প্ৰজাপ্রদত্ত—দুৰ্য্যোধনের দুঃখনিবেদন
দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “মহারাজ! নানা দিগ্দেশাগত ভূপালেরা রাজা যুধিষ্ঠিরকে যে সকল অমূল্য বস্তু উপহার দিয়াছেন, তাহার বৃত্তান্ত শ্রবণ করুন। আমি সেই সভায় যে সকল রত্নরাজি দেখিয়াছি, পূর্ব্বে সে সকলের নাম পৰ্য্যন্ত শ্রবণ করি নাই। কাম্বোজরাজ ঊণানিৰ্মিত, সামুদ্রিক বিড়ালরোমরচিত, কাঞ্চনসদৃশ, পরিষ্কৃত পরিচ্ছদসকল প্রদান করিয়াছেন। শতসহস্ৰ গোসেবী ব্রাহ্মণ ও দাসবর্গ মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের প্রীতির নিমিত্ত বিচিত্ৰবৰ্ণ ত্ৰিশত উষ্ট্র, বড়বা, রাশীকৃত বলি ও স্বর্ণময় কমণ্ডলু এবং কাপাসিকদেশনিবাসিনী লক্ষ দাসী সমভিব্যাহারে প্রবেশ করিতে না পারিয়া দ্বারদেশে দণ্ডায়মান আছেন। শ্যামা, কৃশাঙ্গী, দীর্ঘকেশী, হেমাভরণভূষিতা শূদ্রারা ব্রাহ্মণোচিত রঙ্কুমৃগের অজিন এবং মরুকচ্ছনিবাসী জনগণ সর্ব্বপ্রকার পূজোপকরণ ও গান্ধারদেশজাত তুরঙ্গম লইয়া উপনীত ছিল। যে সকল মনুষ্য সিন্ধুপারে ও সমুদ্রসন্নিহিত উপবনে জন্মগ্রহণ করিয়াছে এবং যাহারা ইন্দ্রকৃষ্ট [বৃষ্টিজল দ্বারা উৎপন্ন] ও নদীমুখ [নদীজলে জাত] ধান্য দ্বারা জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করে, সেই সকল বৈরাম, পারদ, আভীর ও কিতাবগণ বিবিধ বলি, বহুবিধ রত্ন, অজ, মেষ, গো, হিরণ্য, গর্দভ, উষ্ট্র, ফলজ মধু ও নানাবিধ কম্বল গ্রহণ করিয়া দ্বারদেশে অবস্থিতি করিয়াছিল। স্লেচ্ছধিপতি শৌৰ্য্যবীৰ্য্যসম্পন্ন মহারথ প্রাগ-জ্যোতিষেশ্বর ভগদত্ত যবনগণ-সমভিব্যাহারে প্রসিদ্ধ তরঙ্গকুলসম্ভূত বেগশালী অশ্বসমূহ ও সর্ব্ববিধ বলি গ্রহণ করিয়া আসিয়াছিল, তাহারা প্রবেশ করিতে না পারিয়া লৌহনির্মিত অশ্বভূষণ ও নির্ম্মল গজদন্ত-নির্মিত-মুষ্টিশোভিত [খড়্গের বাঁট—যে স্থান মুষ্টিবদ্ধ থাকে তাহা গজদন্তনির্মিত] অসি-সমুদয় প্রদান করিয়া প্রস্থান করিল। কতিপয় লোক নানা দিগ্দেশ হইতে সমাগত হইয়া দ্বারদেশে উপস্থিত ছিল, তাহাদের মধ্যে কতকগুলি দ্বিনেত্র, কতকগুলি ত্রিনেত্র, কতকগুলি
নেত্র ললাটদেশে
, কতকগুলি উষ্ণীষধারী এবং কতকগুলি দিগম্বর দৃষ্টিগোচর করিলাম। তৎপরে রোমক, নরমাংসভোজী, একপাদ এবং অনেকগুলি নানাবর্ণ রাজগণ দৃষ্ট হইল। তাহারা কৃষ্ণগ্ৰীব, মহাকায়, দূরগামী, সুশিক্ষিত দশ সহস্র রাসভা আহরণ করিয়াছিলেন। বঙ্ক্ষতীরসমুদ্ভব লোকেরা পূজার নিমিত্ত বহুতর হিরণ্য ও কাঞ্চন যুধিষ্ঠিরকে প্রদান করিল। একপদেরা ইন্দ্রগোপকীটের ন্যায় রক্তবর্ণ, শুক্লবৰ্ণ, ইন্দ্রায়ুধবর্ণ, সন্ধ্যাকালীন জলদবর্ণ এবং নানাবর্ণ কতকগুলি মহাজব [অত্যন্ত বেগশালী] আরণ্য অশ্ব এবং অমূল্য স্বর্ণারাশি প্রদান করিয়া যুধিষ্ঠির নিবেশনে প্রবেশ করিয়াছিল। তদনন্তর চীন, শক ও ওড্রদেশবাসী এবং বনবাসী বর্ব্বরজাতি, বৃষ্ণিবংশীয়, হরিহূণদেশীয়, হিমালয়পর্ব্বতীয় এবং নীপ ও অনুপগণ দ্বারদেশে দণ্ডায়মান ছিলেন। বঙ্ক্ষুতীরনিবাসীরা কৃষ্ণগ্ৰীব, মহাকায়, শতক্ৰোশগামী, সুশিক্ষিত, প্রসিদ্ধ দশ সহস্র রাসভ প্রদান করিয়াছিল। শক, তুষার, কঙ্ক, রোমশ ও শৃঙ্গযুক্ত মনুষ্য ঊণাজ [মেষলোমজাত], রাঙ্কব [মৃগলোমনির্মিত], কীটজ [গুটিপোকার দ্বারা প্ৰস্তুত রেশম], পট্টজ [পাট হইতে উৎপন্ন]’, কটী [সূক্ষ্মবন্ধল তন্তুবিনির্মিত—বর্তমানকালের ছালের কাপড়] কৃত, কমলসদৃশ প্রভাসম্পন্ন ও কার্পাসনির্মিত শ্লক্ষ্ন [কোমল] বস্ত্র, মেষদুগ্ধ, কোমল অজিন, নিশিত ও আয়ত খড়গ, ঋষ্টি, শক্তি ও নানাবিধ পরশু, বিবিধ রস, গন্ধ ও সহস্ৰ সহস্র রত্ন এই সমুদয় গ্রহণ করিয়া দ্বারে দণ্ডায়মান ছিল। কতকগুলি লোক দূরগামী অর্বুদ মহাগজ, শত শত তুরঙ্গ, পদ্মসংখ্যক সুবর্ণ ও সর্ব্বপ্রকার পূজোপকরণ গ্ৰহণ করিয়া দণ্ডায়মান ছিল। পূর্ব্বদিশাধিপতি ভূপতিগণ মহামূল্য আসন, যান, শয্যা, মণিকাঞ্চনখচিত গজদন্তবিনির্মিত বিচিত্র কবচ, বিবিধ শস্ত্ৰ, সুশিক্ষিত হয় সম্পন্ন সুবর্ণালঙ্কৃত বহুবিধ রথ, বিবিধ রত্ন, নারাচ, অৰ্দ্ধনারাচ্য প্রভৃতি বিবিধ অস্ত্ৰ প্ৰদান করিয়া মহাত্মা পাণ্ডবগণের যজ্ঞসদনে প্ৰবেশ করিল।