৫০তম অধ্যায়
অহিংসধৰ্ম্মের শ্রেষ্ঠতা—জ্ঞানদ্বারা মোক্ষ
“মহর্ষিগণ এইরূপ প্রশ্ন করিলে, ব্রহ্মা তাঁহাদিগকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “হে তপোধনগণ! আমি এই উপলক্ষ্যে এক গুরু স্বীয় শিষ্যকে যেরূপ উপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন, তাহা বিস্তারিতরূপে কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিতচিত্তে শ্রবণ কর।
‘সৰ্ব্বভূতে অহিংসাই পরমধর্ম্ম ও প্রধান কার্য্য। ঐ ধৰ্ম্মে উদ্বেগের লেশমাত্র নাই। তত্ত্বদর্শী বৃদ্ধগণ জ্ঞানকে মোক্ষসাধক বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। এই নিমিত্ত বিশুদ্ধ জ্ঞানলাভ হইলেই মনুষ্য সমুদয় পাপ হইতে বিমুক্ত হয়। যাহারা হিংসাপরায়ণ, নাস্তিক ও লোভ-মোহে একান্ত আসক্ত, তাহারা নিশ্চয়ই নিরয়গামী হইয়া থাকে। যাঁহারা আলস্য পরিত্যাগ করিয়া কামনাপূৰ্ব্বক বিবিধ সৎকার্য্যের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়েন, তাঁহারা ইহলোকে বারংবার জন্মগ্রহণপূৰ্ব্বক পরমসুখে কালাতিপাত করেন। আর যাঁহারা কামনাপরিশূন্য হইয়া সৎকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করেন, সেই সাধুদর্শী ব্যক্তিদিগকে কদাপি জন্মগ্রহণ করিতে হয় না।
“অতঃপর সত্ত্বগুণ ও পুরুষের পরস্পর সংযোগ ও বিয়োগের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। সত্ত্বগুণ ও পুরুষ এই উভয়ের মধ্যে সত্ত্বগুণকে বিষয় এবং পুরুষকে বিষয়ী বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। উড়ুম্বরমধ্যে মশক যেমন নির্লিপ্তভাবে অবস্থান করে, তদ্রূপ পুরুষ সত্ত্বগুণে নির্লিপ্তভাবে অবস্থান করিয়া থাকেন। সত্ত্বগুণ অচেতন পদার্থ, উহার কিছুমাত্র জ্ঞান নাই। পুরুষ যে ঐ গুণকে সৰ্ব্বদা ভোগ করিয়া থাকেন, তাহা ঐ গুণ কোনক্রমেই পরিজ্ঞান হইতে পারে না। কিন্তু পুরুষ ঐ বিষয় সবিশেষ অবগত হইয়া থাকেন।
‘পণ্ডিতগণ সত্ত্বগুণকে দুঃখাদিসংযুক্ত এবং পুরুষকে সুখদুঃখাদিবিহীন ও নির্গুণ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। পদ্মপত্র যেমন সলিলের সহিত নির্লিপ্তভাবে অবস্থান করিয়া উহা ভোগ করে, তদ্রূপ পুরুষ সত্ত্বগুণের সহিত নির্লিপ্তভাবে অবস্থানপূৰ্ব্বক উহা উপভোগ করিয়া থাকেন। উনি সমুদয় গুণের সহিত সংযুক্ত হইয়াও পদ্মপত্রস্থিত জলবিন্দুর ন্যায় উহাদের সহিত লিপ্ত হয়েন না। স্থূলদেহ ও পুরুষ যেমন পরস্পর পৃথক্ হইলেও অভিন্ন বলিয়া প্রতীয়মান হয়, তদ্রূপ সত্ত্বগুণ ও পুরুষ ইঁহারা পরস্পর নির্লিপ্ত হইলেও অভিন্ন বলিয়া প্রতীয়মান হইয়া থাকেন। যেমন প্রদীপের সাহায্যে অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রদেশস্থিত পদার্থ দর্শন করা যায়, তদ্রূপ সত্ত্বগুণের সাহায্যে সংসারমধ্যে পুরুষের দর্শনলাভ হইয়া থাকে। যেমন প্রদীপে তৈলাদি বর্ত্তমান থাকিলেই উহা বস্তুসমুদয় প্রকাশিত করে এবং তৈলাদি নিঃশেষিত হইলেই উহা নিৰ্ব্বাণ হয়, তদ্রূপ সত্ত্বগুণ কৰ্ম্মে সংযুক্ত থাকিলেই আত্মাকে প্রকাশ করে এবং কৰ্ম্ম হইতে বিমুক্ত হইলেই বিনষ্ট হয়। যেমন প্রদীপ নিৰ্ব্বাণ হইলেও পদার্থসমুদয় বিদ্যমান থাকে, তদ্রূপ সত্ত্বগুণ বিনষ্ট হইলেও পুরুষের বিনাশ হয় না।
জ্ঞানলাভে যোগের প্রয়োজনীয়তা
‘যেমন সহস্র উপদেশ প্রদান করিলেও নির্ব্বোধ ব্যক্তিরা কোনরূপে প্রকৃত বিষয় বোধগম্য করিতে পারে না, কিন্তু বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিরা অল্পমাত্র উপদেশ প্রাপ্ত হইলেই অনায়াসে প্রকৃত বিষয়বোধে সমর্থ হয়, তদ্রূপ যাঁহারা বুদ্ধিমান হয়, তাঁহারা অনায়াসেই ধৰ্ম্ম-পথ অবগত হইতে সমর্থ হইয়া থাকেন; কিন্তু যাহারা অল্পবুদ্ধি, তাহাদিগের পক্ষে তাহা অবগত হওয়া নিতান্ত কঠিন হইয়া উঠে। পাথেয়পরিশূন্য ব্যক্তি যেমন পথিমধ্যে অতিকষ্টে ভ্রমণ করিতে করিতে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয়, তদ্রূপ প্রাক্তনপুণ্যবিহীন ব্যক্তি যোগমার্গ অবলম্বন করিলে, যোগ সম্যক অনুষ্ঠিত না হইতে হইতেই তাঁহার পরলোকপ্রাপ্তি হইয়া থাকে। ফলতঃ লোকের প্রাক্তন পুণ্যসঞ্চয় না থাকিলে সে কোনক্রমেই সম্যকরূপে যোগের অনুষ্ঠান করিতে পারে না। যেমন অনভিজ্ঞ ব্যক্তি পাদচারে অপরিচিত সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করিবার চেষ্টা করে, তদ্রূপ অদূরদর্শী ব্যক্তিরাই শাস্ত্রজ্ঞানের সাহায্য ব্যতীত সংসারমার্গ অতিক্রম করিবার চেষ্টা করিয়া থাকে।
বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি যেমন দ্রুতগামী তুরঙ্গমযুক্ত রথে আরোহণ করিয়া সেই পথ অতিশীঘ্র অতিক্রম করে, তদ্রূপ বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা শাস্ত্রজ্ঞানদ্বারা অনায়াসে সংসারপথ অতিক্রম করিয়া থাকেন। যেমন পৰ্ব্বতশিখরে আরোহণোদ্যত ব্যক্তি ভূতলস্থিত রথারূঢ় ব্যক্তিকে রথদ্বারা পর্ব্বতারোহণে নিতান্ত অসমর্থ দেখিয়া রথারোহণবাসনা পরিত্যাগ করে, তদ্রূপ পরমপদ ব্ৰহ্মপলাভের অধিকারী মহাত্মা শাস্ত্রের সাহায্যে ঐ পদ লাভ করা নিতান্ত দুঃসাধ্য বিবেচনা করিয়া শাস্ত্রত্যাগ করিবেন। রথারূঢ় ব্যক্তি যেমন রথগমনোপযোগী পথ নিঃশেষিত হইলেই রথ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পাদচারে গমন করে, তদ্রূপ ধীমান ব্যক্তিরা, চিত্তশুদ্ধি পৰ্য্যন্ত শাস্ত্রপথে পরিভ্রমণ করিয়া পরিশেষে যোগতত্ত্ব অবগত হইলেই উহা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ক্রমে ক্রমে হংস, পরমহংসাদির পদে গমন করিয়া থাকেন। মুঢ় ব্যক্তি যেমন নৌকা রোহণ না করিয়া মোহবশতঃ বাহুমাত্র অবলম্বনপূর্ব্বক ঘোরতর অর্ণব সমুত্তীর্ণ হইতে অভিলাষী হইয়া বিনষ্ট হয়, তদ্রূপ অনভিজ্ঞ লোক উপদেষ্টা ব্যতীত সংসারসাগর সমুত্তীর্ণ হইতে বাসনা করিয়া অচিরাৎ মৃত্যুমুখে নিপতিত হয়। আর বিজ্ঞ ব্যক্তি যেমন অতি উৎকৃষ্ট ক্ষেপণী[১]সংযুক্ত নৌকায় আরোহণপূৰ্ব্বক অনবরত পোত সঞ্চালন করিয়া পরিশেষে পরপারে সমুত্তীর্ণ হয়, তদ্রূপ বুদ্ধিমান ব্যক্তি উপদেষ্টার সাহায্য গ্রহণপূৰ্ব্বক দিবারাত্রি পরিশ্রম করিয়া সংসার হইতে উত্তীর্ণ হইয়া থাকেন। যেমন সমুদ্রতীরে উত্তীর্ণ হইয়া স্থলপথে গমন করিবার সময় নৌকা পরিত্যাগ করিতে হয়, তদ্রূপ সংসার হইতে সমুত্তীর্ণ হইয়া পরমপদ প্রাপ্ত হইবার সময় উপদেষ্টাকে পরিত্যাগ করা উচিত। নাবিক যেমন স্নেহপ্রযুক্ত সর্ব্বদা নৌকাতে অবস্থানপূর্ব্বক পরিভ্রমণ করে, তদ্রূপ মূঢ় ব্যক্তি মোহজালে জড়িত হইয়া সতত এই সংসারমধ্যেই পরিভ্রমণ করিয়া থাকে। যেমন নৌকারোহণ করিয়া স্থলপথে এবং রথারোহণ করিয়া জলপথে পরিভ্রমণ করিতে পারা যায় না, তদ্রূপ বিবিধ কার্য্যে লিপ্ত হইয়া ব্রহ্মলাভ ও কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া সংসার কাৰ্য্যে পরিভ্রমণ করা সাধ্যায়ত্ত নহে। ইহলোকে যিনি যেরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করেন, তিনি তদনুরূপ ফললাভ করিবেন।
‘যিনি রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দ এই পঞ্চ বিষয় হইতে অতীত, মুনিগণ তাঁহাকেই প্রধান বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। ঐ প্রধানের অপর নাম প্রকৃতি। প্রকৃতি হইতে মহত্তত্ত্ব, মহত্তত্ত্ব হইতে অহঙ্কার ও অহঙ্কার হইতে পঞ্চমহাভূত সমুৎপন্ন হইয়াছে।
‘শব্দাদি পঞ্চ বিষয় ঐ পঞ্চ মহাভুতের গুণ। প্রকৃতি মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার ও পঞ্চমহাভূত ইহারা সকলেই কাৰ্য্য ও কারণ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। ঐ পঞ্চভূতের মধ্যে কোন ভূতই মনের অগোচর নাই। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ পৃথিবীর গুণ। তন্মধ্যে গন্ধ সুখকর, দুঃখজনক, মধুর, অম্ল, কটু, দূরগামী, মিশ্রিত, স্নিগ্ধ, রুক্ষ ও বিশদ এই দশবিধ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস এই চারিটি জলের গুণ। তন্মধ্যে রসকে পণ্ডিতেরা মধুর, অম্ল, কটু, তিক্ত, কষায় ও লবণ এই ছয় প্রকার বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। শব্দ, স্পর্শ ও রূপ এই তিনটি তেজের গুণ। তন্মধ্যে শুক্ল, কৃষ্ণ, রক্ত, নীল, পীত, অরুণ, হ্রস্ব, দীর্ঘ, কৃশ, স্থূল, চতুষ্কোণ ও বর্ত্তুল এই দ্বাদশবিধ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। বায়ুর শব্দ ও স্পর্শ এই দুই গুণ। তন্মধ্যে স্পর্শকে রুক্ষ, শীতল, উষ্ণ, স্নিগ্ধ, বিশদ, কঠিন, চিক্কণ, সূক্ষ্ম, পিচ্ছিল, দারুণ ও মৃদু বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। একমাত্র শব্দই আকাশের গুণ। ঐ ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, নিষাদ, ধৈবত, সুখকর, অসুখকর ও দৃঢ় এই দশবিধ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। আকাশ সৰ্ব্বভূতের শ্রেষ্ঠ। ঐ আকাশ হইতে অহঙ্কার, অহঙ্কার হইতে বুদ্ধি, বুদ্ধি হইতে মহত্তত্ত্ব, মহত্তত্ত্ব হইতে প্রকৃতি ও প্রকৃতি হইতে সনাতন পুরুষকে শ্রেষ্ঠ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। যে ব্যক্তি সৰ্ব্বকাৰ্য্যের বিধিজ্ঞ অধ্যাত্মকুশল ও সৰ্ব্বভূতে সমদর্শী হয়েন, তিনিই সেই পরমপুরুষকে লাভ করিতে পারেন, সন্দেহ নাই।’ ”