অৰ্জ্জুননিকটে কৃষ্ণের যাদবধ্বংসসংবাদ-প্রেরণ
বৈশম্পায়ন বলিলেন, মহাত্মা বভ্রু ও দারুক এই কথা কহিলে মহামহিম বাসুদেব তাঁহাদের বাক্যে সম্মত হইয়া তাঁহাদিগের সহিত অমিতপরাক্রম বলভদ্রের উদ্দেশে গমন করিয়া ইতস্ততঃ বিচরণ করিতে করিতে দেখিলেন, ঐ মহাবীর অতিনির্জ্জন প্রদেশে বৃক্ষমূলে উপবিষ্ট হইয়া চিন্তা করিতেছেন। মহাত্মা হৃষীকেশ বলভদ্রকে তদবস্থ দেখিয়া দারুককে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “সারথে! তুমি সত্বর হস্তিনানগরে গমন করিয়া অৰ্জ্জুনের নিকট যাদবদিগের বিনাশবৃত্তান্তসমুদয় নিবেদন কর। তাহা হইলে তিনি অবিলম্বে দ্বারকায় আগমন করিবেন।” বাসুদেব এইরূপ আদেশ করিলে দারুক অবিলম্বে রথারোহণে কৌরবরাজধানীতে প্রস্থান করিলেন।
পুরনারীরক্ষাৰ্থ কৃষ্ণের ব্যবস্থা
তখন মহাত্মা কেশব সমীপস্থ বসুকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ভদ্র! তুমি অবিলম্বে অন্তঃপুরকামিনীগণের রক্ষার্থ গমন কর। দস্যুগণ যেন ধনলোভে তাহাদিগের হিংসা না করে।”
মহাবীর বভ্রু ঐ সময় মদমত্ত ও জ্ঞাতিবধনিবন্ধন নিতান্ত দুঃখিত হইয়া জনার্দ্দনের নিকট উপবেশনপূর্ব্বক বিশ্রাম করিতেছিলেন। মহাত্মা মধুসূদন এই কথা কহিবামাত্র তিনি যেমন স্ত্রীগণের রক্ষণার্থ ধাবমান হইলেন, অমনি সেই ব্রহ্মশাপসম্ভূত মুষল এক ব্যাধের লৌহময় মুদগরে আবির্ভূত ও তাঁহার গাত্রে নিপতিত হইয়া তাহার প্রাণসংহার করিল। তখন মহাত্মা হৃষীকেশ বভ্রুকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া স্বীয় অগ্রজ বলভদ্রকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহাত্মন্। আমি যেকাল পর্য্যন্ত কাহারও প্রতি স্ত্রীগণের রক্ষণাবেক্ষণের ভার সমর্পণ করিয়া প্রত্যাগমন না করি, সেই কাল পর্য্যন্ত আপনি এই স্থানে আমার প্রতীক্ষা করুন।”
এই কথা কহিয়া বাসুদেব অচিরাৎ নগরমধ্যে প্রবেশপূৰ্ব্বক পিতাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “মহাশয়! যে পৰ্য্যন্ত ধনঞ্জয় এখানে আগমন না করেন, সেই পৰ্য্যন্ত আপনি অন্তঃপুরস্থ কামিনীদিগকে রক্ষা করুন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলদেব বনমধ্যে আমার নিমিত্ত প্রতীক্ষা করিতেছেন, অতএব আমি এক্ষণে তাঁহার নিকট চলিলাম। পূৰ্ব্বে আমি কুরুপাণ্ডবযুদ্ধে কৌরব ও অন্যান্য নরপতিগণের নিধন দর্শন করিয়াছি, এক্ষণে আবার আমাকে যদুবংশের নিধনও প্রত্যক্ষ করিতে হইল। আজ যাদবগণের বিরহে এই পুরী আমার চক্ষুর শল্যস্বরূপ বোধ হইতেছে। অতএব আমি অচিরাৎ বনগমন করিয়া বলদেবের সহিত তীব্রতর তপানুষ্ঠান করি।”
বলদেবের অন্তর্দ্ধান
মহামতি বাসুদেব এই কথা কহিয়া, পিতার চরণবন্দনপূর্ব্বক অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলেন। তিনি বহির্গত হইবামাত্র অন্তঃপুরমধ্যে বালক ও বনিতাদিগের ঘোরতর আর্ত্তনাদ সমুত্থিত হইল। তখন ধীমান বাসুদেব অবলাগণের রোদনশব্দশ্রবণে পুনরায় প্রতিনিবৃত্ত হইয়া তাঁহাদিগকে কহিলেন, “হে সীমন্তিনীগণ! মহাত্মা ধনঞ্জয় এই নগরে আগমন করিতেছেন। তিনি তোমাদিগের দুঃখমোচন করিবেন। অতএব তোমরা আর রোদন করিও না।”
এই কথা কহিয়া মহামতি মধুসূদন অবিলম্বে নির্জ্জন বনপ্রদেশে গমন করিয়া দেখিলেন, বলদেব যোগাসনে আসীন রহিয়াছেন এবং তাঁহার মুখমণ্ডল হইতে এক বৃহদাকার শ্বেতবর্ণ সর্প বিনির্গত হইতেছে। ঐ সর্পের মস্তক সহস্ৰসংখ্যক ও মুখ রক্তবর্ণ। সর্প দেখিতে দেখিতে বলদেবের মুখ হইতে বহির্গত হইয়া সমুদ্রাভিমুখে ধাবমান হইল। তখন সাগর, দিব্যনদীসমুদয়, জলাধিপতি বরুণ এবং কর্কোটক, বাসুকি, তক্ষক, পৃথুশ্ৰবা, বরুণ, কুঞ্জর, মিশ্রী, শঙ্খ, কুমুদ, পুণ্ডরীক, ধৃতরাষ্ট্র, হ্রাদ, ক্রাধ, শিতিকণ্ঠ, উগ্রতেজা, চক্রমন্দ, অতিযণ্ড, দুর্ম্মুখ ও অম্বরীষ প্রভৃতি নাগগণ সেই সর্পকে প্রত্যুদগমনপূর্ব্বক স্বাগতপ্রশ্ন ও পাদ্য-অর্ঘ্যাদিদ্বারা অর্চ্চনা করিতে লাগিলেন। এইরূপে সেই সৰ্প বলদেবের মুখ হইতে বহির্গত হইলে তাঁহার দেহ নিতান্ত নিশ্চেষ্ট হইল। তখন সর্ব্বজ্ঞ দিব্যচক্ষু ভগবান্ বাসুদেব জ্যেষ্ঠভ্রাতা দেহত্যাগ করিলেন বিবেচনা করিয়া, চিন্তাকুলিতচিত্তে সেই বিজনবনে পরিভ্রমণ করিতে করিতে ভূতলে উপবেশন করিলেন।
ব্যাধবাণে আহত কৃষ্ণের অন্তর্দ্ধান
ঐ সময় পূর্ব্বে গান্ধারী তাঁহাকে যাহা কহিয়াছিলেন এবং তিনি উচ্ছিষ্ট পায়স পদতলে লিপ্ত না করাতে দুর্ব্বাসা যেসমুদয় বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিলেন, সেইসমুদয় তাঁহার স্মৃতিপথে সমুদিত হইল। তখন তিনি নারদ, দুর্ব্বাসা ও কণ্বের বাক্যপ্রতিপালন, তাঁহার স্বর্গগমন-বিষয়ে দেবতাদিগের সন্দেহভঞ্জন, ত্রিলোকপালন করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে মর্ত্যলোক পরিত্যাগ করিতে হইবে বিবেচনা করিয়া ইন্দ্রিয়সংযম ও মহাযোগ অবলম্বনপূর্ব্বক ভূতলে শয়ন করিলেন। ঐ সময় জরানামক ব্যাধ মৃগবিনাশবাসনায় সেই স্থানে সমাগত হইয়া দূর হইতে যোগাসনে শয়ান কেশবকে অবলোকনপূর্ব্বক মৃগ জ্ঞান করিয়া, তাঁহার প্রতি শর নিক্ষেপ করিল। ওই শর নিক্ষিপ্ত হইবামাত্র উহাদ্বারা হৃষীকেশের পদতল বিধা হইল। তখন সেই ব্যাধ মৃগগ্রহণ-বাসনায় সত্বর তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিল, এক অনেকবাহুসম্পন্ন, পীতাম্বরধারী, যোগাসনে শয়ান পুরুষ তাহার শরে বিদ্ধ হইয়াছেন। লুব্ধক তাঁহাকে দর্শন করিবামাত্র আপনাকে অপরাধী বিবেচনা করিয়া শঙ্কিতমনে তাঁহার চরণে নিপতিত হইল। তখন মহাত্মা মধুসূদন তাহাকে আশ্বাসপ্রদানপূর্ব্বক অচিরাৎ আকাশমণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়া স্বর্গে গমন করিলেন।
ঐ সময় ইন্দ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয় এবং রুদ্র, আদিত্য, বসু, বিশ্বদেব, মুনি, সিদ্ধ, গন্ধৰ্ব্ব ও অপ্সরাগণ তাঁহার প্রত্যুদ্গমনার্থ নির্গত হইলেন, তখন ভগবান্ নারায়ণ তাঁহাদের কর্ত্তৃক সৎকৃত হইয়া তাঁহাদের সহিত স্বীয় অপ্রমেয় স্থানে সমুপস্থিত হইলেন। দেবতা, মহর্ষি, সিদ্ধ, চারণ, গন্ধৰ্ব্ব, অপ্সরা ও সাধ্যগণ তাঁহার যথোচিত পূজা করিতে লাগিলেন, মুনিগণ ঋগ্বেদপাঠ ও গন্ধকগণ সঙ্গীতদ্বারা তাঁহার স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন এবং দেবরাজ ইন্দ্র আহ্লাদিতচিত্তে তাঁহার অভিনন্দনে প্রবৃত্ত হইলেন।