ্রৌপদীর লজ্জা নিবারণ
তদনন্তর দুঃশাসন সভামধ্যে বলপূর্ব্বক দ্রৌপদীর পরিধেয় বসন আকর্ষণ করিবার উপক্ৰম করিলে দ্রৌপদী এইরূপে শ্ৰীকৃষ্ণকে চিন্তা করিতে লাগিলেন, “হে গোবিন্দ! হে দ্বারকাবাসিন কৃষ্ণ! হে গোপীজনবল্লভ! কৌরবগণ আমাকে অবমানিত করিতেছে, তুমি কি তাহার কিছুই জানিতেছ না? হা নাথ! হা রমানাথ! হা ব্ৰজনাথ! হা দুঃখনাশিনী! আমি কৌরবসাগরে নিমগ্ন হইয়াছি, আমাকে উদ্ধার কর। হা জনার্দ্দন! হা কৃষ্ণ! হা মহাযোগিন! বিশ্বাত্মন! বিশ্বভাবন!! আমি কুরুমধ্যে অবসন্ন হইতেছি; হে গোবিন্দ! এই বিপন্ন জনকে পরিত্রাণ কর।” সেই দুঃখিনী ভামিনী এইরূপে ভুবনেশ্বর কৃষ্ণকে স্মরণ করিয়া অবনতমুখী হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। করুণাময় কেশব যাজ্ঞসেনীর করুণাবাক্য শ্রবণে শয্যাসন এবং প্ৰাণপ্ৰিয়তমা কমলাকে পরিত্যাগ করিয়া আগমন করিতে লাগিলেন। এদিকে মহাত্মা ধর্ম্ম অন্তরিত হইয়া নানাবিধ বস্ত্ৰে দ্রৌপদীকে আচ্ছাদিত করিলেন। দুরাত্মা দুঃশাসন দ্ৰৌপদীকে বিবসনা করিবার নিমিত্ত তাহার বস্ত্ৰ যত আকর্ষণ করে, ততই অনেক প্রকার বস্ত্ৰ প্ৰকাশিত হয়। ধর্মের কি অনির্ব্বচনীয় মহিমা! ধর্ম্মপ্ৰভাবে নানা রাগরঞ্জিত বসনসকল ক্ৰমে ক্রমে প্রাদুর্ভূত হইতে লাগিল। তদর্শনে সভামধ্যে ঘোরতর কলরব আরম্ভ হইল। মহীপালগণ দুঃশাসনকে ভৎসনা করিয়া দ্রুপদনন্দিনীর প্রশংসা করিতে লাগিলেন।
দুঃশাসন-শোণিতপানে ভীমের প্রতিজ্ঞা
ভীমসেন রাজগণমধ্যে উপবিষ্ট ছিলেন, তাঁহার ওষ্ঠ্যদ্বয় ক্রোধাভরে বিস্ফুরিত হইতে লাগিল; তিনি করে কর নিষ্পেষণপূর্ব্বক শাপ প্ৰদান করিয়া কহিলেন, “হে লোকবাসী ক্ষত্ৰিয়গণ! আমার কথা শ্ৰবণ করা। কেহ কখন এরূপ কহে নাই এবং কহিতে পরিবে না। যদ্যপি আমি এই যুদ্ধে বলপূর্ব্বক এই ভারতাধম পাপাত্মা দুঃশাসনের বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া রুধির পান না করি, তাহা হইলে আমি যেন পূর্ব্বপুরুষগণের গতি প্রাপ্ত না হই।” সেই সকল রাজারা ভীমসেনের এবপ্রকার ভীমবাক্য শ্রবণ করিয়া দুঃশাসনের কুৎসা করিয়া ভীমের প্রশংসা করিতে লাগিলেন।
যখন দুঃশাসন বসনরাশি আকর্ষণ করিয়া নিঃশেষ করিতে পারিল না, তখন লজ্জিত হইয়া সভামধ্যে উপবিষ্ট হইল। সভ্যগণ ধিক্কার প্রদান করিতে লাগিলেন। কৌরবগণ কৌন্তেয়দিগকে অবলোকন করিয়া কোন প্রশ্ন করিতে পারিলেন না। সজ্জনগণ ধৃতরাষ্ট্রকে নিন্দা করিয়া পরিতাপ করিতে লাগিলেন।
সভাসদগণের প্রতি বিদুরের অনুযোগ
তদনন্তর সর্ব্বধর্ম্মজ্ঞ বিদুর উৎক্ষিপ্ত বাহু-দ্বারা সভাসদগণকে নিবারণ করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে সভ্যগণ! দ্রুপদনন্দিনী যাহা জিজ্ঞাসা করিয়া অনাথার ন্যায় পুনঃ পুনঃ রোদন করিতেছেন, আপনারা তাহার উত্তর প্রদান করিতেছেন না, ইহাতে ধর্ম্মকে পীড়ন করা হইতেছে। আর্ত ব্যক্তি প্রজ্বলিত হুতাশনের ন্যায় সভাতে আগমন করে, সভ্যগণের উচিত যে, সত্য এবং ধর্ম্ম দ্বারা তাহাকে প্রশমিত করেন। আৰ্য্যব্যক্তি সত্যদ্বারা ধর্ম্মপ্রশ্নের মীমাংসা করেন; অতএব কামক্রোধাবেগ-বিবর্জিত হইয়া দ্রৌপদীকৃত প্রশ্নের উত্তর প্রদান করুন। বিকর্ণ আপন প্রজ্ঞানুসারে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। এক্ষণে আপনাদিগের ঐ প্রশ্নের যথাবিহিত মীমাংসা করা উচিত। বিচার-সমাজে উপস্থিত থাকিয়া যে ধর্ম্মদর্শী সভ্য বিচাৰ্য্য বিষয়ে কিছুই না কহেন, তিনি মিথ্যাকথনের অৰ্দ্ধেক ফল প্ৰাপ্ত হয়েন। আর যিনি মিথ্যা সিদ্ধান্ত কহেন তিনি সম্পূর্ণ মিথ্যার ফল ভোগ করেন সন্দেহ নাই। এই স্থলে পুরাণবিৎ পণ্ডিতেরা প্ৰহ্লাদ এবং আঙ্গিরসমুনি সংবাদাত্মক পুরাতন ইতিহাস উদাহরণস্বরূপ উপনীত করিয়া থাকেন, এক্ষণে আপনারা সেই ইতিহাস শ্রবণ করুন।
বিদুর কর্তৃক প্ৰহ্লাদ-আঙ্গিরসকথা-বর্ণন
পূর্ব্বে দৈত্যাধিরাজ প্ৰহ্লাদের পুত্র বিরোচন একটি কন্যার নিমিত্ত অঙ্গিরামুনির পুত্ৰ সুধন্বার প্রতি উপদ্ৰব করিয়াছিলেন। তাঁহারা পরস্পর ‘আমি জ্যেষ্ঠ, আমি জ্যেষ্ঠ’ বলিয়া কন্যালাভস্ম্পৃহায় প্রাণ পৰ্য্যন্ত পণ করিয়া মহারাজ প্ৰহ্লাদের নিকট গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে দৈত্যেন্দ্র! আমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ আপনি এই বিবাদের মীমাংসা করিয়া দিন, মিথ্যা কহিবেন না।” প্ৰহ্লাদ সেই বিবাদে ভীত হইয়া সুধন্বার প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে, সুধম্বা রোষবশে প্রজ্বলিত ব্ৰহ্মদণ্ডের ন্যায় হইয়া কহিতে আরম্ভ করিলেন, ‘রে প্রহ্লাদ! যদি তুই মিথ্যা বলিস, অথবা প্রকৃতবিষয় গোপন রাখিস, তাহা হইলে দেবরাজ ইন্দ্ৰ বজ্র-দ্বারা তোর মস্তক শতধা বিদীর্ণ করিবেন।’ সুধন্বা কর্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া প্ৰহ্লাদ ব্যথিতমনে কশ্যপসন্নিধানে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে মহাভাগ! আপনি দৈব ও আসুর ধর্মের মর্ম্মার্থ সকলই অবগত আছেন; এক্ষণে ব্ৰাহ্মণের ধর্ম্মকৃচ্ছ উপস্থিত হইয়াছে, শ্রবণ করুন। যিনি প্রশ্নের প্রকৃত প্ৰত্যুত্তর প্রদান না করেন, অথবা জানিয়াও মিথ্যা বলেন, পরজন্মে কোন কোন লোক তাহার ভোগ্য হইয়া থাকে, বলুন; এ বিষয়ে আমার সম্পূর্ণ সংশয় জন্মিয়াছে। কশ্যপ কহিলেন, “হে প্ৰহ্লাদ! যে ব্যক্তি জানিয়া শুনিয়াও কাম-ক্রোধ ও ভয়প্রযুক্ত প্রশ্নের প্রকৃত প্ৰত্যুত্তর না দেয় এবং যে সাক্ষী মিথ্যা সাক্ষ্য প্ৰদান করে, তাহারা সহস্ৰসংখ্যক বারুণ পাশ দ্বারা সংযত হয়। প্রতিসংবৎসরে তাহাদিগের এক-একটিমাত্র পাশ বিমুক্ত হইয়া থাকে, অতএব হে প্ৰহ্লাদ! সত্য জানিয়া সত্যই বলিবে।
‘ধর্ম্ম অধর্ম্ম দ্বারা অনুবিদ্ধ হইলে ধর্মের কোন হানি হয় না, কিন্তু যে সমস্ত সভ্য তথায় উপস্থিত থাকেন, তাহাদিগকেই অধর্ম্ম স্পর্শ করে। যাহারা নিন্দিত ব্যক্তিকে নিন্দা না করেন, সেই অনিন্দ্যবাদিমধ্যে যিনি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, তাহাকে অধর্মের অৰ্দ্ধাংশ, কর্তৃপক্ষীয়দিগকে চতুর্থাংশ এবং সদস্যদিগকে চতুর্থাংশ প্রদান করিয়া থাকে। যথায় নিন্দার্হ ব্যক্তির নিন্দাবাদ হইয়া থাকে, সেই স্থানে শ্রেষ্ঠ ও সদস্যগণ পাপশূন্য হয়েন, কিন্তু যিনি কর্তা, তাহারই পাপস্পর্শ হইয়া থাকে। জিজ্ঞাসা করিলে যাহারা মিথ্যা ধর্ম্ম কহেন, তাহাদিগের পর ও অবর একোনপঞ্চাশতম ইষ্ট ও পূর্তনামক কর্ম্ম নষ্ট হইয়া থাকে। হৃতসর্ব্বস্ব ও হতপুত্রের যে দুঃখ, স্বাৰ্থভ্ৰষ্ট ও ঋণীর যে দুঃখ, অপুত্র ও ব্যাঘ্রী কর্তৃক আহত ব্যক্তির যে দুঃখ, সপত্নীসত্ত্বে স্ত্রীলোকের এবং কপট সাক্ষিকর্তৃক ছলিত ব্যক্তির যে দুঃখ, ত্ৰিদশাধিপতিরা এই সকল দুঃখকে সমান বলিয়া পরিগণিত করেন। হে প্ৰহ্লাদ! যে ব্যক্তি মিথ্যা ব্যবহার করে, তাহারও ঐ সমস্ত দুঃখ ঘটিয়া থাকে। সমক্ষে দর্শন, শ্রবণ ও ধারণা দ্বারা লোক সাক্ষী বলিয়া নির্দিষ্ট হয়; অতএব সত্য কহিলে সাক্ষী ধর্ম্মার্থবিহীন হয় না।”
প্ৰহ্লাদ কশ্যপের বাক্য শ্রবণ করিয়া বিরোচনকে কহিলেন, “বৎস! সুধন্বা তোমা হইতে শ্রেষ্ঠ, অঙ্গিরা আমা হইতে শ্রেষ্ঠ, সুধন্বার মাতা তোমার মাতা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, অতএব এই সুধন্বাই তোমার প্রাণের অধীশ্বর হইবেন।” সুধন্বা কহিলেন, “হে প্ৰহ্লাদ! পুত্ৰস্নেহ পরিত্যাগপূর্ব্বক যখন ধর্ম্ম-স্থাপনে যত্ন করিতেছ, অতএব আশীৰ্বাদ করি, তোমার পুত্র একশত বৎসর জীবিত থাকিবে’।” এইরূপে উপাখ্যান সমাপন করিয়া বিদুর কহিলেন, “এক্ষণে সভ্যেরা এই পরম ধর্ম্মোপদেশ-বাক্য শ্রবণ করিয়া, কৃষ্ণা যে প্রশ্ন করিয়াছেন, তাহার কিরূপ সদুত্তর প্রদান করিবেন, বিবেচনা করুন।” বিদুরের বাক্য কর্ণগোচর করিয়া সভাস্থ পার্থিবেরা কিছুই প্রত্যুত্তর করিলেন না, এই অবসরে কর্ণ দুঃশাসনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে দুঃশাসন! এক্ষণে দাসী দ্রৌপদীকে গৃহে লইয়া যাও।” কর্ণের আদেশ প্রাপ্তিমাত্র দুঃশাসন বেপমানা [কম্পমান] সলজ্জা অনাথা দ্রৌপদীকে সভামধ্যে আকর্ষণ করিতে লাগিলেন।