দূতে ধৃতরাষ্ট্রের পুন-প্রতিবাদ
শকুনি কহিলেন, “হে দুৰ্য্যোধন! পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠিরের এতাদৃশী সম্পত্তি দেখিয়া যদি নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়া থাক, তবে বল, দূত্যক্ৰীড়া দ্বারা তদীয় সমস্ত আত্মসাৎ করি। এক্ষণে তাঁহাকে দূতে আহ্বান কর, আমি অক্ষনিক্ষেপপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরকে পরাজয় করিব। আমি অক্ষাবিদ্যায় সবিশেষ দক্ষতা লাভ করিয়াছি। যুধিষ্ঠির তদ্বিষয়ে অতিমাত্র অনভিজ্ঞ। পণ আমার ধনু, অক্ষ শর, অক্ষ-হৃদয় [পাশার উপর পোয়া দুয়া প্রভৃতি চিহ্ন] জ্যা ও হৃদয়স্ফূর্তি [ঘুঁটি চালিয়া পাশার কোটে উপযুক্ত স্থানে রাখা] মদীয় রথস্বরূপ।”
দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “মহারাজ! অক্ষবিশারদ মাতুল দূত দ্বারা পাণ্ডুপুত্ৰ হইতে রাজলক্ষ্মী হরণ করিতে উৎসাহিত হইয়াছেন; আপনি অনুমতি করুন।” ধৃতরাষ্ট্ৰ কহিলেন, “আমি মহাত্মা বিদুরের শাসনানুবর্তী; অতএব তাহার সহিত মিলিত হইয়া কর্তব্যাবধারণ করিব।” দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “মহাশয়! বিদুর যেরূপ পাণ্ডবগণের হিতৈষী, সেরূপ আমার হিতাভিলাষী নহেন, অতএব তিনি আপনার বৃদ্ধির অন্যথা করিবেন, সন্দেহ নাই। বিশেষতঃ পৌরুষশালী ব্যক্তি পরমার্থের সাপেক্ষ হইয়া স্বকাৰ্য্যসাধনে প্রবৃত্ত হয়েন না। কর্তব্যানুষ্ঠানবিষয়ে দুই জনের বৃদ্ধি সমান হওয়া নিতান্ত দুর্ঘট। মূঢ় ব্যক্তি নির্ভর হইয়া আত্মরক্ষা করিয়া বর্ষাকালীন আদ্রতৃণের ন্যায় অবসন্ন হইয়া যায়। কি ব্যাধি, কি মৃত্যু, কেহই শ্ৰেয়ঃপ্রাপ্তির নিমিত্ত প্রতীক্ষা করে না, অতএব ভবিষ্যৎকালের অপেক্ষা না করিয়াই শ্রেয়স্কর কর্মের অনুষ্ঠান করা কর্তব্য।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে পুত্র! বলবান ব্যক্তিগণের সহিত যুদ্ধ করা কোনরূপেই আমার অভিপ্রেত নহে, কারণ, বৈরভাব হইতে বিকার জন্মে; সেই বিকার অলৌহ-নির্মিত শস্ত্রস্বরূপ। বৎস! তুমি যে এই অনর্থকর সংগ্ৰামঘটনাকে উপযুক্ত বলিয়া মনে করিতেছি, এই অনবধানতা হইতেই শাণিত সায়ক ও অসি নিষ্কাশিত হইবে।” দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “পূর্ব্বতন ব্যক্তিরা দ্যূতব্যবহার করিতেন, তাহাতে কোন বিকৃতি বা সংগ্ৰামঘটনার সম্ভাবনা ছিল না; অতএব মাতুল বচনে অনুমোদন করিয়া অদ্য সভানির্ম্মাণের অনুমতি করুন। দুরোদরক্ৰীড়া ক্রীড়মান ও তদনুবর্তীদিগের স্বর্গের দ্বারস্বরূপ; অতএব পাণ্ডবগণের সহিত অক্ষক্রীড়া করা অবৈধ নহে ।
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “নরেন্দ্র! তুমি যাহা কহিতেছ, তাহা আমার শ্রেয়োবোধ হইতেছে না। তোমার অভিরুচি হয়, কর, কিন্তু যেন ভবিষ্যতে অনুতাপ করিতে না হয়। মেধাবী বিদুর বিদ্যাবুদ্ধিপ্রভাবে এই সকল বিষয় প্রত্যক্ষ করিয়াছেন যে, যে সকল ব্যক্তি বশংবদ নহে, ক্ষত্ৰিয়ান্তক মহৎ ভয় তাহাদের সমীপবর্তী।”
দ্যূতে অনুমোদন—ক্রীড়াগৃহনির্ম্মাণ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে জনমেজয়! রাজা ধৃতরাষ্ট্র দূরগাহ দৈবের প্রতিকূলতাপ্রযুক্ত দুৰ্য্যোধনের মতানুসারে ভৃত্যবৰ্গকে আদেশ করিলেন, “তোমরা সহস্রস্তম্ভশোভিত, হেমবৈদূর্য্যখচিত, শতদ্বারবিশিষ্ট, ক্রোশায়ত, তোরণস্ফটিকা নামে এক মহতী সভা শীঘ্র নির্ম্মাণ কর।” সুনিপুণ শিল্পীগণ অনুমতি পাইয়া অতি শীঘ্র সভা নির্ম্মাণ করিয়া সমুচিত দ্রব্যসামগ্ৰীতে সুসজ্জিত করিয়া আহ্লাদিতচিত্তে ধৃতরাষ্ট্রকে নিবেদন করিল, “মহারাজ! স্বল্পকাল মধ্যেই সভা সুসম্পন্ন, বহুরত্নে খচিত ও বিচিত্ৰ হেমাসনে শোভিত হইয়াছে।” তদনন্তর ধৃতরাষ্ট্র মন্ত্রিপ্রধান বিদুরকে কহিলেন, “তুমি শীঘ্ৰ ইন্দ্রপ্রস্থে গমন করিয়া যুধিষ্ঠিরকে আনয়ন কর। তিনি ভ্রাতৃগণের সহিত এই সভায় সমাগত হইয়া সুহৃদ্যুতে প্রবৃত্ত হউন।”