৫৭তম অধ্যায়
অর্জ্জুন-কৃপাচার্য্য যুদ্ধ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, নরনাথ! এ দিকে মহাবীর ধনঞ্জয় কুরুসৈন্যগণ ব্যূহ রচনা করিয়াছে দেখিয়া উত্তরকে কহিলেন, “রাজপুত্র! যাঁহার ধ্বজে ঐ সুবর্ণ-দেবী দৃষ্ট হইতেছে, উঁহার দক্ষিণদিক দিয়া রথচালনা কর, তাহা হইলে অনায়াসে কৃপের সমীপে সমুপস্থিত হইতে পরিবে।” অশ্ববিদ্যা-বিশারদ উত্তর অর্জ্জুনের বিচনানুসারে মহাবেগে সেই রজতপুঞ্জসন্নিভ উদ্দীপ্ত বেগবান অশ্বগণ সঞ্চালনপূর্ব্বক কুরুসৈন্যগণ-সমীপে সমুপস্থিত হইয়া পুনরায় প্রত্যাবৃত্ত হইলেন, পরে স্বীয় শিক্ষাপ্রভাবে তৎক্ষণাৎ বামদিক দিয়া প্ৰদক্ষিণপূর্ব্বক কৌরবসেনাগণকে সম্মোহিত করিলেন এবং অকুতোভয়ে সত্বর কৃপের সন্নিধানে গমন করিয়া প্রদক্ষিণপূর্ব্বক তাঁহার সম্মুখীন হইলেন।
এইরূপে মহাবীর ধনঞ্জয় কৃপের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া আত্মপ্রকাশপূর্ব্বক মহাবেগে দেবদত্ত শঙ্খধ্বনি করিতে আরম্ভ করিলেন। পর্ব্বতের বিদারণশব্দের ন্যায় ও অশনি-নির্ঘোষের [বজ্রধ্বনি] ন্যায় পার্থের সেই শঙ্খনিনাদে আকাশমণ্ডল প্ৰতিধ্বনিত হইতে লাগিল। কৌরবগণ, “কি আশ্চৰ্য্য! এই শঙ্খ অর্জ্জুন কর্ত্তৃক আষ্মাত [শব্দিত-ধ্বনিত] হইয়াও শতধা বিদীর্ণ হইল না।” এই বলিয়া সেই শঙ্খের যথেষ্ট প্রশংসা করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর কৃপাচাৰ্য্য অর্জ্জুনের শঙ্খনাদ্যশ্রবণে যৎপরোনাস্তি রোষপরতন্ত্র হইয়া তাঁহার সহিত সংগ্রাম করিবার মানসে মহাবেগে স্বীয় শঙ্খ আষ্মাত করিয়া শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক ভয়ঙ্কর জ্যাশব্দ করিতে লাগিলেন। তৎকালে সূৰ্য্যসদৃশ তেজস্বী সেই বীরদ্বয় শরৎকালীন মেঘের ন্যায় শোভা ধারণা করিলেন।
অনন্তর মহাবল-পরাক্রান্ত কৃপ শাণিত মর্ম্মভেদী দশ বাণ দ্বারা অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিলেন; মহাবীর পার্থও গাণ্ডীব আকর্ষণপূর্ব্বক কৃপের উপর মর্ম্মভেদী নারাচ-সমুদয় নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। কৃপ নিশিত সায়ক দ্বারা অৰ্দ্ধপথে সেই অর্জ্জুন-নিক্ষিপ্ত নারাচসকল খণ্ড খণ্ড করিলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় তদর্শনে সাতিশয় অমর্ষপরবশ হইয়া বিচিত্র শরনিকর দ্বারা সমুদয় দিগ্বিগিক্ আচ্ছাদনপূর্ব্বক কৃপের উপর শত শত শর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন আচাৰ্য্য কৃপ সেই সমুদয় অগ্নিশিখার ন্যায় প্রজ্জ্বলিত নিশিত সায়ক দ্বারা সমাহত হইয়া রোষান্বিতচিত্তে পার্থের উপর দশ সহস্ৰ শর বর্ষণ করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন; পরে পুনর্ব্বার শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক আর দশ বাণ দ্বারা অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিলেন।
তখন মহাবীর ধনঞ্জয় গাণ্ডীব আকর্ষণপূর্ব্বক চারিটি বাণ দ্বারা কৃপের অশ্বচতুষ্টয়াকে বিদ্ধ করিলেন। অশ্বগণ প্রজ্জ্বলিত হুতাশন সদৃশ অর্জ্জুনশরাঘাতে নিতান্ত পীড়িত হইয়া লম্ফপ্রদান করাতে তিনি রথ হইতে নিপতিত হইলেন। তখন মহাত্মা ধনঞ্জয় কৃপকে রথমৃত্যুত নিরীক্ষণ করিয়া সম্মানরক্ষার্থ তাঁহার প্রতি শরসন্ধান করিলেন না। পরে কৃপাচাৰ্য্য পুনরায় সত্বর রথে আরোহণপূর্ব্বক অর্জ্জুনের উপর দশ বাণ নিক্ষেপ করিলেন। অর্জ্জুন কৃপের বাণাঘাতে সাতিশয় সংক্রুদ্ধ হইয়া সুতীক্ষ্ন ভল্ল প্ৰহারে তাঁহার শরাসন ছেদন করিয়া মর্ম্মভেদী অপর এক শর দ্বারা তাঁহার বর্ম্মচ্ছেদ করিলেন; কিন্তু তাঁহার শরীরে কোন আঘাত করিলেন না। অর্জ্জুনের বাণে কবচ ছিন্ন হইয়া গাত্র হইতে বিগলিত হওয়াতে আচাৰ্য্য কৃপ নির্মোক [ত্বক—খোলস]-নিমুক্ত ভুজঙ্গমের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। তখন তিনি অন্য এক শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক জ্যা আরোপণ করিলে মহাবীর অর্জ্জুন অবিলম্বে উহা ছেদন করিলেন। এইরূপে মহাবীর কৃপ যত চাপ গ্ৰহণ করিলেন, ধনঞ্জয় লঘুহস্ততাপ্রযুক্ত তৎসমুদয় ছেদন করিলেন।
পরাজিত কৃপের পলায়ন
বারংবার কার্মুক ছিন্ন হওয়াতে কৃপাচাৰ্য্য ক্রোধাভরে অর্জ্জুনের প্রতি অশনির ন্যায় প্রদীপ্ত এক স্বর্ণ-বিভূষিত শক্তি [চক্র-চাকা] নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন নিশিত দশ সায়ক দ্বারা অৰ্দ্ধপথে সেই শক্তি দশখণ্ডে ছেদন করিলেন। মহাবীর কৃপ শক্তি ব্যর্থ হইল দেখিয়া পুনর্ব্বার ধনুগ্রহণপূর্ব্বক নিশিত দশ সায়ক দ্বারা পার্থকে বিদ্ধ করিলেন, তখন মহাবল পরাক্রান্ত ধনঞ্জয়, রোষাপরবশ হইয়া কৃপের উপর ত্রয়োদশ শর নিক্ষেপপূর্ব্বক এক বাণে তাঁহার যুগ, চারি বাণে চারি অশ্ব, ছয় বাণে সারথির মস্তক, তিন বাণে তিন বেণু দুই বাণে অক্ষ ও দ্বাদশ ভল্ল দ্বারা ধ্বজ ছেদন করিলেন; পরে সহাস্যবদনে বজ্রসদৃশ ত্ৰয়োদশ বাণে কৃপের বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিলেন।
মহাবীর কৃপাচাৰ্য্য এইরূপে ছিন্নশরাসন, বিরথ, হতাশ্ব ও হতসারথি হইয়া ক্ৰোধাভরে অর্জ্জুনের প্রতি গদা নিক্ষেপ করিলেন। মহাতেজঃ ধনঞ্জয় বাণ দ্বারা সেই গদা প্রতিনিবৃত্ত করিলে অন্যান্য যোদ্ধগণ কৃপের সাহায্যার্থে চতুর্দ্দিক হইতে অর্জ্জুনের উপর শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিল। তখন বিরাটতনয় উত্তর বামদিক দিয়া যমকমণ্ডল [বিপক্ষের আক্রমণ নিরোধক চক্রাকারে ভ্ৰমণ] করিয়া সেই সমুদয় যোদ্ধাদিগকে নিবারিত করিতে লাগিলেন। ধনুৰ্দ্ধরগণ তদ্দর্শনে ভীতচিত্তে কৃপকে লইয়া মহাবেগে সে স্থান হইতে পলায়ন করিল।