৫৪তম অধ্যায়
উতঙ্কনিকটে কৃষ্ণের অধ্যাত্মতত্ত্ব-কথন
বৈশম্পায়ন বলিলেন, মহাত্মা বাসুদেব এই কথা কহিলে, উতঙ্ক তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “কেশব! তুমি অচিরাৎ আমার নিকট অধ্যাত্মতত্ত্ব কীৰ্ত্তন কর, আমি উহা শ্রবণ করিয়া হয় তোমার মঙ্গল বিধান, না হয় তোমাকে অভিশাপ প্রদান করিব।”
তখন বাসুদেব কহিলেন, “তপোধন! সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিন ভিন্নভাব আমাকেই আশ্রয় করিয়া রহিয়াছে। আর রুদ্র, বসু, অপ্সরা, দৈত্য, যক্ষ, গন্ধৰ্ব্ব, রাক্ষস ও নাগগণ আমা হইতে উৎপন্ন হইয়াছে। ভূতসমুদয় আমাকে আশ্রয় করিয়া রহিয়াছে এবং আমিও সৰ্ব্বভূতে অবস্থান করিতেছি। সৎ, অসৎ, অব্যক্ত, ক্ষর, অক্ষর এবং আশ্রমচতুষ্টয়ের ধর্ম্ম ও বৈদিক কৰ্ম্ম এই সমস্তই আমার স্বরূপ। আমি দেবতাদিগেরও দেবতা এবং নিত্য। আমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আর কেহই নাই। আমিই ওঙ্কারপ্রমুখ বেদ, ধূপ, সোম, চরু, দেবগণের তৃপ্তিকর হোম, হোতা, হব্য, অধ্বর্য্যু ও সদস্য। যজ্ঞকালে উদ্গাতা সামগানদ্বারা আমাকেই স্তব করিয়া থাকেন। শান্তিমঙ্গলবাচক মহাত্মারা প্রায়শ্চিত্তকালে নিরন্তর আমাকেই স্তব করিবেন। সৰ্ব্বভূতে দয়ারূপ প্রধান ধর্ম্ম আমার সৰ্ব্বজ্যেষ্ঠ প্রিয় মানসপুত্র। আমি সেই ধৰ্ম্মরক্ষাৰ্থ ত্রিলোকমধ্যে ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মাদিগের সহিত বিবিধ রূপপরিগ্রহ করিয়াছি ও করিতেছি।
“আমিই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও ইন্দ্রস্বরূপ এবং আমিই ভুতসমূহের সৃষ্টিকর্ত্তা ও সংহর্ত্তা। আমি যুগে যুগে নানাপ্রকার দেহপরিগ্রহ করিয়া ধৰ্ম্মসংস্থাপন ও অধাৰ্ম্মিকদিগকে সংহার করিয়া থাকি। আমি যখন দেবযোনিতে অবস্থান করি, তখন দেবতার ন্যায়, যখন গন্ধৰ্ব্বযোনিতে অবস্থান করি, তখন গন্ধৰ্ব্বের ন্যায়, যখন নাগযোনিতে অবস্থান করি, তখন নাগের ন্যায় এবং যখন যক্ষ ও রাক্ষসযোনিতে অবস্থান করি, তখন যক্ষ ও রাক্ষসের ন্যায় ব্যবহার করিয়া থাকি। এক্ষণে আমি মনুষ্যযোনিতে জন্মপরিগ্রহ করিয়া মনুষ্যের ন্যায় ব্যবহার করিতেছি। আমি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আরম্ভ হইবার পূর্ব্বে কৌরবগণের নিকট অতি দীনভাবে সন্ধিস্থাপনের নিমিত্ত প্রার্থনা করিয়াছিলাম; কিন্তু তাহারা মোহের বশবর্ত্তী হইয়া আমার বাক্যে কর্ণপাতও করে নাই। পরিশেষে আমি ক্রোধাবিষ্ট হইয়া তাহাদিগকে নানা প্রকার ভয়প্রদর্শনও করিয়াছিলাম। সেই অধর্ম্মপরায়ণ দুরাত্মারা তাহাতেও সন্ধিস্থাপনে সম্মত হয় নাই। এক্ষণে তাহারা ধৰ্ম্মযুদ্ধে নিহত হইয়া স্বর্গে গমন করিয়াছে এবং পাণ্ডবেরা ধর্ম্মপরায়ণতানিবন্ধন ত্রিলোকমধ্যে খ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছেন। হে তপোধন! এই আমি আপনার নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিলাম।”