পণপূর্ব্বক দ্যূতক্রীড়া আরম্ভ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর পাণ্ডবেরা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে পুরোবর্তী করিয়া সেই সভামধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। প্রবিষ্ট হইয়াই পূজার্হ পার্থিবগণকে বিধিপূর্ব্বক পূজা করিয়া যথাক্রমে আসনে উপবেশন করিলেন। পাণ্ডবগণ ও অন্যান্য নৃপতিবর্গ অতি পবিত্র বিচিত্র আস্তরণসংযুক্ত আসনে উপবেশন করিলে শকুনি মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “হে পাৰ্থ! এই সভামধ্যে বহুবিধ লোকের সমাগম হইয়াছে, সকলেই তোমার প্রতীক্ষা করিতেছেন, এক্ষণে অক্ষক্ষেপ করিয়া দ্যূতক্ৰীড়া আরম্ভ করা আবশ্যক।” যুধিষ্ঠির কহিলেন, “দেখ, কপট পাশক্রীড়া অতি পাপীজনক, ইহাতে অণুমাত্র ক্ষত্র পরাক্রম নাই; বিবেচনা করিলে ইহাকে রাজনীতি বলিয়া প্রতিপন্ন করা যায় না; তুমি কি কারণে দ্যূতের প্রশংসা করিতেছ? ধূর্তের কপটাচারকে কেহ প্রশংসা করে না, অতএব দেখিও, হে শকুনে! তুমি যেন নৃশংসের ন্যায় অসৎপথ অবলম্বনপূর্ব্বক আমাদিগকে পরাজিত করিও না।”
শকুনি কহিলেন, “মহারাজ! যিনি গণনায় সুনিপুণ, ধূর্ততার রীতিপদ্ধতি সমুদয় সবিশেষ জানেন, তদ্বিষয়ক বহুবিধ ইতিকর্তব্যতায় আলস্যশূন্য, অক্ষক্ষেপবিষয়ে সুচতুর ও দূর্তবিদ্যায় পারদর্শী, তিনি কোন প্রকারেই পরাজিত হয়েন না। পণই পরাভবের কারণ, পরাভাবে কোনরূপ দোষ আশঙ্কা নাই, অতএব আইস, আমরা ক্রীড়া আরম্ভ করি, শঙ্কা পরিত্যাগ কর, বিলম্ব করিও না।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “সমস্ত জনসমাজদর্শী মুনিসত্তম অসিত ও দেবল কহেন যে, ধূর্তের সহিত কপট দ্যূতক্ৰীড়া করা নিতান্ত পাপীজনক কর্ম্ম ধর্ম্মতঃ যুদ্ধে জয়লাভ অপেক্ষা দ্যূতক্রীড়া কদাচ প্রশংসনীয় নহে। আৰ্য্য-লোকেরা মুখে ম্লেচ্ছভাষা ব্যবহার ও কপটাচার প্রদর্শন করেন না। অকপট যুদ্ধই সৎপুরুষের লক্ষণ। শক্ত্যনুসারে ব্রাহ্মণের উপকার-সাধনাৰ্থ যত্ন করাই আমাদিগের ধর্ম্ম। অতএব দ্যূতক্রীড়া হইতে বিরত হও। হে শকুনে! আমি শঠতা করিয়া সুখ ও ধন-প্ৰাপ্তির ইচ্ছা করি না! ধূর্ত ব্যক্তি প্রকাশ্যে সদাচারপরতন্ত্র হইলেও তাহার চরিত্ৰ কদাচ পূজিত ও প্রশংসিত হয় না।” শকুনি কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! ধূর্ততাবলম্বনপূর্ব্বক শ্রোত্রিয় শ্রোত্ৰিয়ের নিকট গমন করিয়া থাকেন, বিদ্বান মূর্খের নিকট গমন করিয়া থাকেন, সুশিক্ষিত ব্যক্তি অশিক্ষিতকে অক্ষ দ্বারা পরাজিত করয়িা থাকেন, কিন্তু এরূপ স্থলে শঠতা দোষাবহ নহে। বলবীৰ্য্যসম্পন্ন অস্ত্ৰধারী দুর্ব্বল নিরস্ত্ৰ ব্যক্তিকে ধূৰ্ততা দ্বারা প্রহার করিয়া থাকে, সুতরাং এ স্থলে ঐরূপ ধূর্ততা ধূৰ্ততাই নহে। পার্থ! যদি তুমি আমাকে নিতান্তই ধূর্ত বলিয়া স্থির করিয়াছ, যদি দূত্যক্রীড়ায় একান্ত ভীত হইয়া থাক, তাহা হইলে দ্যূত হইতে বিরত হও।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “দ্যূতে আহূত হইলে নিবৃত্ত হইব না, এই আমার নিত্যব্রত, দ্যূতক্রীড়ায় অদৃষ্টই বলবান আমিও সেই অদৃষ্টের বশীভুত, অতএব বল, এই লোকসমবায়মধ্যে কাহার সহিত ক্রীড়া করিব? আর এ স্থলে অন্য সাভিক [মূলে “সভীক” স্থলে “প্রতিপাণঃ” দেখা যায়,—অর্থ, সমানরূপে পাণরক্ষকরূপ তুল্যধনশালী। পাঠান্তর সাভিক থাকিতে পারে। সভিক শব্দের অর্থ—ধ্যতসভার অধ্যক্ষ] কে আছে? যদি থাকে, তবে ক্রীড়া আরম্ভ কর।” এই কথা শুনিয়া দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে বিশাম্পাতে! আমি সমুদয় ধন ও রত্ন প্ৰদান করিব, আমার মাতুল শকুনি আমার প্রতিনিধি হইয়া ক্রীড়া করিবেন।” যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে বিদ্বন! একজনের প্রতিনিধি হইয়া অন্যের ক্রীড়া আমার মতে নিতান্ত অসঙ্গত; যাহা হউক, ক্রীড়া আরম্ভ করা যাউক ৷”
বৈশম্পায়ন কহিলেন, দ্যূতক্রীড়া আরম্ভ হইলে সমস্ত রাজগণ ধৃতরাষ্ট্রকে অগ্ৰে করিয়া সভা প্রবেশ করিলেন। মহামতি ভীষ্ম, দ্রোণ কৃপ ও বিদুর অনতিপ্ৰসন্নমনে তাঁহাদের অনুবর্তী হইলেন। সিংহগ্ৰীব, মহাতেজাঃ, বেদবেত্তা, শূর, ভাস্বরমূর্তি ভূপতিগণের মধ্যে কতকগুলি যুগলরূপে আর কতকগুলি পৃথক পৃথকরূপে সিংহাসনে উপবিষ্ট হইলে সেই সভা অমরাধিষ্ঠিত অমরাবতীর ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। অনন্তর সুহৃর্দ্যুত আরম্ভ হইল ।
যুধিষ্ঠির দুৰ্য্যোধনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে রাজন! আমি মহামূল্য সাগরবর্ত-সম্ভূত কাঞ্চনখচিত এই মণিময় হার পণ করিলাম; তুমি যাহা দ্বারা ক্রীড়া করিবে, সে প্রতিপণের বস্তু কৈ!”
দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “আমার বহুতর মণি ও অন্যান্য ধন আছে, কিন্তু তন্নিমিত্ত অহঙ্কার করি না। সে যাহা হউক, এক্ষণে দ্যূতে জয়লাভ কর।” তদনন্তর অক্ষতত্ত্ববিং শকুনি অক্ষ গ্ৰহণ করিয়া, আমি ত’ এই জিতিলাম’ বলিয়া অক্ষবিক্ষেপ করিবামাত্র তাহারই জয় হইল।