৫২তম অধ্যায়
ভীমকরে বিবিৎসুপ্রমুখ ধৃতরাষ্ট্রতনয় বধ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! ভীমসেন মহাবাহু কর্ণকে রথোপরি পাতিত করিয়া অতি দুষ্কর কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছেন। দুৰ্য্যোধন বারংবার আমাকে কহিয়াছিল যে, কর্ণ একাকী সংগ্রামে সমুদয় সৃঞ্জয় ও পাণ্ডবগণকে সংহার করিবে। এক্ষণে সে বৃকোদরকর্ত্তৃক রাধেয়কে পরাজিত অবলোকন করিয়া কি উপায় অবলম্বন করিল?”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! দুৰ্য্যোধন সূতনন্দনকে সমরবিমুখ দেখিয়া সহোদরদিগকে কহিলেন, ‘হে ভ্রাতৃগণ! তোমরা শীঘ্র গমন করিয়া অগাধ ব্যসনার্ণবে [গভীর বিপদসাগরে] নিমগ্ন রাধেয়কে রক্ষা কর।’ আপনার পুত্রগণ জ্যেষ্ঠ সহোদরকর্ত্তৃক এইরূপে অনুজ্ঞাত হইয়া, পতঙ্গগণ যেমন পাবকের অভিমুখে আগমন করে, তদ্রূপ বৃকোদরের বিনাশবাসনায় সরোষনয়নে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবলপরাক্রান্ত, চাপতূণীরকবচধারী, শ্রুতবান্[ধনুৰ্বেদবিৎ], দুর্দ্ধর্ষ ক্ৰাথ, বিবিৎসু, বিকট, সম, নন্দ, উপনন্দ, দুধ, সুবাহু, বাতবেগ, সুবৰ্চা, ধনুগ্ৰাহ, দুর্ম্মদ, জলসন্ধ, শল্য সহ—ইঁহারা অসংখ্যরথে পরিবৃত হইয়া চতুর্দ্দিক্ হইতে ভীমসেনকে পরিবেষ্টন করিয়া তাঁহার উপর বিবিধ শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন আপনার পুত্রগণকর্ত্তৃক এইরূপে নিপীড়িত হইয়া সত্বর তাহাদের পক্ষীয় পঞ্চদশ রথী ও পঞ্চাশৎ রথ বিনষ্ট করিয়া ভল্লদ্বারা বিবিৎসুর কুণ্ডলমণ্ডিত শিরস্ত্রাণসম্বলিত পুর্ণচন্দ্রসন্নিত মস্তক ছেদন করিয়া ফেলিলেন। আপনার অন্যান্য পুত্রগণ মহাবীর বিবিৎসুকে নিহত দেখিয়া ভীমপরাক্রম ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন অরাতিনিপাতন বৃকোদর অন্য দুই ভল্লদ্বারা বিকট ও সমনামক আপনার আর দুই পুত্রের প্রাণ সংহার করিলেন। সেই দেবপুত্রসদৃশ বীরদ্বয় বায়ুভগ্ন বৃক্ষের ন্যায় ধরাশায়ী হইলেন। অনন্তর মহাবীর ভীমসেন সত্বর সুতীক্ষ্ণ নারাচদ্বারা ক্ৰাথকে নিহত করিয়া ভূতলে পাতিত করিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে আপনার ধনুর্দ্ধর পুত্রগণ নিহত হইলে সমরাঙ্গনে মহান্ হাহাকার শব্দ সমুত্থিত হইল। তখন মহাবলপরাক্রান্ত বৃকোদর পুনরায় নন্দ ও উপনন্দকে নিপাতিত করিলেন। তদ্দর্শনে আপনার তনয়গণ রথস্থ ভীমসেনকে কালান্তক যমের ন্যায় জ্ঞান করিয়া নিতান্ত ভীত ও বিহুল হইয়া পলায়ন করিতে লাগিলেন।
পুনঃ কর্ণ-ভীমসমর
“হে মহারাজ! ঐ সময় সূতপুত্র কর্ণ আপনার পুত্রগণকে নিহত নিরীক্ষণপূর্ব্বক নিতান্ত দুর্ম্মনা হইয়া পুনরায় ভীমসেনের অভিমুখে রথচালন করিতে আদেশ করিলেন। মদ্ররাজ কর্ণের আদেশানুসারে হংসবর্ণ অশ্বগণকে পরিচালিত করিতে আরম্ভ করিলে তাহারা মহাবেগে ধাবমান হইয়া অবিলম্বে ভীমসেনের রথসমীপে সমুপস্থিত হইল। অনন্তর কর্ণ ও ভীমসেনের অতি ভয়ঙ্কর তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল। হে মহারাজ! আমি তাৎকালে মহারথ কর্ণ ও ভীমসেনকে সংগ্রামে সমবেত দেখিয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলাম, না জানি, অদ্য এই বীরদ্বয়ের কিরূপ সংগ্রাম হইবে। অনন্তর সমরনিপুণ ভীমসেন আপনার পুত্রগণের সমক্ষে কর্ণকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন; পরমাস্ত্রজ্ঞ কর্ণও কোপাবিষ্ট হইয়া নতপৰ্ব্ব নয় ভল্লদ্বারা ভীমসেনকে বিদ্ধ করিলেন। ভীমপরাক্রম মহাবাহু ভীমসেন সূতপুত্রের শরে তাড়িত হইয়া আকর্ণপূর্ণ সাতবাণে তাঁহাকে সমাহত করিলেন, কর্ণও ভুজঙ্গমের ন্যায় নিশ্বাসপরিত্যাগ করিয়া শরবর্ষণে তাঁহাকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবল বৃকোদর কৌরবগণের সমক্ষে মহারথ রাধেয়কে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিয়া সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। কর্ণ ভীমের শরাঘাতে ক্রোধান্বিত হইয়া শরাসন দৃঢ়রূপে গ্রহণ ও বৃকোদরের প্রতি শিলানিশিত দশ বাণ নিক্ষেপপূর্ব্বক নিশিতভল্লদ্বারা তাঁহার শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবাহু ভীমসেন কর্ণের নিধনবাসনায় এক হেমপট্টবিভূষিত, দ্বিতীয় যমদণ্ডসদৃশ ঘোরতর পরিঘ গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি নিক্ষেপ করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। সূতনন্দনও তৎক্ষণাৎ অসংখ্য আশীবিষোপম শরনিকরে সেই অশনির ন্যায় শব্দায়মান সমাগত পরিঘ খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর বৃকোদর দৃঢ়তর শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক শনিসূদন কর্ণকে বিশিখজালে সমাচ্ছন্ন করিলেন।
ভীমের ভীষণ প্রহারে কৌরবপলায়ন
“হে মহারাজ! অনন্তর পরস্পর বধেচ্ছু সিংহদ্বয়ের ন্যায় মহাবীর কর্ণ ও ভীমসেনের পূর্ব্বাপেক্ষা ঘোরতর সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। মহাবীর কর্ণ শরাসন আকর্ণ আকর্ষণ করিয়া তিনবাণে ভীমসেনকে বিদ্ধ করিলেন। মহাধনুর্দ্ধর বলবান্ বৃকোদর কর্ণশরে বিদ্ধ হইয়া এক দেহবিদারণ বিষম বিশিখ গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহার উপর নিক্ষেপ করিলে, উহা সূতপুত্রের বর্ম্ম ছেদন ও শরীর ভেদ করিয়া বল্মীকান্তৰ্গামী পন্নগের ন্যায় ধরণীতলে প্রবিষ্ট হইল। মহাবীর কর্ণ ভীমের শরাঘাতে নিতান্ত ব্যথিত ও বিহুল হইয়া ভূমিকম্পকালীন অচলের ন্যায় বিকশিত হইতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি একান্ত রোষপরতন্ত্র হইয়া ভীমসেনকে পঞ্চবিংশতি নারাচে বিদ্ধ ও অসংখ্য শরে নিপীড়িত করিয়া একবাণে তাহার ধ্বজ ছেদন ও ভল্লদ্বারা সারথিকে শমনভবনে প্রেরণ করিলেন এবং মুহূর্ত্তমধ্যে অবলীলাক্রমে তাঁহার শরাসন ছিন্ন ও রথ ভগ্ন করিয়া হাস্য করিতে লাগিলেন। তখন মহাবাহু বৃকোদর গদা গ্রহণপূর্ব্বক সেই ভগ্ন স্যন্দন হইতে মহাবেগে ভূতলে অবতীর্ণ হইয়া, বায়ু যেমন শরৎকালীন মেঘ সঞ্চালিত করে, তদ্রূপ গদাপ্রহারে কৌরবসেনাগণকে বিভ্রাবিত করিলেন এবং ঈষাদ সপ্তশত মাতঙ্গগণকে সহসা বিদ্ৰাবিত করিয়া তাহাদের দস্তাবেষ্টন, নেত্র, কুম্ভ, গণ্ড ও মর্ম্মে অতিশয় আঘাত করিতে লাগিলেন। তাহারা ভীমসেনের ভীষণপ্রহারে ভীত হইয়া প্রথমতঃ ইতস্ততঃ ধাবমান হইল; কিন্তু মহামাত্রগণকর্ত্তৃক প্রেরিত হইয়া পুনরায় ভীমসেনের অভিমুখে গমনপূর্ব্বক মেঘমণ্ডল যেমন দিবাকরকে পরিবেষ্টন করে, তদ্রূপ তাহাকে বেষ্টন করিল। তখন অরাতিঘাতন ভীমসেন ইন্দ্র যেমন বজ্ৰদ্বারা অচল সংচূর্ণিত করেন, তদ্রূপ গদাঘাতে সেই সপ্তশত মাতঙ্গ নিহত করিলেন; তৎপরে পুনর্ব্বার শকুনির মহাবলপরাক্রান্ত দ্বিপঞ্চাশৎ হস্তী বিপ্রোথিত করিয়া কৌরবপক্ষীয় একশত রথ ও শত শত পদাতিকে সংহারপূর্ব্বক সৈন্যগণকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! আপনার সেনাগণ এইরূপে মহাত্মা ভীমসেনের প্রভাবে ও সূর্য্যের প্রতাপে নিতান্ত সন্তপ্ত ও অনলার্পিত চর্ম্মের ন্যায় সঙ্কুচিত হইয়া ভীমভয়ে সমর পরিত্যাগপূর্ব্বক দশদিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল।
“তখন অন্যান্য চর্ম্মবৰ্মধারী পঞ্চশত রথী শরনিকর নিক্ষেপ করিয়া ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইলেন; মহাবীর বৃকোদর অসুরবিনাশন বিষ্ণুর ন্যায় গদাঘাতে সেই ধ্বজপতাকায়ুধসম্বলিত বীরগণকে বিপ্রোথিত করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর মহাবলপরাক্রান্ত ত্রিসহস্র অশ্বারোহী শকুনির আদেশানুসারে শক্তি, ঋষ্টি ও প্রাস গ্রহণপূর্ব্বক বৃকোদরের অভিমুখে ধাবমান হইল; অরাতিনিপাতন ভীমসেনও মহাবেগে তাহাদের অভিমুখীন হইয়া বিবিধমার্গে বিচরণপূর্ব্বক গদাপ্রহারে তাহাদিগকে বিমর্পিত করিলেন। তখন প্রস্তরনিপীড়িত গজযূথের ন্যায় তাহাদিগের সুমহান্ আর্ত্তনাদ হইতে লাগিল। হে মহারাজ! কোপাবিষ্ট পাণ্ডব এইরূপে সুবলপুত্রের ত্রিসহস্র অশ্বারোহী বিনষ্ট করিয়া অন্য রথে আরোহণপূর্ব্বক মহাবেগে কর্ণের প্রতি ধাবমান হইলেন।
পলায়মান যুধিষ্ঠিরের ভীমসাহায্য-সঙ্কুলযুদ্ধ
“ঐ সময় মহাবীর কর্ণ অরাতিঘাতন ধর্ম্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন ও তাঁহার সারথিকে নিপাতিত করিলেন। মহারথ যুধিষ্ঠির কর্ণের রথ নিরীক্ষণপূর্ব্বক পলায়ন করিতে লাগিলেন; সূতপুত্রও ধর্ম্মরাজের প্রতি অবক্র শরজালবর্ষণপূর্ব্বক শরনিকরে রোদসী সমাবৃত করিয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। তখন পবননন্দন ভীমসেন কর্ণকে যুধিষ্ঠিরের অনুধাবন করিতে দেখিয়া রোষাবিষ্টচিত্তে সূতপুত্রকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন; শত্রকর্ষণ কর্ণও তৎক্ষণাৎ প্রতিনিবৃত্ত হইয়া শাণিতশরজালে ভীমসেনকে সমাবৃত করিলেন। তখন মহাবীর সাত্যকি ভীমের পার্ষ্ণিগ্রহণ নিমিত্ত তাঁহার রথসমীপস্থ কর্ণকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন। কর্ণ শরনিকরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়াও ভীমের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন সর্ব্বধনুর্দ্ধরশ্রেষ্ঠ বীরদ্বয় পরস্পর মিলিত হইয়া অনবরত শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তাঁহাদিগের ক্রৌঞ্চপৃষ্ঠের ন্যায় অরুণবর্ণ ভীষণ শরনিকর সমন্তাৎ বিকীর্ণ হওয়াতে সমুদয় দিকবিদিক সমাচ্ছন্ন ও দিবাকর আকাশমণ্ডলমধ্যগত হইলেও, তাঁহার প্রভা তিরোহিত হইয়া গেল। হে মহারাজ! ঐ সময় কৌরবগণ শকুনি, কৃতবর্ম্মা, অশ্বত্থামা, কর্ণ ও কৃপকে পাণ্ডবদিগের সহিত মিলিত দেখিয়া পুনর্ব্বার সংগ্রামার্থ আগমন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবৃষ্টিসমুকৃত সাগরের ন্যায় তাঁহাদিগের তুমুল কোলাহল সমুত্থিত হইল। অনন্তর উভয়পক্ষীয় সেনাগণ পরস্পরকে দর্শন ও গ্রহণপূর্ব্বক আহ্লাদিতচিত্তে পরস্পর মিলিত হইতে লাগিল। হে রাজ! সেই মধ্যাহ্নসময় উভয়পক্ষে যেরূপ সংগ্রাম হইয়াছিল, তদ্রূপ যুদ্ধ কখনই আমাদের দৃষ্টিগোচর বা শ্রবণগোচর হয় নাই। বেগবান্ জলরাশি যেমন সাগরের সহিত মিলিত হয়, তদ্রূপ কৌরবসেনাগণ পাণ্ডবসেনাগণের সহিত মিলিত হইল। এইরূপে সেই উভয়পক্ষীয় সেনানদীদ্বয় একত্র সমবেত হইলে তাহাদের পরস্পরনিক্ষিপ্ত শরজালের তুমুল শব্দ হইতে লাগিল।
“অনন্তর যশোলোলুপ কৌরব ও পাণ্ডবগণের তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল। উভয়পক্ষীয় বীরগণ পরস্পরের নামোচ্চারণপূর্ব্বক অবিশ্রান্ত বিবিধ বাক্য প্রয়োগ করিতে লাগিল। যে ব্যক্তির পিতৃগত, মাতৃগত, কর্ম্মগত বা স্বভাবগত যে কিছু দোষ ছিল, প্রতিপক্ষেরা তাহাকে তৎসমুদয় শ্রবণ করাইতে আরম্ভ করিল। হে মহারাজ! আমি ঐ সময়ে সমরাঙ্গনে বীরগণকে পরস্পর তর্জন করিতে দেখিয়া তাঁহাদিগকে হতজীবিত বলিয়া জ্ঞান করিতে লাগিলাম এবং সেই অমিততেজাঃ ক্রোধান্বিত বীরগণের শরীর সন্দর্শনপূর্ব্বক ভীত হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলাম -না জানি, আজ কি কাণ্ড উপস্থিত হইবে! অনন্তর মহারথ পাণ্ডব ও কৌরবগণ নিশিতশরনিকরে পরস্পরকে নিপীড়িত ও ক্ষতবিক্ষত করিতে লাগিলেন।”