সর্ব্বস্বপণে যুধিষ্ঠির পরাজিত
শকুনি কহিল, “হে যুধিষ্ঠির! তুমি দ্যূতক্রীড়ায় পাণ্ডবগণের অনেক ধন নষ্ট করিলে, এক্ষণে যদি আর কিছু অপরাজিত ধন থাকে, তবে বল।” যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সুবলনন্দন! আমি জানি, আমার অসংখ্য ধন আছে, তুমি কি নিমিত্ত আমাকে ধনের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছ? আমি অযুত, প্রযুত, পদ্ম, খর্ব্ব, অর্বুদ, শঙ্খ, মহাপদ্ম, নিখর্ব্ব, কোটি, মধ্য ও পর্যাদ্ধসংখ্যক ধন দ্বারা এই সমস্ত জনসমক্ষে তোমার সহিত ক্রীড়া করিব।”
শকুনি যুধিষ্ঠিরের বাক্যশ্রবণান্তর ‘এই জিতিলাম’ বলিয়া ছলপূর্ব্বক আক্ষবিক্ষেপ করিবামাত্র তাঁহারই জয় হইল।
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সুবলনন্দন। বহুসংখ্যক গো, অশ্ব ধেনু, ছাগ, মেষ এবং সিন্ধুনদীর পূর্ব্বে আমার যে সমুদয় ধন আছে, এবার আমার সেই সমস্ত পণ রহিল।”
শকুনি যুধিষ্ঠিরের বাক্যশ্রবণানন্তর ‘এই জিতিলাম’ বলিয়া ছলপূর্ব্বক অক্ষবিক্ষেপ করিলে সুবিলাত্মজেরই জয়লাভ হইল।
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে শকুনে! পুর, জনপদ, ভূমি, ব্ৰাহ্মণধন ব্যতীত অন্যান্য ধনসমুদয় ও ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্যান্য পুরুষগণ, এই সমস্ত আমার অবশিষ্ট আছে; এবার আমি সেই সমস্ত পণ রাখিলাম।”
শকুনি যুধিষ্ঠিরের বাক্যশ্রবণানন্তর ‘এই জিতিলাম’ বলিয়া ছলপূর্ব্বক আক্ষবিক্ষেপ করিলে জয় হইল।
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সৌবল। এই রাজপুত্ৰগণ যে সমস্ত কুণ্ডল, নিষ্ক প্রভৃতি রাজভূষণে বিভূষিত হইয়া অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিয়াছে, এবার আমার সেই সমুদয় অলঙ্কার পণস্বরূপ।”
শকুনি যুধিষ্ঠিরের বাক্যশ্রবণানন্তর ‘এই জিতিলাম’ বলিয়া অক্ষবিক্ষেপ করিলে শকুনিরই জয় হইল।
ভ্রাতৃপণে পাণ্ডবাপরাভব
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সুবলাত্মজ! এই শ্যামকিলেবর যুবা লোহিত-নেত্র, সিংহস্কন্ধ, মহাভুজ, নকুলকে পণ রাখিয়া তোমার সহিত ক্রীড়া করিব!”
শকুনি কহিল, “হে মহারাজ যুধিষ্ঠির! এই তোমার প্রিয় রাজতুল্য নকুল আমাদের বশীভূত হইল, এক্ষণে আর কি পণ রাখিয়া ক্রীড়া করিবে?” এই বলিয়া শকুনি অক্ষ গ্রহণপূর্ব্বক ‘এই জিতিলাম’ বলিয়া ছলপূর্ব্বক অক্ষবিক্ষেপ করিবামাত্র সৌবলেরই জয় হইল।
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে শকুনে! এই সহদেব ধর্ম্মানুশাসন করেন; ইনি পণ্ডিত বলিয়া বিখ্যাত; ইনি আমার নিতান্ত প্রিয় ও পণের অযোগ্য হইলেও ইহাকে পণ রাখিয়া তোমার সহিত ক্রীড়া করিব।”
শকুনি যুধিষ্ঠিরের বাক্যশ্রবণানন্তর ‘এই জিতিলাম’ বলিয়া ছলপূর্ব্বক অক্ষবিক্ষেপ করিল এবং কহিল, “এই তোমার পরমপ্রিয় মাদ্রৗপুত্রকে জিতিলাম; বোধহয়, ভীম ও ধনঞ্জয় মাদ্রীনন্দনদ্বয় অপেক্ষাও প্রিয়তর, উহাদিগকে কখনই পণ রাখিতে পরিবে না।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “রে নয়নাভিজ্ঞ [নীতিশাস্ত্ৰে বোধশূন্য] মূঢ়, আমরা সাতিশয় সরলস্বভাবসম্পন্ন, তুমি আমাদিগের পরস্পর ভেদ করিয়া দিবার অভিলাষ করিয়া নিতান্ত অধৰ্মাচরণ করিতেছ।”
শকুনি কহিল, “যে রাজন্! প্ৰমত্তব্যক্তি গর্তমধ্যে বা স্থাণুর উপরে নিপতিত হয়। হে ধর্ম্মরাজ! তুমি পাণ্ডবগণের জ্যেষ্ঠ এবং বরিষ্ঠ; তোমাকে নমস্কার। হে মহারাজ! দ্যূতাসক্ত ব্যক্তিগণ ক্রীড়া করিতে করিতে উন্মত্তের ন্যায় যে সকল প্ৰলাপ করে, তৎসমুদয় জাগরণাবস্থায় দূরে থাকুক, উহারা স্বপ্নেও কখনও দেখে নাই।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে শকুনে! যিনি নৌকার ন্যায় আমাদিগকে সমর-সাগরে পার করেন, সেই অরাতিপাতন ভুবনৈকবীর রাজপুত্র ধনঞ্জয় পণের অযোগ্য হইলেও তাঁহাকে পণ রাখিয়া তোমার সহিত ক্রীড়া করিব।”
শকুনি যুধিষ্ঠিরের বাক্যশ্রবণানন্তর ‘এই জিতিলাম’ বলিয়া ছলপূর্ব্বক অক্ষবিক্ষেপ করিল এবং কহিল, “হে রাজন্! এই আমি পাণ্ডবগণের মধ্যে প্রধান ধনুৰ্দ্ধর সব্যসাচী অর্জ্জুনকে জয় করিলাম। এক্ষণে তোমার পরমপ্ৰেমাস্পদ ভীমসেন অবশিষ্ট আছে, তাহাকে পণ রাখিয়া ক্রীড়া কর।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সুবলনন্দন! যিনি দানবারি পুরন্দরের ন্যায় সংগ্রামে আমাদিগের নেতা, যাহার তূল্য বলবান এই ভূমণ্ডলে নাই, সেই গদা—যুদ্ধবিশারদ রাজপুত্ৰ মহাত্মা ভীমসেন পণের অযোগ্য হইলেও তাহাকে পণ রাখিয়া তোমার সহিত ক্রীড়া করিব।”
শকুনি যুধিষ্ঠিরের বাক্যশ্রবণানন্তর “এই জিতিলাম’ বলিয়া ছলপূর্ব্বক অক্ষবিক্ষেপ করিল এবং কহিল, “হে কৌন্তেয়! তুমি বহুবিধ ধন, হস্তী, ও অশ্বসমুদয় এবং অনুজগণকে দুরোদার-মুখে সমর্পণ করিয়াছ, এক্ষণে যদি অন্য কিছু ধন থাকে, তবে বল।”
যুধিষ্ঠিরের স্বদেহপণে পরাজয়
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে শকুনে! আমি ভ্রাতৃগণের শ্রেষ্ঠ ও দয়িত; আমি আপনাকে পণ রাখিয়া তোমার সহিত ক্রীড়া করিব।”
শকুনি যুধিষ্ঠিরের বাক্যশ্রবণানন্তর ‘এই জিতিলাম’ বলিয়া ছলপূর্ব্বক অক্ষবিক্ষেপ করিল এবং কহিল, “তুমি স্বয়ং জিত হইয়া যৎপরোনাস্তি পাপাচরণ করিলে, অন্যান্য ধন অবশিষ্ট থাকিতে আত্মাকে পণিত [পণে নিযুক্ত] করা নিতান্ত মূঢ়ের কর্ম্ম।” দুরাত্মা শকুনি এইরূপে কপট পাশক্রীড়ায় মহাবীর যুধিষ্ঠির প্রভৃতি ভ্ৰাতৃবৰ্গকে পরাজয় করিল। ঐ দুরাত্মা উহাতেও নিবৃত্ত না হইয়া পুনর্ব্বার যুধিষ্ঠিরকে কহিল, “হে রাজন্! তোমার প্রণয়িনী দ্রৌপদী ত’ এখনও পরাজিত হয়েন নাই, অতএব তুমি তাহাকে পণ রাখিয়া আপনাকে মুক্ত কর।”
দ্রৌপদীপণে ধর্ম্মরাজের পরাজয়
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে সুবলনন্দন! যিনি নাতিহ্রস্বা, নাতিদীর্ঘ, নাতিকৃশা ও নাতিস্থূলা; যাঁহার রূপ লক্ষ্মীর ন্যায়; কেশ্যকলাপ দীর্ঘ, নীল ও আকুঞ্চিত; নেত্রযুগল শরৎকালীন পদ্মাপত্রের ন্যায়; গাত্রে পদ্মগন্ধ, হস্তে সর্ব্বদা শারদপদ্ম শোভা পায়; যিনি অনৃশংসতা, সুরূপতা, সুশীলতা, অনুকূলতা, প্রিয়বাদিত ও ধর্ম্মার্থক্যামসিদ্ধির হেতুভূততা প্রভৃতি ভর্তার অভিলষিত গুণসমুদয়ে বিভূষিতা; যিনি গোপাল ও মেষপালগণের নিয়মানুসারে শেষে নিদ্রিত ও অগ্ৰে জাগরিত হয়েন; যাহার সস্বেদ মুখপঙ্কজ মল্লিকার ন্যায়; মধ্যদেশ বেদীর ন্যায়; সেই সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী দ্রৌপদীকে পণ রাখিলাম।”
ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মুখে এই বাক্য শ্রবণ করিবামাত্র সভাসদ বৃদ্ধগণ তাঁহাকে ধিক্কার করিতে লাগিলেন। সভা একেবারে ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল। ভূপতিগণ শোকসাগরে নিমগ্ন হইলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপ প্রভৃতি মহাত্মাদিগের কলেবর হইতে ঘর্ম্মবারি নির্গত হইতে লাগিল। বিদুর মস্তক ধারণ-পূর্ব্বক পন্নগের ন্যায় নিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক গতসত্ত্বের [বিগতজীবন—মৃত] ন্যায় অধোমুখে চিন্তা করিতে লাগিলেন। ধৃতরাষ্ট্র আনন্দপ্রবাহে মগ্ন হইয়া মনের ভাব গোপন করিতে না পারিয়া ‘জয় হইল কি’ ‘জয় হইল কি?’ এই কথা বারংবার জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। কর্ণ ও দুঃশাসনাদির হর্ষের আর পরিসীমা রহিল না। অন্যান্য সভ্যগণ অশ্রুমোচন করিতে লাগিলেন। দুরাত্মা শকুনি অহঙ্কারে মত্ত হইয়া ‘এই জিতিলাম’ বলিয়া ছলপূর্ব্বক অক্ষবিক্ষেপ করিবামাত্র তাঁহারই জয় হইল।