৬০তম অধ্যায়
কর্ণের সহিত অর্জ্জুনের দ্বিতীয়বার যুদ্ধ
অর্জ্জুন কহিলেন, “হে কৰ্ণ ভূমণ্ডলে তোমার সদৃশ যোদ্ধা নাই বলিয়া তুমি পূর্ব্বে সভামধ্যে সাতিশয় অহঙ্কার প্রকাশ করিয়াছিলে; এক্ষণে যুদ্ধ উপস্থিত, একবার আমার সহিত যুদ্ধ কর, তাহা হইলে তুমি আপনার পরাক্রম জানিতে পরিবে ও অন্যের অবমাননায় আর কদাচ প্ৰবৃত্ত হইবে না। তুমি ধর্ম্মে জলাঞ্জলি প্ৰদানপূর্ব্বক নিরন্তর কেবল পরুষবাক্য প্রয়োগ করিয়াছ, এক্ষণে তোমার এই দুরভিসন্ধি সিদ্ধ হওয়া নিতান্ত দুস্তর বোধ হইতেছে। তুমি আমার অসমক্ষে পূর্ব্বে যে সকল কথা বলিয়াছিলে, আজি কৌরবগণ-সমক্ষে আমার নিকট তাহা সম্পন্ন কর। দুরাত্মারা পঞ্চালীর কেশাকর্ষণপূর্ব্বক সভামধ্যে যখন নিগ্ৰহ করিয়াছিল, তখন তুমি তাহাতে বাঙনিম্পত্তি [উত্তর না দেওয়া—নির্ব্বাক থাকা] না করিয়া অনায়াসে তাঁহার সেই দুরবস্থা অবলোকন করিয়াছিলে, আজি তাহার সমুচিত প্রতিফল প্রাপ্ত হইবে। ধর্ম্মপাশে বদ্ধ ছিলাম বলিয়া পূর্ব্বে ক্ষমা করিয়াছি, আজি সমরে সেই ক্রোধের প্রত্যক্ষ-ফল অবলোকন করিবে। রে দুরাত্মন! আমি বনে দ্বাদশ বৎসর যে ক্ৰোধ সংবরণ করিয়াছি, তাহার সমগ্ৰ ফল প্রাপ্ত হইবে। রে দুরাত্মন রাধেয়! তুই একবার আমার সহিত যুদ্ধ কর, কৌরব সৈনিকেরা প্ৰত্যক্ষ করুক।”
কৰ্ণ কহিলেন, “পাৰ্থ! কথায় যাহা বলিলে, কাৰ্য্যে তাহার অনুষ্ঠান কর; অনর্থক বাক্যব্যয় করিলে কি হইবে? তোমার বাগাড়ম্বরই সার, ইহা সর্ব্বত্র প্রসিদ্ধ আছে; তোমার পরাক্রম নিরীক্ষণ করিয়া বিলক্ষণ বোধ হইতেছে, তুমি পূর্ব্বে যে ক্ষমা করিয়াছিলে, তাহা অক্ষমতাপ্রযুক্তই হইয়াছে। তুমি পূর্ব্বে ধর্ম্মপাশে বদ্ধ থাকিয়া যেমন স্বীয় ক্ষমতা প্ৰকাশ করিতে সমর্থ হও নাই, এক্ষণে আমার নিকটেও সেইরূপ বদ্ধ আছে; কিন্তু কেবল অবিমৃষ্যকারিতা [হঠকারিতা-বিবেচনা না করিয়া কাৰ্য্য করা] প্রযুক্তই আপনাকে বিমুক্ত বোধ করিতেছ। তুমি প্রতিজ্ঞানুসারে বনে বাস করিয়া সাতিশয় ক্লেশ প্রাপ্ত হইয়াছ, এই নিমিত্ত তুমি এক্ষণে ক্ৰোধে অন্ধ হইয়া আমার সহিত যুদ্ধ করিবার মানস করিতেছ, তাহাতে সন্দেহ নাই। যাহা হউক, আজি যদি তোমার সাহায্যার্থে স্বয়ং দেবরাজ আসিয়া যুদ্ধ করেন, তাহা হইলেও আমার কিছুমাত্ৰ হানি নাই। আমি মুক্তকণ্ঠে ব্যক্ত করিতেছি, সমরে অপরিমিত বল-বিক্রম প্রকাশ করিতে কদাচ পরাঙ্মুখ হইব না। হে কৌন্তেয়! তোমার এই সমরাভিলাষ অচিরকাল-মধ্যেই নিবৃত্ত হইবে, তুমি যুদ্ধ করিলেই আমার বলবিক্রম অবগত হইতে পরিবে।”
অর্জ্জুন কহিলেন, “রে রাধেয়! তুই এইমাত্র রণস্থল হইতে পলায়নপূর্ব্বক আপনার জীবন রক্ষা করিয়াছিস, কিন্তু এ দিকে তোর অনুজ নিহত হইয়াছে; তথাপি তুই সাধুসমাজে আত্মশ্লাঘা করিতেছিস, অতএব তোর সমান নির্লজ্জ ও কাপুরুষ আর ভূমণ্ডলে দৃষ্টিগোচর হয় না।”
জয়শীল অর্জ্জুন এই কথা বলিতে বলিতে বর্ম্মভেদী বাণ বর্ষণপূর্ব্বক তাঁহার সম্মুখীন হইলে তিনিও তৎক্ষণাৎ প্ৰহৃষ্টমনে অর্জ্জুনের প্রতি শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। চতুর্দ্দিক ঘোরতর শরজালে ব্যাপ্ত হইয়া উঠিল এবং তাহাঁর অশ্বগণ বিদ্ধ হইতে লাগিল। অর্জ্জুন অসহমান হইয়া আনতপর্ব্ব নিশিত শরাঘাতে কর্ণের তূণীররজ্জু ছেদন করিলেন। তখন মহাবীর কর্ণ অন্য এক তূণীর হইতে বাণ গ্রহণপূর্ব্বক অর্জ্জুনের হস্ত বিদ্ধ করিবামাত্র তাঁহার মুষ্টি শিথিল হইল। অনন্তর মহাবাহু অর্জ্জুন কর্ণের শরাসনচ্ছেদন করিলে তিনি ক্রোধান্ধ হইয়া তাঁহার প্রতি শক্তিনিক্ষেপ করিলেন। অর্জ্জুন বাণ দ্বারা তৎক্ষণাৎ তাহা নির্যাকরণ করিলেন। পরে এককালে অসংখ্য কর্ণ-সৈন্য প্রচণ্ডবেগে অর্জ্জুনের প্রতি ধাবমান হইলে তিনি শরাঘাতে সকলকেই শমনসদনে প্রেরণ করিলেন এবং আকৰ্ণ শরসন্ধানপূর্ব্বক কর্ণের অশ্বগণকে বিদ্ধ করিলে তাহারা তৎক্ষণাৎ ভূতলে নিপতিত হইল। পরে কর্ণের বক্ষঃস্থলে প্ৰজ্বলিত সুতীক্ষ্ন এক শরাঘাত করিলেন। সেই বাণ বর্ম্ম ভেদ করিয়া তাঁহার শরীর মধ্যে প্রবিষ্ট হইবামাত্র তিনি বিকলেন্দ্রিয় ও মূৰ্ছিত হইয়া ধরাতলে নিপতিত হইলেন; কিন্তু তখন কি হইল, কিছুই জানিতে পারিলেন না। কিয়ৎক্ষণ পরে মহাবীর কর্ণ চৈতন্যলাভ করিয়া দুঃসহ বেদনায় অধীর হইয়া রণ পরিত্যাগপূর্ব্বক উত্তরদিকে পলায়ন করিলেন। এ দিকে মহাবীর অর্জ্জুন ও উত্তর উচ্চৈঃস্বরে হাস্য করিতে লাগিলেন।