৬৫তম অধ্যায়
বৈশম্পয়ন কহিলেন, মহারাজ! মহারথ ভীষ্ম সমরে পরাঙ্মুখ হইয়া সত্বরে পলায়ন করিলে রাজা দুৰ্য্যোধন কামুক গ্রহণপূর্ব্বক এক প্রচণ্ড সিংহনাদ পরিত্যাগ করিয়া সহসা অর্জ্জুনের সন্নিধানে আগমন করিলেন এবং ভল্লাস্ত্ৰ আকৰ্ণ সন্ধান করিয়া সমরাঙ্গ নচারী ধনঞ্জয়ের ললাটদেশে বিদ্ধ করিলেন। অর্জ্জুন ভল্লবিদ্ধ হইয়া একশৃঙ্গসম্পন্ন নীল-পর্ব্বতের শোভা ধারণ করিলেন। তাঁহার ললাটদেশ হইতে অনবরত রুধিরধারা প্রবাহিত হইতে লাগিল। তখন সুবর্ণপুঙ্খশোভিত ভল্লাস্ত্ৰ একান্ত সমুজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন ক্ৰোধে নিতান্ত অধীর হইয়া গাণ্ডীব শরাসনে বিষাগ্নিসদৃশ শরসন্ধান করিয়া দুর্য্যোধনকে বিদ্ধ করিলেন। রাজা দুৰ্য্যোধনও তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া অনবরত শরক্ষেপ করিতে লাগিলেন। এইরূপে তাঁহাদের ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইলে বিকৰ্ণ উত্তুঙ্গ পর্ব্বতসন্নিভ এক মত্ত-মাত্তঙ্গে আরোহণ করিয়া মহাবেগে অর্জ্জুনের প্রতি ধাবমান হইলেন। অর্জ্জুন সেই মাতঙ্গের কুম্ভমণ্ডল [মগজের নিম্নস্থান] লক্ষ্য করিয়া আকৰ্ণ সন্ধানপূর্ব্বক এক শর পরিত্যাগ করিলেন। যেমন দেবরাজ-বিসৃষ্ট বজ্র পর্ব্বতশৃঙ্গ বিদীর্ণ করে, তদ্রূপ অর্জ্জুনশর সেই করিবরের কুম্ভদেশ বিদারণপূর্ব্বক পৃথিবীতে প্রবেশ করিল। তখন সেই নাগরাজ নিতান্ত ব্যথিত ও কম্পিত্যকলেবর হইয়া তৎক্ষণাৎ ভূপৃষ্ঠে নিপতিত ও পঞ্চত্ব প্ৰাপ্ত হইল। তদ্দর্শনে বিকৰ্ণ নিতান্ত ভীত ও সহসা সেই কবিরাজ হইতে অবতীর্ণ হইয়া দ্রুত পদসঞ্চারে একশত অষ্ট পদ গমন করিয়া বিবিংশতির রথে আরোহণ করিলেন।
অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন সেইরূপ আর একটি শর দ্বারা দুৰ্য্যোধনের বক্ষঃস্থলে বিদ্ধ করিয়া যোদ্ধৃগণের প্রতি অনবরত শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন যোদ্ধগণ অর্জ্জুনশরে ক্ষতবিক্ষতকলেবর হইয়া সত্বর তথা হইতে পলায়ন করিতে লাগিল। দুৰ্য্যোধন এই অদ্ভুত ব্যাপার সকল অবলোকন ও শ্রবণ করিয়া সহসা অর্জ্জুনশূন্য প্রদেশে গমন করিতে উদ্যত হইলেন। তখন অর্জ্জুন সেই ভীমরূপী বাণিবিদ্ধ রুধিরোক্ষিতকলেবর [রক্তরঞ্জিত দেহ] দুৰ্য্যোধনকে রণস্থল হইতে প্রস্থান করিতে দেখিয়া আস্ফালনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! তুমি সমরভূমি হইতে পলায়ন করিয়া কি নিমিত্ত মহীয়সী কীর্ত্তি কলঙ্কিত করিতেছ? দেখ, এখনও তুমি রাজ্যচ্যুত হও নাই এবং তন্নিমিত্ত তুৰ্য্যও সমাহত হয় নাই [রণবাদ্য বন্ধ হয় নাই]। আমি ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নিদেশবর্তী হইয়া যুদ্ধে আগমন করিয়াছি; অতএব এক্ষণে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া আমার সম্মুখীন হও; সেই সকল পূর্ব্ব-কাৰ্য্য একবার স্মরণ কর। যখন তুমি সমরে পরাঙ্মুখ হইয়া পলায়ন করিতেছ, তখন ভূমণ্ডলে তোমার দুৰ্য্যোধন নামটি নিতান্ত নিষ্ফল হইল; ঐ নামের আর গৌরব রহিল না। আজ তোমার অগ্র-পশ্চাৎ কোন রক্ষক নিরীক্ষণ করিতেছি না; অতএব তুমি সত্বর পলায়ন করিয়া আপনার প্রাণ রক্ষা কর।”