৬৬তম অধ্যায়
কৃষ্ণকৌশলে অর্জ্জুনের যুধিষ্ঠিরান্বেষণ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ। অনন্তর নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ মহাবীর ধনঞ্জয় পরাজিত দ্রোণনন্দনকে পরিত্যাগ করিয়া স্বীয় সৈন্যগণের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপপুর্ব্বক সেনামুখে অবস্থিত সমরবিরত বীরগণকে একান্ত পুলকিত করিলেন এবং যে যে বীর পূর্ব্বপ্রহারবেগে বিমর্দ্দিত হইয়াও রথারোহণে সংগ্রামস্থলে অবস্থান করিতেছিলেন, তাঁহাদের সবিশেষ প্রশংসা করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠিরকে নিরীক্ষণ না করিয়া মহাবেগে ভীমসেনসন্নিধানে গমনপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন ‘হে মহাত্মন! এক্ষণে ধর্ম্মরাজ কোথায়?’ ভীম কহিলেন, ‘ভ্রাতঃ! ধর্ম্মনন্দন রাজা যুধিষ্ঠির সূতপুত্রের শরনিকরে সন্তপ্ত হইয়া এ স্থান হইতে গমন করিয়াছেন। এক্ষণে তিনি জীবিত আছেন কি না সন্দেহ।’ তখন অর্জ্জুন কহিলেন, ‘হে মহাত্ম! তুমি ধর্ম্মরাজের বৃত্তান্ত অবগত হইবার নিমিত্ত এ স্থান হইতে শীঘ্র প্রস্থান কর। আমার বোধ হইতেছে, তিনি সূতপুত্রের শরনিকরে গাঢ়তর বিদ্ধ হইয়া শিবিরমধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন। পূর্ব্বে তিনি দ্রোণাচার্য্যের নিশিতশরে সাতিশয় বিদ্ধ হইয়াও যে পৰ্য্যন্ত দ্রোণ নিহত না হইয়াছিলেন, সেই পর্যন্ত বিজয়লাভপ্রত্যাশায় সংগ্রামস্থলে অবস্থান করিয়াছিলেন। আজ যখন তাঁহাকে সংগ্রামস্থলে অবলোকন করিতেছি না, তখন কর্ণের সহিত সংগ্রামে তাঁহার প্রাণসংশয় উপস্থিত হইয়াছে, সন্দেহ নাই। অতএব তুমি তাঁহার বৃত্তান্ত অবগত হইবার নিমিত্ত অবিলম্বে গমন কর। আমি বিপক্ষগণকে অবরোধ করিয়া এই স্থানে অবস্থান করি।’ তখন ভীমসেন ধনঞ্জয়ের বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া কহিলেন, ‘হে অর্জ্জুন। ধর্ম্মরাজের বৃত্তান্ত জ্ঞাত হইবার নিমিত্ত গমন করা তোমারই কৰ্ত্তব্য। আমি এক্ষণে এ স্থান হইতে গমন করিলে শত্রুপক্ষীয়েরা আমাকে ভীত বলিবে।’ তখন অৰ্জন কহিলেন, ‘হে মহান! সংশপ্তকগণ আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া অবস্থান করিতেছে। এক্ষণে ইহাদিগকে বিনাশ না করিয়া বিপক্ষসমীপ হইতে প্রতিগমন করা আমার অকৰ্ত্তব্য।’ ভীম কহিলেন, ‘হে ধনঞ্জয়! আমি একাকী স্বীয় বলবীর্য্যপ্রভাবে সংশপ্তকগণের সহিত যুদ্ধ করিতেছি, তুমি ধর্ম্মরাজের বৃত্তান্ত অবগত হইবার নিমিত্ত গমন কর।’
“হে মহারাজ! মহাবীর ধনঞ্জয় ভীমপরাক্রম ভীমের সেই বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নিকট গমন করিবার বাসনায় অপ্রমেয় নারায়ণকে কহিলেন, ‘হে কৃষ্ণ! জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে নিরীক্ষণ করিবার নিমিত্ত আমার একান্ত অভিলাষ হইতেছে, অতএব তুমি অবিলম্বে এই সৈন্যসাগর অতিক্রম করিয়া গমন কর। তখন বাসুদেব গরুড়ের ন্যায় বেগগামী অশ্বগণকে সঞ্চালন করিয়া ভীমকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে ভীম! সংশপ্তকগণকে সংহার করা তোমার পক্ষে আশ্চর্য্যের বিষয় নহে; অতএব তুমি এক্ষণে উহাদিগকে বিনাশ কর, আমরা চলিলাম।’
“হে মহারাজ! মহাত্মা বাসুদেব ভীমকে এইরূপে সংশপ্তকগণের সহিত যুদ্ধ করিতে আদেশ করিয়া অবিলম্বে অর্জ্জুনসমভিব্যাহারে রাজা যুধিষ্ঠিরসন্নিধানে সমুপস্থিত হইলেন এবং উভয়ে রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া একাকী শয়ান ধর্ম্মনন্দনের পাদবন্দনপূর্ব্বক তাঁহাকে প্রকৃতিস্থ অবলোকন করিয়া যারপরনাই আহ্লাদিত হইলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ইন্দ্ৰসন্নিধানে সমুপস্থিত অশ্বিনীকুমারযুগলের ন্যায় সেই বীরদ্বয়কে সমাগত নিরীক্ষণ করিয়া, জম্ভাসুর নিহত হইলে সুরগুরু বৃহস্পতি যেমন দেবরাজ ও বিষ্ণুকে অভিনন্দন করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তাঁহাদিগকে যথোচিত অভিনন্দন করিলেন এবং সূতপুত্র অর্জ্জুনশরে নিহত হইয়াছে, ইহা স্থির করিয়া প্রীতমনে হর্ষগদ্গদ্বচনে সেই বিশাললোহিতলোচন, ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ, রুধিরলিপ্তকলেবর, মহাসত্ত্ব কেশব ও ধনঞ্জয়কে অবলোকন করিয়া সান্ত্ববাদ প্রয়োগপূর্ব্বক হাস্যমুখে কহিতে লাগিলেন।”