৪৬তম অধ্যায়
রণভীত উত্তরকে অর্জ্জুনের অভয়দান
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর মহাবীর অর্জ্জুন রাজকুমার উত্তরকে সারথ্যে নিযুক্ত করিয়া শমীবৃক্ষ প্ৰদক্ষিণ ও আয়ুধ ধারণপূর্ব্বক রথ হইতে সিংহধ্বজ অপনয়ন ও শমীবৃক্ষমূলে সংস্থাপনপূর্ব্বক যুদ্ধযাত্ৰা করিলেন।
অনন্তর অর্জ্জুন বিশ্বকর্ম্মবিহিত দৈবী মায়া অবলম্বন করিয়া সিংহলাঙ্গুললক্ষণ, বানরচিহ্নিত পাবক-প্ৰসাদলব্ধ কাঞ্চনধ্বজ আরাধনা করিতে লাগিলেন। ভগবান পাবক তাঁহার সংকল্প অবগত হইয়া তদীয় রথপতাকায় ভূতসকলকে সন্নিবেশিত করিলেন। অনন্তর ঐ পতাকা সত্বর আকাশ হইতে অতি বিচিত্র তূণীরসম্পন্ন মনোরথগতি তদীয় রথে নিপতিত হইল। অর্জ্জুন সেই পতাকা প্ৰদক্ষিণ ও রথে আরোহণ করিয়া অঙ্গুলিত্ৰধারণ ও শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক উত্তরদিকে প্রস্থান করিলেন। এবং মহাবেগে অতি ভীষণ লোমহর্ষণ শঙ্খধ্বনি করিতে আরম্ভ করিলে, সেই-সকল বেগগামী তুরঙ্গম প্রবলবেগে গমন করিতে লাগিল। উত্তর তদ্দর্শনে নিতান্ত ভীত হইয়া, রথগার্ভে উপবেশন করিলেন।
অর্জ্জুন রশ্মি সংযত করিয়া উত্তরকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে রাজকুমার! তুমি ভীত হইও না। ক্ষত্রিয় হইয়া শক্রমধ্যে কি নিমিত্ত বিষণ্ন হইতেছ? তুমি নানাবিধ ভেরীরব, শঙ্খধ্বনি ও রণমাতঙ্গবৃংহিত [হস্তীর শব্দ] শ্রবণ করিয়াছ; তথাপি আজি আমার এই শঙ্খধ্বনি শ্রবণ করিয়া প্রাকৃত [বালকতুল্য] লোকের ন্যায় কেন বিষণ্ন ও বিত্ৰস্ত হইতেছ?” উত্তর কহিলেন, “হে মহাভাগ! নানাবিধ ভেরীরব, শঙ্খধ্বনি ও রণমাতঙ্গাবৃংহতি শ্রবণ করিয়াছি বটে কিন্তু এতাদৃশ্য শঙ্খধ্বনি ও জ্যানির্ঘোষ কদাচ শ্রবণ করি নাই এবং ঈদৃশ ধ্বজদণ্ড কদাচি আমার নয়নগোচর হয় নাই। এই সমস্ত অমানুষধ্বনি এবং রথঘর্ঘরশব্দে আমার মন নিতান্ত বিমোহিত ও ব্যথিত হইতেছে, দিক সকল আকুল হইয়া উঠিয়াছে এবং ধ্বজপটে সমাচ্ছাদিত হইয়া আমার নেত্রপথ রোধ করিতেছে। গাণ্ডীবনিৰ্ঘোষে কর্ণকুহর বিধির হইয়া গিয়াছে।” তখন অর্জ্জুন কহিলেন, “হে উত্তর! তুমি দৃঢ়তররূপে রশ্মিসংযমপূর্ব্বক সাবধানে উপবেশন কর। আমি পুনরায় শঙ্খধ্বনি করিব।”
অনন্তর অর্জ্জুন শঙ্খধ্বনি করিলে এককালে তদীয় বন্ধু-বর্গের অপরিসীম আনন্দোময় ও শক্রগণের হৃৎকম্প উপস্থিত হইল; দিকসকল মুখরিত হইয়া উঠিল; গিরিগুহা প্রতিধ্বনিত ও ভূধর সকল বিদারিত হইতে লাগিল! তাঁহার শঙ্খধ্বনি, রথচক্রের নির্ঘোষ ও গাণ্ডীবের টঙ্কারশব্দে সচরাচর ধরাতল বিচলিত হইয়া উঠিল। উত্তর এই সমস্ত অদ্ভুত ব্যাপার সন্দর্শনে সাতিশয় সঙ্কুচিত হইয়া বিলীন [লুক্কায়িত—গা ঢাকা] ভাবে রথমধ্যে উপবেশন করিলে অর্জ্জুন অভয়প্ৰদানপূর্ব্বক তাঁহাকে আশ্বাসিত করিলেন।
অমঙ্গলদর্শনে কৌরবপরাজয়শঙ্কা
দ্রোণাচাৰ্য্য কহিলেন, “হে কৌরবগণ! যখন ইহার জলদগম্ভীর রথনির্ঘোষে বসুমতী বিকম্পিত হইতেছে, তখন বোধ হয়, ইনি অবশ্যই অর্জ্জুন হইবেন। এই দেখ, আমাদিগের অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰ সকল নিম্প্রভ ও অশ্বগণ বিষন্ন হইতেছে, অগ্নির আর তাদৃশ প্রতিভা নাই এবং যে সকল বস্তু বাস্তবিক সমুজ্জ্বল, তাহাও এক্ষণে প্রভাহীন হইয়া যাইতেছে; মৃগগণ পূর্ব্বদিকে ঘোরতর রব করিতেছে; বায়সগণ ধ্বজোপরি লীন হইতেছে; রোরুদ্যমান শিবা-সকল অশিব শব্দ করিয়া সেনামধ্যে প্রবিষ্ট হইতেছে; কেহ তাহাদিগকে আঘাত না করিলেও আপনারা বহির্গত হইয়া ভাবী ভয় সূচনা করিতেছেন; তোমাদিগের রোমকূপ-সকল প্ৰহৃষ্ট দৃষ্ট হইতেছে; অতএব এই সমস্ত ভয়ানক ঔৎপাতিক চিহ্ন দ্বারা স্পষ্ট বোধ হইতেছে যে, অদ্য যুদ্ধে অসংখ্য ক্ষত্ৰিয়ের ক্ষয় হইবে; আজি জ্যোতিষ্কমণ্ডল-সমুদয় অপ্রকাশিত ও মৃগপক্ষিগণ প্রতিকূল বোধ হইতেছে। অদ্য যুদ্ধে আমাদিগের বিনাশ যে অবশ্যম্ভাবী, তাহার আর সংশয় নাই। দেখ, প্ৰদীপ্ত উল্কা-সকল সেনাগণের অত্যন্ত পীড়া জন্মাইতেছে, বাহন-সকল দুঃখিতচিত্তে যেন রোদন করিতেছে এবং গৃধ্রসকল আমাদিগের সৈন্যগণের চতুর্দ্দিকে উড্ডীন হইতেছে। হে মহারাজ! আজি অর্জ্জুনশরে সেনাদিগকে নিতান্ত নিপীড়িত দেখিয়া অতীব সন্তপ্ত হইবেন। ঐ দেখুন, আমাদিগের সৈন্যগণ পরাভূতপ্ৰায় লক্ষিত হইতেছে; কাহাকেও সমরোৎসাহী বোধ হইতেছে না। সকলেরই মুখ বিবর্ণ ও চিত্ত অভিভূত হইয়া গিয়াছে। অতএব গোসকল প্রস্থাপিত করিয়া ব্যূহ নির্ম্মাণপূর্ব্বক তন্মধ্যে অবস্থিতি করা অবশ্য কর্ত্তব্য, নতুবা আর নিস্তার নাই।”