৪৬তম অধ্যায়
মদ্রাদিদেশের দুষ্টাচারের ইতিহাস
“কর্ণ কহিলেন, ‘হে শল্য! আমি পুনরায় তোমাকে এক উপাখ্যান কহিতেছি, তুমি একাগ্রচিত্তে তাহার আদ্যোপান্ত শ্রবণ কর। কিছুদিন হইল, এক ব্রাহ্মণ আমাদের ভবনে অতিথি হইয়াছিলেন। তিনি তথায় সদাচার দর্শনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন,—আমি বহুকাল একাকী হিমালয়শৃঙ্গে বাস,ও নানা ধর্ম্মসঙ্কুল বহুতর দেশ দর্শন করিয়াছি; কিন্তু কুত্রাপি সমুদয় প্রজাকে ধর্ম্মের বিরুদ্ধাচরণ করিতে দেখি নাই। সকলেই বেদোক্ত ধর্ম্মকে যথার্থ ধর্ম্ম বলিয়া থাকে। পরিশেষে আমি নানা জনপদ ভ্রমণ করিয়া বাহীকদেশে উপস্থিত হইয়া শুনিলাম, তত্রস্থ লোকসকল অগ্রে ব্রাহ্মণ হইয়া পরে ক্রমে ক্রমে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, বাহীক ও নাপিত হয়; অনন্তর পুনরায় ব্রাহ্মণ হইয়া তৎপরে দাস হয়; গান্ধার, মদ্রক ও বাহীকেরা, সকলেই কামাচারী, লঘুচেতাঃ ও সঙ্কীর্ণমনাঃ। আমি সমস্ত পৃথিবী ভ্রমণ করিয়া বাহীকদেশে এইরূপ, ধর্ম্মসঙ্করকারক আচারবিপৰ্যয় শ্রবণ করিলাম।
‘হে মদ্ৰাধিপ! আমি আর একজনের নিকট বাহীকদিগের যে কুৎসিত কথা শ্রবণ করিয়াছিলাম, তাহাও কহিতেছি, শ্রবণ কর। পূর্ব্বে অরট্টদেশীয় দস্যুরা এক পতিব্রতা সীমন্তিনীকে অপহরণপূর্ব্বক তাহার সতীত্ব ভঙ্গ করিলে তিনি এই শাপ প্রদান করিয়াছিলেন যে,-হে নরাধমগণ! তোমরা অধর্ম্মাচরণপূর্ব্বক আমার সতীত্ব ভঙ্গ করিলে; অতএব তোমাদিগের কুলকামিনীগণ সকলেই ব্যভিচারিণী হইবে। আর তোমরা কখনই এই ঘোরতর পাপ হইতে বিমুক্ত হইবে না। হে শল্য! এই নিমিত্তই অরট্টদিগের পুত্রেরা ধনাধিকারী না হইয়া ভাগিনেয়গণই ধনাধিকারী হইয়া থাকে। কুরু, পাঞ্চাল, শাল্ব, মৎস্য, নৈমিষ, কোশল, কাশ, পৌণ্ড্র, কলিঙ্গ, মগধ এবং চেদিদেশীয় মহাত্মারা সকলেই শাশ্বত পুরাতন ধর্ম্ম সবিশেষ অবগত আছেন এবং তদনুসারে কাৰ্য্য করিয়া থাকেন। অধিক কি বলিব, বাহীক, মদ্রক ও কুটিলহৃদয় পাঞ্চনদ ভিন্ন আর সকল দেশের অসাধু ব্যক্তিদিগেরও ধর্ম্মবিষয় বিদিত আছে।
‘হে মদ্ররাজ! তুমি এই সকল বৃত্তান্ত জ্ঞাত হইয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন কর। তুমি সেই সকল লোকদিগের রক্ষাকর্ত্তা এবং তাহাদিগের পুণ্যপাপের ষড়-ভাগহৰ্ত্তা অথবা প্রজা রক্ষা করিলেই রাজা তাহাদিগের পুণ্যভাগী হয়েন, তোমার ত’ তাহাদিগের রক্ষাৰ্থ যত্ন নাই, অতএব তুমি তাহাদিগের পুণ্যভাগের অধিকারী নহ, কেবল তাহাদিগের দুষ্কৃতিরই অংশ সংগ্রহ করিয়া থাক! পূর্ব্বে সত্যযুগে স্বর্গলোকপিতামহ ব্রহ্মা অন্যান্য সমুদয় দেশে সনাতন ধর্ম্ম পূজিত ও সকল বর্ণকে স্ব স্ব ধর্ম্মে অবস্থিত অবলোকন করিয়া পরমপরিতুষ্ট হইয়াছিলেন। কিন্তু পঞ্চনদদেশীয় ধর্ম্ম নিতান্ত কুৎসিত দেখিয়া ধিক্কার প্রদান করেন। হে শল্য! ব্রহ্মা যখন বাহীকদিগকে সত্যযুগেও কুকর্ম্মে প্রবৃত্ত দেখিয়া তাহাদের ধর্ম্মকে নিন্দা করিয়াছেন, তখন তোমার জনসমাজে বাক্যব্যয় করা নিতান্ত অনুচিত।
‘হে মদ্ররাজ! আমি পুনরায় তোমাকে কহিতেছি, শ্রবণ কর। পূর্ব্বে কল্মষপাদ নিশাচর “ক্ষত্রিয়গণের ভিক্ষাবৃত্তি এবং ব্রাহ্মণদিগের অব্রত [সংযম সদাচার ত্যাগ] মলস্বরূপ, বাহীকগণ পৃথিবীর মলস্বরূপ ও মদ্রদেশীয় কামিনীগণ অন্যান্য স্ত্রীদিগের মলস্বরূপ”, এই কথা বলিতে বলিতে সরোবরে নিমগ্ন হইতেছিল। ইত্যবসরে এক ভূপতি তাহাকে সেই সরোবর হইতে উদ্ধার করিয়া রাক্ষসবিদ্রাবক মন্ত্র জিজ্ঞাসা করাতে সে কহিল, -হে মহারাজ! কোন ব্যক্তি রাক্ষসকর্ত্তৃক উপদ্রুত হইলে এই মন্ত্র বলিয়া তাহার চিকিৎসা করিতে হয় যে, ম্লেচ্ছগণ [সাধারণ মনুষ্যমধ্যে ম্লেচ্ছ ও ম্লেচ্ছমধ্যে শ্লেচ্ছকলু নিন্দিত। তৈলপ্রস্তুতকারী কলুদিগের ষাঁড় অকর্ম্মণ্য; কারণ মৃদুগতিতে তাহাদের ঘানিটানা ভাল হয়, ষাঁড়ের চাঞ্চল্যপ্রযুক্ত তাহা হয় না, সুতরাং ষাঁড়, অকেজো। ক্ষত্রিয়গণের পৌরোহিত্য নিন্দিত, ক্ষত্রিয়ের যাজনে অধিকার নাই। অতএব তথাকথিত ম্লেচ্ছ, ম্লেচ্ছকুল ও কলুর ষাঁড় এবং ক্ষত্রিয় যাজক যাঁড়ের গোবর-অকেজো] মনুষ্যদিগের, তৈলিকগণ। ম্লেচ্ছদিগের, ষণ্ডগণ তৈলিকদিগের ও ঋত্বিক ভূপতিগণ ষণ্ডদিগের মলস্বরূপ। এক্ষণে তুমি যদি আমাকে পরিত্যাগ না কর, তাহা হইলে ঋত্বিকভূপতি ও মদ্রকদিগের ন্যায় পাপভাজন হইবে। পাঞ্চালেরা ব্রাহ্মধর্ম্ম, কৌরবেরা সাত্যধর্ম্ম এবং মৎস্য ও শূরদেশবাসীরা যাগযজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। পূর্ব্বদেশীয়েরা শূদ্রধর্ম্মাবলম্বী, দাক্ষিণাত্যগণ ধর্ম্মদ্রোহী, বাহীকেরা তস্কর ও সৌরাষ্ট্ৰীয়েরা সঙ্কর। কৃতঘ্নতা, পরবিত্তাপহরণ, মদ্যপান, গুরুপত্নীগমন, বাক্পারুষ্য [বাক্যের কর্কশতা], গোবধ, পারদারিকতা [পরস্ত্রী উপভোগ] ও পরবস্তু উপভোগ যাহাদিগের ধর্ম্ম, সেই আরট্টদিগের আর কি অধর্ম্ম হইতে পারে? অতএব পঞ্চনদ দেশকে ধিক্! হে মদ্ররাজ! পাঞ্চাল, কুরু, নৈমিষ ও মৎস্যদেশীয়েরা ধর্ম্মতত্ত্ব অবগত আছেন; আর উত্তরদিক্স্থিত অঙ্গ ও মগধদেশীয় বৃদ্ধগণ ধর্ম্মের স্বরূপ অবগত না হইয়াও শিষ্টজনের আচারের অনুসরণ করিয়া থাকেন।
‘দেব অগ্নিপ্রমুখ দেবগণ পূর্ব্বদিক্ আশ্রয় করিয়াছেন; পিতৃগণ পুণ্যকর্ম্মা যমরাজকর্ত্তৃক সুরক্ষিত দক্ষিণদিকে অবস্থান করিতেছেন; বরুণ পশ্চিমদিক্ আশ্রয় করিয়া সুরগণকে প্রতিপালন করিয়া থাকেন; ভগবান কুবের ও ঈশান ব্রাহ্মণগণের সহিত উত্তরদিক্ রক্ষা করিতেছেন; হিমাচল পিশাচ ও রাক্ষসগণকে এবং গন্ধমাদনপর্ব্বত গুহ্যকগণকে রক্ষা করিতেছেন; কিন্তু বাহীকদিগের প্রতি কোন বিশেষ দেবতার অনুগ্রহ নাই। সর্ব্বভূতরক্ষক বিষ্ণুই তাহাদিগকে রক্ষা করিতেছেন। আর দেখ, মাগধগণ ইঙ্গিতজ্ঞ ও কোশলদেশবাসীরা প্রেক্ষিতজ্ঞ। কৌরব ও পাঞ্চালগণ বাক্য অৰ্দ্ধ উচ্চারিত না হইলে ও শাল্বেরা সমগ্র বাক্য অভিহিত না হইলে কিছুই হৃদয়ঙ্গম করিতে সমর্থ হয় না। পাৰ্বতীয়গণ শিবিদিগের ন্যায় নিতান্ত নির্ব্বোধ। ম্লেচ্ছ ও যবনেরা সর্ব্বজ্ঞ ও মহাবলপরাক্রান্ত হইলেও মনঃকল্পিত ধর্ম্ম অনুষ্ঠান করিয়া থাকে এবং অন্যান্য জাতিরা হিতবাক্য উপদিষ্ট হইলে উহা স্বয়ং অবধারণ করিতে সমর্থ হয় না। বাহীকগণ তাড়িত হইলে হিতবাক্য বুঝিতে পারে; কিন্তু মদ্রদেশীয়েরা কোনক্রমেই হিতাবধারণে সমর্থ নহে। হে শল্য! তুমি সেই মদ্রদেশীয়, অতএব আর আমার বাক্যে প্রত্যুত্তর করিও না। এই ভূমণ্ডলে যে সমুদয় দেশ আছে, মদ্রদেশ সেই সকলের মলস্বরূপ বলিয়া কীৰ্তিত হয়। দেখ, মদ্যপান, গুরুতল্পগমন, ভ্রুণহত্যা ও পরবিত্তাপহরণ যাহাদের পরমধর্ম্ম, তাহাদের ত’ কোন কাৰ্য্যই অধর্ম্ম নহে, অতএব অরজ ও পাঞ্চনদদিগকে ধিক! হে শল্য! আমি যাহা কহিলাম, তুমি ইহা অবগত হইয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন কর। আমার প্রতিকূলাচরণ করা তোমার কর্ত্তব্য হইতেছে না। দেখিও, যেন পূর্ব্বে তোমাকে বিনাশ করিয়া পশ্চাৎ কেশব ও অর্জ্জুনকে সংহার করিতে না হয়।
শল্যের কর্ণশাসিত অঙ্গদেশনিন্দা
“অনন্তর মহাবীর শল্য কর্ণের সেই সমুদয় বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া কহিলেন, ‘হে সূতপুত্র! আতুর ব্যক্তিকে পরিত্যাগ ও পুত্ৰকলত্রদিগকে বিক্রয় করা অঙ্গদেশে সবিশেষ প্রচলিত আছে; তুমি সেই অঙ্গদেশের অধিপতি। মহাবীর ভীষ্ম রথাতিরথসংখ্যাকালে তোমার যেসকল দোষ কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন, তুমি এক্ষণে তৎসমুদয় অবগত হইয়া ক্রোধ সংবরণ কর। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এবং পতিপরায়ণা। রমণীগণ সর্ব্বত্রই বিদ্যমান আছেন, সর্ব্বস্থলেই পুরুষেরা পরস্পর পরস্পরকে পরিহাস করিয়া থাকে এবং ইন্দ্রিয়পরায়ণ ব্যক্তিরাও সর্ব্বত্র অবস্থান করে। হে কর্ণ! সকলেই পরদোষ কীৰ্ত্তন করিতে পারে। কিন্তু আত্মদোষে কাহারও দৃষ্টি নাই। লোকে আপনার দোষ জানিতে পারিয়াও বিস্মৃত হয়। স্বধর্ম্মপরায়ণ ভূপালগণ সর্ব্বত্র বিদ্যমান থাকিয়া দুষ্টদল দমন করিতেছেন; ধার্ম্মিকেরা সর্ব্বদেশেই বাস করিয়া থাকেন। এক দেশের সকল লোকেই যে অধর্ম্মাচরণ করে, ইহা নিতান্ত অসম্ভব। অনেক স্থানে অনেকে স্ব স্ব চরিত্র দ্বারা দেবগণকেও অতিক্রম করিয়াছেন।
“হে মহারাজ! ঐ সময় রাজা দুৰ্য্যোধন মদ্ররাজ ও সূতপুত্রকে পরস্পর বিবাদে প্রবৃত্ত দেখিয়া মিত্রভাবে কর্ণকে ও কৃতাঞ্জলিপুটে শল্যকে নিবারণ করিলেন। তখন কর্ণ দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক নিবারিত হইয়া আর প্রত্যুত্তর করিলেন না এবং শল্য শত্ৰুসংহারে অভিলাষী হইলেন। অনন্তর মহাবীর কর্ণ হাস্য করিয়া পুনরায় শল্যকে কহিলেন, ‘হে মদ্ররাজ! এক্ষণে তুমি রথসঞ্চালন কর।’