৬৫তম অধ্যায়
অর্জ্জুনযুদ্ধে অশ্বত্থামার পরাজয়
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাবীর অশ্বত্থামা অতি বৃহৎ অসংখ্যরথে পরিবৃত হইয়া সহসা পার্থসমীপে ধাবমান হইল। কৃষ্ণসহায় ধনঞ্জয় দ্রোণপুত্রকে সহসা সমাগত অবলোকন করিয়া, তীরভূমি যেমন সমুদ্রের বেগ অবরোধ করে, তদ্রূপ তাঁহাকে অবরুদ্ধ করিলেন। তখন প্রবলপ্রতাপশালী অশ্বত্থামা ক্রোধাবিষ্ট হইয়া অর্জ্জুন ও বাসুদেবকে শরজালে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। মহারথ কৌরবগণ তদ্দর্শনে সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। ঐ সময় মহাবীর ধনঞ্জয় হাস্য করিয়া দিব্যাস্ত্র প্রাদুর্ভূত করিলে অশ্বত্থামা তৎক্ষণাৎ তাহা নিরাকৃত করিলেন। ফলতঃ তৎকালে ধনঞ্জয় আচাৰ্য্যতনয়ের নিধনবাসনায় যে যে অস্ত্র নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন, মহাধনুর্দ্ধর অশ্বত্থামা তৎসমুদয়ই ছেদন করিয়া ফেলিলেন। সেই ভীষণ অস্ত্রযুদ্ধসময়ে দ্রোণতনয়কে ব্যাদিস্য অন্তকের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। তিনি সরল শরনিকরে দিগ্বিদিক সমাচ্ছন্ন করিয়া তিনবাণে বাসুদেবের দক্ষিণবাহু বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন আচাৰ্য্যতনয়ের বাহনগণকে নিহত করিয়া সমরাঙ্গনে এক ভীষণ শোণিতনদী প্রবাহিত করিলেন। মহাবীর দ্রোণতনয়ের অসংখ্য রথসমবেত রথী অর্জ্জুনের শরাসননির্ম্মুক্ত শরনিকরে বিনষ্ট হইল। ঐ সময় অশ্বত্থামাও অর্জ্জুনের ন্যায় ঘোরতর শোণিতনদী প্রবাহিত করিলেন।
“হে মহারাজ। এইরূপে বীরদ্বয়ের ভীষণ সংগ্রাম উপস্থিত হইলে যোধগণ মৰ্য্যাদাশূন্য হইয়া যুদ্ধ করিয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় অশ্ব ও সারথিবিহীন রথ, সাদিশূন্য অশ্ব এবং আরোহী ও মহামাত্ৰবিহীন মাতঙ্গগণকে বিনষ্ট করিয়া অসংখ্য সেনার প্রাণসংহার করিলেন। রথীগণ অর্জ্জুনের শরনিকরে নিহত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইল এবং অশ্বগণ যোক্ত্রবিহীন হইয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে লাগিল। তখন মহাবীর অশ্বত্থামা সমরনিপুণ ধনঞ্জয়ের সেই ভীষণ কাৰ্য্যদর্শনে অতি সত্বর তাঁহার অভিমুখে আগমনপূর্ব্বক সুবর্ণবিভূষিতশরাসন বিধূনিত [কম্পিত] করিয়া চতুর্দ্দিক হইতে তাঁহাকে শাণিতশরজালে সমাচ্ছন্ন করিয়া অতি নির্দ্দয়ভাবে তাঁহার বক্ষঃস্থল নিপীড়িত করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন অশ্বত্থামার শরে অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া শরবর্ষণপূর্ব্বক সহসা দ্রোণপুত্রকে সমাচ্ছন্ন করিয়া তাঁহার কোদণ্ড দ্বিখণ্ড করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর দ্রোণতনয় বজ্রসদৃশ পরিঘ গ্রহণপূর্ব্বক অর্জ্জুনের প্রতি নিক্ষেপ করিলে গাণ্ডীবধারী পাণ্ডব হাস্য করিয়া সহসা সেই কনকমণ্ডিত পরিঘ ছেদন করিলেন। পরিঘ অর্জ্জুনের শরে সমাহিত হইয়া বজ্রাহত পর্ব্বতের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল।
“তখন মহারথ দ্রোণতনয় রোষাবিষ্ট হইয়া ইন্দ্রজালপ্রভাবে ধনঞ্জয়ের উপর অনবরত ভীষণ অসমুদয় বৰ্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন সেই ইন্দ্রজালদর্শনে সত্বর গাণ্ডীব শাসনে ইন্দ্রদত্ত অস্ত্র সংযোজিত করিয়া উহা নিবারণপূর্ব্বক ক্ষণকালের মধ্যে অশ্বত্থামার রথ আচ্ছাদিত করিয়া ফেলিলেন। দ্রোণতনয় ধনঞ্জয়ের শরে অভিভূত হইয়া তাঁহার অভিমুখে আগমনপূর্ব্বক শরনিকর সহ্য করিয়া শতশরে কৃষ্ণকে ও তিনশত ক্ষুদ্ৰকশরে ধনঞ্জয়কে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন শতশরে গুরুপুত্রের মর্ম্ম বিদারণপূর্ব্বক কৌরবসৈন্যগণসমক্ষেই তাঁহার অশ্ব, সারথি ও শরাসনজ্যার উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন এবং অবিলম্বে ভল্লদ্বারা তাঁহার সারথিকে রথ হইতে ভূতলে নিপাতিত করিলেন। তখন আচাৰ্য্যপুত্র স্বয়ং অশ্বরশ্মি গ্রহণপূর্ব্বক কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। তিনি স্বয়ং অশ্বগণকে সংযত করিয়া ধনঞ্জয়কে শরনিকরে সমাচ্ছাদিত করাতে আমরা তাহার অদ্ভুত পরাক্রম দর্শনে চমৎকৃত হইলাম এবং যোধগণ সকলেই তাহার প্রশংসা করিতে আরম্ভ করিলেন।
“অনন্তর জয়শীল অর্জ্জুন হাস্যমুখে ক্ষুরপ্ৰদ্বারা অশ্বত্থামার অশ্বরশ্মি ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তুরঙ্গমগণ ধনঞ্জয়ের শরবেগে নিপীড়িত হইয়া পলায়ন করিতে লাগিল। তখন কৌরবসৈন্যমধ্যে ভীষণ কোলাহল সমুত্থিত হইল। মহাবীর পাণ্ডবগণ জয়লাভে সন্তুষ্ট হইয়া চতুর্দ্দিকে নিশিতশরবর্ষণপূর্ব্বক কৌরবসেনাগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। কৌরবসৈন্যগণ জয়লাভপ্রহৃষ্ট পাণ্ডবগণের শরে বারংবার নিপীড়িত হইয়া শকুনি, কর্ণ ও আপনার পুত্রগণের সমক্ষেই ব্যাকুলচিত্তে পলায়ন করিতে লাগিল। আপনার পুত্রগণ তাহাদিগকে বারংবার পলায়নে নিষেধ ও কর্ণ ‘তিষ্ঠ তিষ্ঠ’ বলিয়া নিবারণ করিতে লাগিলেন; কিন্তু তাহারা কোনক্রমেই সংগ্রামস্থলে অবস্থান করিতে সমর্থ হইল না। পাণ্ডবগণ কৌরবসৈন্যগণকে চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে দেখিয়া প্রফুল্লচিত্তে চীৎকার করিতে লাগিলেন।
কর্ণের সর্ব্বমংহারক অস্ত্রপ্রয়োগ
“অনন্তর দুৰ্য্যোধন বিনয়বচনে কর্ণকে কহিলেন, ‘হে রাধেয়! ঐ দেখ, তুমি বৰ্ত্তমান থাকিতে সৈন্যগণ পাঞ্চালগণের শরে নিপীড়িত হইয়া ভয়ে পলায়নে প্রবৃত্ত হইয়াছে এবং সহস্র সহস্র যোদ্ধা পাণ্ডবগণকক বিদ্ৰাবিত হইয়া তোমাকেই আহ্বান করিতেছে।’ হে মহারাজ! তখন মহাবীর সূতপুত্র দুর্য্যোধনের বাক্য শ্রবণ করিয়া প্রসন্নচিত্তে মদ্ররাজকে কহিলেন, ‘হে শল্য! তুমি অশ্বসকল পরিচালনা কর। অদ্য আমি সমুদয় পাণ্ডব, ও পাঞ্চালণাকে সংহার করিয়া তোমাকে স্বীয় ভুজবল প্রদর্শন করিব।’ প্রতাপান্বিত কর্ণ এই বলিয়া বিজয়নামক পুরাতন শরাসনে জ্যারোপণ ও বারংবার আকর্ষণ করিয়া সত্য শপথদ্বারা স্বীয় যোধগণকে নিবারণপুর্ব্বক ভার্গবদত্ত অস্ত্র গ্রহণ করিলেন। তখন সেই অস্ত্র হইতে সহস্র সহস্র, প্রযুত প্ৰযুত, অর্ব্বুদ অৰ্বদ, কোটি কোটি কঙ্কপত্রান্বিত প্রজ্বলিত নিশিতশর নির্গত হইয়া পাণ্ডবসেনাগণকে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। তৎকালে আর কিছুমাত্র বোধগম্য হইল না। পাঞ্চালগণ নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া হাহাকার করিতে লাগিল। সহস্র সহস্র হস্তী, অশ্ব, রথী ও পদাতি নিহত হইয়া চতুর্দ্দিকে নিপতিত হওয়াতে পৃথিবী বিকম্পিত হইল। সমুদয় পাণ্ডবসৈন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিল। ঐ সময় যোধগণাগ্রগণ্য [১] কর্ণ একাকী শরানলে শত্ৰুদাহন করিয়া বিধুম পাবকের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। পাঞ্চাল ও চেদিগণ কর্ণশরাঘাতে বনদহনদগ্ধ মাতঙ্গযুথের ন্যায় বিমোহিতপ্রায় হইয়া ব্যাঘ্রের ন্যায় ভীষণরণে চীৎকার করিতে লাগিল। মৃতব্যক্তির কুটুম্বগণ মিলিত হইয়া যেরূপ রোদন করিয়া থাকে, সমরাঙ্গনে সংগ্রামভীত চতুর্দ্দিকে ধাবমান বীরগণের তদ্রূপ আর্ত্তনাদ শ্রুতিগোচর হইতে লাগিল। তক্কালে তির্য্যগযোনিগত জীবগণও পাণ্ডবগণকে কর্ণশরে নিপীড়িত দেখিয়া নিতান্ত ভীত হইল। সৃঞ্জয়গণ সমরে সূতপুত্ৰকর্ত্তৃক সমাহত ও বিচেতনপ্রায় হইয়া, মৃতব্যক্তিরা যেমন যমপুরে প্রেতরাজকে আহ্বান করে, তদ্রূপ অর্জ্জুন ও বাসুদেবকে বারংবার আহ্বান করিতে লাগিলেন।
“তখন কুন্তীনন্দন ধনঞ্জয় সেই কর্ণায়কনিপীড়িত বীরগণের আৰ্ত্তরব শ্রবণ ও ভীষণ ভার্গবাস্ত্রের দর্শন করিয়া বাসুদেবকে কহিলেন, ‘হে কৃষ্ণ! ঐ ভার্গবাস্ত্রের পরাক্রম অবলোকন কর। উহা নিবারণ করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। ঐ দেখ, সূতনন্দন কালান্তক যমের ন্যায় ক্রুদ্ধ হইয়া রণস্থলে নিদারুণ কার্য্য সম্পাদন করিয়া বারংবার আমার প্রতি কটাক্ষ নিক্ষেপ করিতেছে। অতএব তুমি এক্ষণে উহার অভিমুখে অশ্ব সঞ্চালন কর। এক্ষণে কর্ণকে পরিত্যাগপূর্ব্বক পলায়ন করা আমার নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। লোকে জীবিত থাকিলে সমরে জয় বা পরাজয় লাভ করিতে পারে; মৃতব্যক্তির জয়লাভের কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই।’
“হে মহারাজ। বাসুদেব ধনঞ্জয়কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে পার্থ। রাজা যুধিষ্ঠির কর্ণবাণে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়াছেন, তুমি অগ্রে তাঁহাকে দর্শন ও আশ্বাস প্রদান করিয়া পশ্চাৎ কর্ণকে নিপীড়িত করিবে। হে মহারাজ! তৎকালে মহামতি বাসুদেব মনে মনে এই স্থির করিয়াছিলেন যে, কর্ণ অন্যান্য বীরগণের সহিত বহুক্ষণ সংগ্রাম করিয়া পরিশ্রান্ত হইলে অর্জ্জুন অনায়াসে তাঁহাকে সংহার করিতে সমর্থ হইবেন। মহাত্মা কৃষ্ণ উক্ত প্রকার বিবেচনা করিয়াই অর্জ্জুনকে অগ্রে যুধিষ্ঠিরের সহিত সাক্ষাৎ করিতে অনুরোধ করিয়া অবিলম্বে ধনঞ্জয়সমভিব্যাহারে যুধিষ্ঠিরের দর্শনার্থ গমন করিতে লাগিলেন। ধনঞ্জয়ও বাসুদেবের আজ্ঞায় সম্মত হইয়া কর্ণনিপীড়িত যুধিষ্ঠিরকে সত্বর দেখিবার নিমিত্ত কৃষ্ণকে বারংবার শীঘ্র গমনে অনুরোধ করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় অশ্বত্থামার সহিত তাঁহার ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইল। তিনি অবিলম্বে ইন্দ্রেরও অজেয় গুরুপুত্রকে পরাজয়পূর্ব্বক সৈন্যগণমধ্যে যুধিষ্ঠিরের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন, কিন্তু তাহার সন্দর্শনলাভে কৃতকার্য হইলেন না।”