৪৮তম অধ্যায়
সঙ্কুলযুদ্ধ-বহু সৈন্যক্ষয়
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! এইরূপে উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণ ব্যহিত ও পরস্পর মিলিত হইলে মহাবীর ধনঞ্জয় সংশপ্তকদিগের প্রতি ও সূতপুত্ৰ পাণ্ডবগণের প্রতি কিরূপে যুদ্ধার্থ গমন করিল? তুমি সমরবৃত্তান্তবর্ণনে সুনিপুণ; অতএব এক্ষণে উহা সবিস্তারে কীৰ্ত্তন কর। আমি বীরগণের পরাক্রমের বিষয় শ্রবণ করিয়া কিছুতেই তৃপ্তিলাভ করিতে সমর্থ হইতেছি না।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! মহাবীর অর্জ্জুন বিপক্ষসৈন্যগণের ব্যূহ অবলোকন করিয়া স্বীয় সৈন্যগণকে ব্যহিত করিলেন। চন্দ্রসূৰ্য্যসদৃশ কান্তিসম্পন্ন, মহাধনুর্দ্ধর, মহ্রাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন পারাবতসবর্ণ [পায়রার মত ধবল] অশ্বসংযোজিত রথে সমারূঢ় হইয়া সেই সাদী, মাতঙ্গ, পদাতি ও রথসমুদয়-সঙ্কুল মহাব্যূহের মুখে অবস্থানপূর্ব্বক সাক্ষাৎ কৃতান্তের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। শার্দুলের ন্যায় মহাবলপরাক্রান্ত দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র দিব্য-আয়ুধ ও বৰ্ম্ম ধারণপূর্ব্বক অনুচরগণসমভিব্যাহারে তারাগণ যেমন চন্দ্রকে রক্ষা করে, তদ্রূপ ধৃষ্টদ্যুম্নকে রক্ষা করিতে লাগিলেন।
“এইরূপে সৈন্যগণ ব্যহিত হইলে মহাবীর ধনঞ্জয় সংশপ্তকগণকে সমরাঙ্গনে অবলোকন করিয়া ক্রোধভরে শরাসন আস্ফালনপূর্ব্বক তাহাদের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন হতাশ্বরথভূয়িষ্ঠ সংশপ্তকগণও বিজয়লাভার্থী ও অর্জ্জুনবধে অধ্যবসায়ারূঢ় হইয়া প্রাণপণে তাঁহার অভিমুখে গমন করিয়া তাঁহাকে শরনিকরে নিপীড়িত করিতে লাগিল। ঐ সময় ধনঞ্জয়ের সহিত নিবাতকবচগণের ঘোরতর সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। মহাবীর অর্জ্জুন বিপক্ষগণের রথ, অশ্ব, হস্তী, ধ্বজ, পদাতি, শর, শরাসন, খড়্গ, চক্র, পরশু এবং আয়ুধযুক্ত উদ্যত বাহু, বিবিধ অস্ত্র ও মস্তকসমুদয় ছেদন করিতে আরম্ভ করিলেন। সংশপ্তকগণ সেই সৈন্যরূপ মহাবর্ত্যমধ্যে ধনঞ্জয়ের রথ নিমগ্ন জ্ঞান করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে প্রবৃত্ত হইল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় পশুসংহারে প্রবৃত্ত রুদ্রদেবের ন্যায় একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সম্মুখীন বীরগণকে সংহারপূর্ব্বক উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চাদ্ভাগস্থিত অরাতিগণকে প্রহার করিতে লাগিলেন।
“ঐ সময় পাঞ্চাল, চেদি ও সৃঞ্জয়গণের সহিত কৌরবদিগের তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল। মহাবীর কৃপ, কৃতবর্ম্মা ও শকুনি— ইঁহারা সমরমত্ত হইয়া কৌশল্য, কাশী, মাৎস্য, কারূষ, কৈকেয় ও শূরসেনদিগের সহিত সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন। হে মহারাজ! ঐ যুদ্ধ ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রকুলসত বীরগণের বিনাশকর, যশস্কর, পাপনাশক এবং স্বর্গ ও ধৰ্মলাভের হেতুভূত।
“ঐ সময় মহারাজ দুৰ্য্যোধন মদ্রক ও কৌরববীরগণে পরিবৃত হইয়া ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে পাণ্ডব, পাঞ্চাল, চেদিগণ এবং সাত্যকির সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত মহারথ কর্ণকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। মহাবীর কর্ণও নিশিতশরনিকরে পাণ্ডবপক্ষীয় সৈন্য বিনষ্ট ও মহারথগণকে বিমর্দ্দিত করিয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিলেন এবং অসংখ্য শত্রুগণের অস্ত্র ছেদন, রথ উন্মলন ও প্রাণ সংহারপূর্ব্বক তাহাদিগকে যশস্বী ও স্বর্গভাজন করিয়া যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত হইলেন। হে মহারাজ! এইরূপে কৌরব ও সৃঞ্জয়দিগের হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণের ক্ষয়কর দেবাসুরসংগ্রামসদৃশ ঘোরতর যুদ্ধ হইতে লাগিল।”