৫৩তম অধ্যায়
সঙ্কুলযুদ্ধ–কৌরবপরাজয়
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ। তখন সেই পরস্পরজয়াভিলাষী কৃতবৈর [শত্রুভাবাপন্ন] ক্ষত্রিয়গণ পরস্পরকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। হস্তী, অশ্ব, রথ ও নরগণ পরস্পর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল। সেই ভীষণ সংগ্রামে পরস্পরবিক্ষিপ্ত গদা, পরিঘ, কুণপ, প্রাস, ভিন্দিপাল ও ভূশুণ্ডী প্রভৃতি অস্ত্রসকল পতঙ্গকুলের ন্যায় চতুর্দ্দিকে নিপতিত হইতে লাগিল। মাতঙ্গগণ মাতঙ্গদিগকে, অশ্বগণ অশ্বদিগকে, রথীগণ রথীদিগকে, পদাতিগণ হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিদিগকে, রথীগণ হস্তী ও অশ্বগণকে এবং দ্রুতগামী কুঞ্জরগণ হস্তী, অশ্ব ও রথসমুদয়কে বিমর্দ্দিত করিতে আরম্ভ করিল। বীরগণ চীৎকার করিয়া পরস্পর সংহারে প্রবৃত্ত হইলে সংগ্রামস্থল পশুবিনাশস্থলের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। তৎকালে চতুর্দ্দিক রুধিরাক্ত হইলে বসুন্ধরা কুসুম্ভরাগরঞ্জিত বসনধারিণী যুবতী কামিনীর ন্যায় শোভাধারণ করিল। তখন উহা সুবর্ণময় বা বর্ষাকালীন ঈন্দ্রগোপ [একপ্রকার কীট] সমাকীর্ণ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। বীরগণের মস্তক, বাহু, উরু, কুণ্ডল ও নিষ্ক প্রভৃতি ভূষণ, চর্ম্ম এবং দেহসমুদয় অনবরত নিপতিত হইতে লাগিল। মাতঙ্গগণ পরস্পর দন্তাঘাতে বিদীর্ণ ও রুধিরাক্তকলেবর হইয়া ধাতুধারাস্রাবী গৈরিকপর্ব্বতের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। কোন কোন মাতঙ্গ তোমরসমুদয়ের উপর শুণ্ড নিক্ষেপ এবং কোন কোনটা তোমরসকল চূর্ণ করিতে লাগিল। কোন কোন হস্তী নারাচাস্ত্রে ছিন্নবর্ম্ম হইয়া, হিমাগমে মেঘনির্ম্মুক্ত মহীধরের ন্যায় এবং সুবৰ্ণপুঙ্খ শরনিকরে চিত্রিত হইয়া উল্কাপ্রদীপ্ত পৰ্বতশৃঙ্গের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। কোন কোন পৰ্বতাকার মাতঙ্গ পরস্পরের আঘাতে আহত হইয়া পক্ষযুক্ত অচলের ন্যায় পঞ্চত্বপ্রাপ্ত, কোন কোনটা শল্যদ্বারা নিপীড়িত ও একান্ত ব্যথিত হইয়া মহাবেগে ধাবমান এবং কোন কোনটা দন্ত ও কুম্ভদ্বারা ভূতল স্পর্শ করিয়া নিপতিত হইল। অন্যান্য মাতঙ্গগণ সিংহের ন্যায় ভীষণ শব্দ ও ভ্রমণ করিতে লাগিল। সুবর্ণভূষণবিভূষিত অশ্বগণও শরনিকরে নিপীড়িত হইয়া অবসন্ন, ম্লান ও উদভ্রান্ত হইয়া উঠিল। কতকগুলি অশ্বতর শর ও তোমরের আঘাতে ভূতলে নিপতিত হইয়া নানাপ্রকার রঙ্গভঙ্গী করিতে লাগিল। মানবগণ ভূতলে নিপাতিত হইয়া কেহ কেহ পিতা, পিতামহ ও বন্ধুগণকে এবং কেহ কেহ ধাবমান অরাতিগণকে অবলোকন করিয়া পরস্পর পরস্পরের বিখ্যাত নাম ও গোত্র জিজ্ঞাসা করিতে আরম্ভ করিল। তাহাদের সুবর্ণভূষণালঙ্কৃত ছিন্ন বাহুসমুদয় কখন উদ্ভ্রান্ত, কখন বিচেষ্টিত, কখন পতিত, কখন উত্থিত ও কখন কম্পিত হইতে লাগিল এবং কতকগুলি পঞ্চমুখ পন্নগের ন্যায় বেগে বিলুণ্ঠিত হইল। সেই চন্দনদিগ্ধ, ভুজঙ্গাকার ভুজসমুদয় রুধিরাক্ত হওয়াতে সুবর্ণধ্বজের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল।
“হে মহারাজ। এইরূপে চারিদিকে সেই ঘোরতর সঙ্কুলসংগ্রাম উপস্থিত হইলে সৈন্যগণ পরস্পর পরিজ্ঞাত না হইয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল। সমুত্থিত ধূলিপটল ও শরনিকরে চতুর্দ্দিক আচ্ছন্ন হইলে কাহারও আর আত্মপর বিবেচনা রহিল না। সেই ঘোরতর ভীষণ সংগ্রামসময়ে বারংবার সুদীর্ঘ শোণিতনদীসকল প্রবাহিত হইতে লাগিল। মস্তকসকল উহাদের পাষাণ, কেশকলাপ শৈবাল ও শাদ্বল [ঘাস], অস্থি, মীন, শর শরাসন ও গদাসকল ভেলা এবং মাংস উহার পঙ্কস্বরূপ হইল। অনেকেই সেই ভীরুজনবিত্ৰাসক [ভীতজনের ভয়কারক] ও শূরজনহর্ষবর্দ্ধন [বীরগণের আনন্দবর্দ্ধক] ভীষণ নদীতে নিমগ্ন হইয়া প্রাণত্যাগ করিতে লাগিল।
“ঐ সময় ব্যাদগণ চতুর্দ্দিকে ঘোরতর নিনাদ করিতে আরম্ভ করিলে রণস্থল যমালয়ের ন্যায় ভয়ানক হইয়া উঠিল। চতুর্দ্দিকে অসংখ্য কবন্ধ [মস্তকহীনদেহ-দেহ মস্তকহীন হইলেও তাহারা হাত তুলিয়া যুদ্ধ করিত। মার্কণ্ডেয় পুরাণের কবন্ধকথা–“কবন্ধা যুযুধুদের্ব্যা” ‘কবন্ধগণ দেবীর সহিত যুদ্ধ করিত।’ কবন্ধ সম্বন্ধে রামায়ণে উল্লিখিত আছে—যুদ্ধক্ষেত্রে এক অযুত গজ, দশ অযুত অশ্ব, ১ শত ৫০ খানা রথ এবং দশ কোটি পদাতিকসৈন্য বিনষ্ট হইলে একটি কবন্ধ উত্থিত হয়; “নাগান্যমযুত্যং তুরঙ্গনিযুতং সার্দ্ধাং রথানাং শতং পত্তীনাং দশকোটয়োনিপনিতা একঃ কবন্ধে রণে”] সমুত্থিত হইল। ভূতগণ মাংস, শোণিত ও বসাপানে পরম পরিতুষ্ট হইয়া নৃত্য করিতে আরম্ভ করিল। কাক, গৃধ্র ও বকসমুদয় মেদ, মজ্জা, বসা ও মাংসভক্ষণে মত্ত হইয়া ইতস্ততঃ বিচরণ করিতে লাগিল। শূরগণ সেই ভীষণ সময়েও যোদ্ধার সমুচিত ব্ৰত অবলম্বনপূর্ব্বক দুষ্পরিহার্য্য ভয় পরিত্যাগ করিয়া সেই শরশক্তিসমাকুল ক্ৰব্যাদগণসঙ্কীর্ণ সমরাঙ্গনে স্বীয় স্বীয় পৌরুষ প্রকাশ করিয়া নির্ভয়ে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিলেন। অসংখ্য যোধ চতুর্দ্দিক হইতে পরস্পরকে পিতৃনাম, গোত্ৰনাম ও স্বীয় নাম শ্রবণ করাইয়া শক্তি, তোমর ও পট্টিশদ্বারা পীড়ন করিতে লাগিল। হে মহারাজ! এইরূপে সেই ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইলে কৌরবসেনাসকল সমুদ্রস্থ ভগ্ন তরীর ন্যায় অবসন্ন হইয়া পড়িল।”