ধৃতরাষ্ট্রের উত্তেজনার্থ দুৰ্য্যোধনের শেষচেষ্টা
দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “মহারাজ! তথায় আরও দেখিলাম, মহাব্রত, বিনয়সম্পন্ন, মহামান্য, ধর্ম্মাত্ম রাজারা যুধিষ্ঠিরকে উপাসনা করিতেছেন। দক্ষিণাদানার্থ কোন কোন রাজা বহু সহস্ৰসংখ্যক আরণ্যক ধেনু আনয়ন করিয়াছেন। কেহ কেহ অভিষেকাৰ্থ মঙ্গল-কলস স্বয়ংই বহন ও আনয়ন করিতেছেন। বাহ্লীক সুবর্ণালস্কৃত রথ এবং সুদক্ষিণ [সুদৰ্শন-সুলক্ষণ] শ্বেতকায় কাম্বোজ-দেশীয় অশ্ব আহরণ করিয়াছেন। মহাবল সুনীথ প্রীতিপূর্ব্বক রথাধঃস্থিত কাষ্ঠ ও চেদিরাজ শিশুপাল স্বয়ংই ধ্বজ উদ্যত করিয়া আনয়ন করিয়াছেন। দক্ষিণাত্য বর্ম্ম, মাগধ মালা ও উষ্ণাষ, বসুদান ষষ্টিবৰ্ষবয়স্ক মাতঙ্গ, মৎস্য সুবর্ণনির্মিত অক্ষ, একলব্য উপানহযুগল এবং আবন্ত্য অভিষেকাৰ্থ বহুবিধ জল আনয়ন করিয়াছেন। চেকিতান তুণীর, কাশ্য ধনু ও দৃঢ়মুষ্টি আসি এবং শল্য কাঞ্চনভূষিত শৈক্য প্রদান করিয়াছেন।
অনন্তর মহামুনি ধৌম্য ও ব্যাস ইহারা নারদ অসিত ও দেবলের সহিত যুধিষ্ঠিরের অভিষেক সম্পাদন করিলেন। তৎপরে অন্যান্য মহর্ষিগণ। জমদগ্ন্য, পরশুরাম এবং অপরাপর বেদবেদাঙ্গপারগ ব্ৰাহ্মণগণ সমভিব্যাহারে তাহাকে অভিষেক করিলেন। যেরূপ স্বৰ্গে সপ্তর্ষিগণ দেবরাজ ইন্দ্রের নিকট আগমন করিয়া থাকেন, সেইরূপ মহাত্মা ব্ৰহ্মার্ষি ও মহর্ষিগণ সেই যজ্ঞে আসিতে লাগিলেন। সত্যবিক্রম সাত্যকি যুধিষ্ঠিরের মস্তকে ছত্ৰ ধারণ, ধনঞ্জয় ও ভীমসেন ব্যজন, নকুল ও সহদেব চামর গ্রহণ করিয়াছিলেন। সত্যযুগে প্ৰজাপতি ব্ৰহ্মা ত্ৰিদশাধিপতি ইন্দ্ৰকে যে শঙ্খ প্রদান করেন, কলসোদধি [কলসসমুদ্র] সেই বারুণ শঙ্খ যুধিষ্ঠিরকে দান করিলেন। কৃষ্ণ বিশ্বকর্ম্মনির্মিত মহামূল্য শৈক্য দ্বারা যুধিষ্ঠিরকে অভিষেক করিলেন, তাহা দেখিয়া আমার অতিশয় অপ্রীতি জন্মিয়াছে; লোকে পূর্ব্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণ সমুদ্রে গমন করিয়া থাকে, বিহঙ্গগণ ব্যতিরেকে উত্তরে কেহই যাইতে পারে না; তথা হইতেও শঙ্খ আনয়ন করিয়াছেন, ঐ মাঙ্গল্য শঙ্খ বারংবার ধ্বনিত হইতে লাগিল, ঐ শঙ্খনাদ শ্রবণ করিয়া আমার গাত্ৰ কণ্টকিত হইল; তখন তেজোহীন প্রিয়দর্শন পার্থিবগণ, ধৃষ্টদ্যুম্ন, পঞ্চপাণ্ডব, সাত্যকি ও কেশব ইহারা তথায় আগমন করিলেন। তাঁহারা তত্রস্থ ভূপালগণকে ও আমাকে বিসংজ্ঞ দেখিয়া উচ্চৈঃস্বরে হাসিতে লাগিলেন।
অনন্তর অর্জ্জুন হৃষ্টান্তঃকরণে ব্রাহ্মণকে বিষাণ [সুদৃশ্য শৃঙ্গ]-বিশিষ্ট পঞ্চশত বৃষ প্ৰদান করিল। রন্তিদেব, নাভাগ, যৌবনাশ্ব, মনু, পৃথু, বৈণ্য, ভগীরথ, যযাতি ও নহুষ ইঁহাদিগের অপেক্ষা কুন্তীপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির রাজশ্ৰীসম্পন্ন হইয়া শোভা পাইলেন। রাজসূয় যজ্ঞে দীক্ষিত হইয়া এরূপে রাজা হরিশ্চন্দ্রের ন্যায় তদীয় প্রভাব পরিবদ্ধিত হইয়াছে। হে মহারাজ! এক্ষণে যুধিষ্ঠিরের রাজ্যসম্পত্তি দেখিয়া আমার প্রাণ-ধারণে সুখ কি? জ্যেষ্ঠের হীনদশা ও কনিষ্ঠের অভ্যুয়লাভ হইতেছে, ইহা দেখিয়া শুনিয়া আর আমার অন্তঃকরণে সুখ নাই। এই কারণেই আমি দিন দিন দুর্ব্বল, বিবর্ণ ও শোকে একান্ত অভিভূত হইতেছি।”