কয়েকদিন ধরেই আমি খাঁচার মধ্যে বন্ধ সিংহের মতন ছটফট করছি ঘরের মধ্যে। অবিরাম তুষারপাতের জন্য পায়ে হেঁটে বাইরে বেরুবার কোনও উপায় নেই। এশহরে আমার কোনও বন্ধু নেই যে আমায় তার গাড়িতে কোথাও লিফট দেবে। এমন পয়সাও নেই যে টেলিফোনে ট্যাক্সি ডাকতে পারি। সুতরাং আমি বন্দি।
অবশ্য আমার চেহারার সঙ্গে সিংহের কোনওই মিলই নেই। সত্যের খাতিরে খাঁচায় বন্দি বাঁদরের সঙ্গেই আমার উপমা দেওয়া উচিত। কিন্তু চেহারা যতই খারাপ হোক, কেই-ই বা নিজেকে বাঁদরের সঙ্গে তুলনা দিতে চায়, হলই বা বাঁদর আমাদের পূর্বপুরুষ!
তাপাঙ্ক নেমে গেছে শূন্যের নীচে কুড়ি-বাইশে। রাস্তার দুপাশে দু-তিন ফুট বরফ জমে আছে। গাড়ি চলাচলের জন্য অবশ্য রাস্তার মাঝখানটা কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর পরিষ্কার করে বালি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। রাস্তার ওই কালোত্বটুকু বাদ দিলে বাকি সবই সাদা ধপধপে। বাড়ির মাথায় বরফ, গির্জার চূড়ায় বরফ, পাইন গাছগুলি বরফে ঢাকা। ছোট-ছোট নদী ও হ্রদগুলোও জমে গেছে। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে এই শ্বেত দৃশ্যপট দেখতে-দেখতে এখন আমার একঘেয়ে লাগে।
আমি যে কেন এখানে পড়ে আছি তা আমি নিজেই জানি না। সঙ্গে রিটার্ন টিকিট আছে, যে কোনও মুহূর্তে ফিরে যেতে পারি। এক-একদিন খুব মন কেমন করে, আবার ভাবি, ফিরে গেলেই তো ফুরিয়ে গেল, আর তো আসা হবে না! দেশে তো কেউ আমার জন্য পায়েসের বাটি সাজিয়ে প্রতীক্ষা করে নেই। তা ছাড়া, মনের মধ্যে মাঝে-মাঝে একটা কাঁটার খোঁচা টের পাই, একটা বিশেষ জায়গা এখনও আমার দেখা হয়নি। সে জায়গাটা আমি দেখতে চাই না, অথচ না দেখেও ফিরে যেতে পারছি না।
আমি যে এখানে আছি, আমার অনুপস্থিত আশ্রয়দাতা তা জানেই না। সূর্যর ফিরে আসার কথা ছিল এতদিনে, কিন্তু ফেরেনি।
আমিও ওর নাইজিরিয়ার ঠিকানাটা নিয়ে রাখিনি, তাই চিঠি লিখতে বা টেলিফোন করতে পারছি না। এখানে অবশ্য আমার খরচ লাগছে না প্রায় কিছুই। সূর্যর ভাঁড়ারের চাল-ডাল এখনও ফুরোয়নি। আমি দিব্যি খিচুড়ি খেয়ে চালিয়ে দিচ্ছি।
এ শহরে কজন বাঙালি আছে তা টেলিফোন গাইড দেখে অনায়াসেই বার করা যায়। যেহেতু সূর্যর ঘরে পাঠ্য বই বিশেষ নেই তাই মাঝে মাঝে আমি টেলিফোন বইখানাই পড়ি, এই পুঁচকে শহরের টেলিফোন গাইড বইটি কলকাতার টেলিফোন গাইডের চেয়েও মোটা। পড়তে-পড়তে আমি একজন মুখার্জি, দুজন দাস, একজন সরকার, একজন মিস রায়চৌধুরীর সন্ধান পেলুম। মুসলমান নামও বেশ কয়েকটি আছে, এরা পৃথিবীর অনেক দেশেরই অধিবাসী হতে পারে, কিন্তু বাঙালি মুসলমানের নাম দেখলে আমি চিনতে পারি। একজন প্যালেস্টিনিয় গেরিলার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল, তার নাম আখমেদ, এক ইরানি মহিলাকে চিনি যার নাম তাহেরে সফরজাদে, এক মিশরি নাট্যকারকে চিনি যার নাম হ্যনি এলকাডি। এরকম নাম বাঙালি মুসলমানদের হয় না, কিন্তু সিরাজুল ইসলাম কিংবা রফিকুল আলম নির্ঘাত বাঙালি।
ছাপার অক্ষরে বাঙালিদের সন্ধান পেলেও আমার কোনও সুবিধে হল না। আমার চরিত্রে এই দোষ আছে, অচেনা লোকের সঙ্গে যেচে ভাব জমাতে পারি না। অনেকে বেশ পারে, তাদের আমি ঈর্ষা করি।
এই রকমভাবে কয়েকটা দিন কেটে যাওয়ার পর এসে গেলেন আমার উদ্ধারকর্তা।
সূর্যর ঘরে টেলিফোন প্রায়ই বাজে, নানান বিদেশি কণ্ঠ ওর খোঁজ নেয়। মাঝে-মাঝে আমি টেলিফোন ধরিও না, আপনমনে রুনুরুনু করে বেজে যায়। এক সকালে পরপর তিনবার টেলিফোন বাজতে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে রিসিভার তুলে গম্ভীর গলায় বললুম, হ্যালো?
ওপাশ থেকে একটি অকপট বাঙাল ভাষায় শোনা গেল, সূয্যিভাইডি, ফ্যারা হইল কবে? শরীল-টরিল ভালো আছেনি?
আমি বললুম, সূর্য এখনও ফেরেনি। কবে ফিরবে জানি না।
–আপনে কেডা?
–আমি সূর্যর বন্ধু। নিউইয়র্কে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, ও আমাকে ওর এই অ্যাপার্টমেন্টের চাবি দিয়ে গেছে।
–এ শহরে বাঙালি আইল অথচ আমি জানি না, এ তো বড় তাজ্জব কথা! কী নাম আপনের?
–আজ্ঞে, নীললোহিত।
–এ আবার কেমনধারা নাম! পদবি কী?
–ধরে নিন আমার পদবি লোহিত!
–ধইরা নেব? পদবি কি ধরার জিনিস? এ তো বাপ, ঠাকুরদার ব্যাপার। লোহিত পদবি জন্মে শুনি নাই।
–মেদিনীপুরের লোকেদের খাঁড়া, ধাড়া, বাঘ, হাতি এইরকম পদবি হয় না? তাহলে লোহিত হতে বাধা কী?
–ব্যাপারটা তেমন সুবিধার ঠ্যাকতাছে না। আপনে মশায় বার্গলার না তো? সূর্যির ঘরে অইন্য মানুষ। আপনি কী উদ্দেশ্যে আইছেন এখানে? কোথায় চাকরি পাইছেন?
–চাকরি পাইনি, বেড়াতে এসেছি।
–বেড়াইতে? এই ডিসেম্বর মাসে? খুবই সন্দেহজনক! আপনে ঘরেই থাকেন, বাইরাবেন না, আমি উইদিন ফিফটিন মিনিটস আইতাছি।
আমি বেশ সন্তুষ্টচিত্তেই ভদ্রলোকের প্রতীক্ষা করতে লাগলুম। বিদেশে এসেও যে লোক এমনভাবে বাঙাল ভাষাটি আঁকড়ে রেখেছে সে মহাশয় ব্যক্তি নিশ্চয়ই।
কাঁটায়-কাঁটায় ঠিক পনেরো মিনিটের মাথায় এসে হাজির হলেন ভদ্রলোক। দরজা খুলে আমি একটু চমকেই উঠলুম, বাঙাল ভাষা শুনলেই একজন ঢিলেঢালা গোছের মানুষের চেহারা মনে আসে। কিন্তু প্রথম দর্শনে এঁকে দেখে প্রায় সাহেব মনে হয়। টকটকে গৌরবর্ণ, বেশ দীর্ঘকায়, নিখুঁত সুট-টাই পরা, বয়েসে প্রায় প্রৌঢ়ই বলা চলে।
তীক্ষ্ণ নজরে প্রথমে আমার আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে তিনি ঘরে ঢুকে এলেন, চতুর্দিকে ঘুরে সবকিছু যাচাই করে দেখে তিনি বললেন, বার্গলারির কোনও প্রফ তো দ্যাখতে পাইতেছি না। আমার নাম শম্ভ মুখার্জি, আমি এখানের সক্কল বাঙালি সন্তানের লোকাল গার্জিয়ান। রহস্যময় আগন্তুক, আপনে কেডা সেইটা খুইল্যা কন তো!
আমি হাসতে-হাসতে সংক্ষেপে আমার পরিচয় জানালুম।
শম্ভু মুখার্জি নীরবে সবটা শুনে বললেন, লালন ফকিরের একটা গান আছে, জানো? মনের মতন পাগল খুঁইজে পাইলাম না! এই এতদিনে আমি পাইছি, একখান পাগল! হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।
তারপর তাঁর বিশাল হাত দিয়ে আমার কাঁধ চাপড়ে দিয়ে আবার বললেন, পাগল না হইলে কেউ এই ধাদ্ধারা গোবিন্দপুরে ডিসেম্বর মাসে আসে, না একা-একা ঘরের মধ্যে বইস্যা থাকে? এখন চলো আমার সঙ্গে! ধড়াচূড়া পইরা নাও! ওভারকোট আছে তো, নাকি তাও নাই?
সেদিনটা সারাদিনই আমি কাটিয়ে দিলাম শম্ভু মুখার্জির বাড়ি। সিডার র্যাপিডস-এর উপকণ্ঠে ওঁদের সুদৃশ্য নিজস্ব গৃহ, সেখানে ঢুকলেই বোঝা যায় ওঁরা এখানকার পুরোনো বাসিন্দা। শুনলাম, এদেশে ওঁদের কেটে গেছে উনিশ বছর। শম্ভু মুখার্জি বিশালদেহী পুরুষ হলেও তাঁর স্ত্রী বিনতা বেশ ছোট্টখাটো হাসিখুশি। বিনতাবউদি পুরো ঘটি, একটিও বাঙাল কথা বলেন না। এই দম্পতিটি নিঃসন্তান। রামকৃষ্ণ মিশনের দুটি গরিব ছাত্রের পড়াশুনোর খরচ চালাবার জন্য এঁরা নিয়মিত টাকা পাঠান।
শম্ভু মুখার্জি কাছাকাছি এক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ফিজিকসের অধ্যাপক। রীতিমতন পণ্ডিত মানুষ। আবার অবসর সময়ে ছবি আঁকেন। বিনতা বউদিও পড়ান একটি বিকলাঙ্গের স্কুলে, যা মাইনে পান তা সেই স্কুলকেই দান করেন।
এসব কথা আমি জানতে পারলুম আস্তে আস্তে অন্যদের মুখে। আমার খেয়ালই ছিল না যে আজ রবিবার। ছুটিছাটার দিনে অনেকেই আসে এ বাড়িতে আড্ডা দিতে। শুধু বাঙালিরা নয়, যেকোনও ভারতীয়রই এ বাড়িটি একটি আড্ডাস্থল। যে-কোনও ভারতীয় ছাত্র যদি হঠাৎ বিপদে পড়ে কিংবা কোনও সেমেস্টারে অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ না পায়, তাহলে শম্ভু মুখার্জি দম্পতি অতি গোপনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন তাদের দিকে।
বিনতা বউদি রান্না করতে এবং খাওয়াতে ভালোবাসেন। আর শম্ভুদা ভালোবাসেন তাস খেলায় হেরে যেতে এবং সেই উপলক্ষে কৃত্রিম রাগারাগি করতে। একটু বেলা পড়তেই এসে হাজির হল নির্মল সরকার, অনন্য দাস, সুধীর পটনায়ক, সিরাজুল ইসলাম, সুরেশ যোশী। তাস খেলায় হেরে গিয়ে শম্ভুদা সবাইকেই কাঠ বাঙাল ভাষায় গালাগাল দেন। এই দিলদরিয়া আড্ডাবাজ মানুষটিকে দেখতে-দেখতে আমার মনে হয়, ইস, সৈয়দ মুজতবা আলি যদি এঁকে দেখতেন, তাহলে কী দুর্দান্ত একটা চরিত্র বানিয়ে ফেলতে পারতেন।
আমার অনুমান নির্ভুল, সিরাজুল ইসলাম আর রফিকুল আলম দুজনেই বাঙালি, একজন পশ্চিম বাংলার, অন্যজন বাংলাদেশের। এর মধ্যে রফিকুল আমায় চেপে ধরল, আপনি একা একা কাটাচ্ছেন কেন? আমার ওখানে চলে আসুন। আরও অনেকেই এই প্রস্তাব দিল, শম্ভুদা বিনতাবউদি তো বটেই। কিন্তু আমি রাজি হলুম না। আসলে একা থাকতে আমার ভালোই লাগে। আমি সাধুসন্ন্যাসী নই। দিনের পর দিন নির্জনতা সহ্য করতে পারি না ঠিকই, কিন্তু দিনের কিছুটা অংশ শুধু নিজের মুখোমুখি বসে থাকাটা আমি বেশ উপভোগ করি।
সূর্যর অ্যাপার্টমেন্টেই রয়ে গেলুম বটে, কিন্তু প্রতিদিনই কারুর না কারুর বাড়িতে নেমন্তন্ন লেগেই রইল। সকলেরই গাড়ি আছে, তারা আমায় নিয়ে যায়, পৌঁছে দেয়।
প্রচণ্ড শীতেও এখানকার অফিস-কাছারি-দোকানপাট সবই খোলা থাকে, তবে বেশিদূর ঘোরাঘুরি বা বেড়ানোর ব্যাপার বন্ধ হয়ে যায়। কিছু ডাকাবুকো সাহেবের কথা আলাদা, এই শীতেও তারা পাহাড়ে যায় স্কি করতে। বেশিরভাগ ভারতীয়েরই এমন শখ নেই। তারা কাছাকাছি আড্ডা দিতে যায়। এই শীতের সময় হাইওয়েতে রাত্তিরবেলা যদি গাড়ি খারাপ হয়ে যায়, তাহলে ধনেপ্রাণে মৃত্যু অসম্ভব কিছু না। কাগজে এরকম খবর মাঝে মাঝেই বেরোয়।
শীতের মধ্যে বেরুবার ঝক্কি-ঝামেলাটা বেশ বিরক্তিকর। বাইরে বরফ পড়লেও বাড়ির মধ্যে গরম, স্রেফ একটা গেঞ্জি পরে কাটিয়ে দেওয়া যায়। বাইরে বেরুতে হলে সেই গেঞ্জির ওপরে পরতে হবে শার্ট, তারপর সোয়েটার বা জ্যাকেট, তার ওপরে ওভারকোট, হাতে চামড়ার দস্তানা, মাথায় টুপি, পায়ে গরম মোজা আর লম্বা জুতো। এতসব মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য, শুধু বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে হবে–ওই কয়েক পা যাওয়ার জন্য এত সতর্কতা। গাড়ির মধ্যে আবার গরম। যে বাড়িতে পৌঁছব, সেবাড়িও গরম। সেখানে গিয়েই আবার সব খুলে ফেলতে হবে।
পরের শনিবার সন্ধেবেলা শম্ভুদার বাড়িতে বিরাট পার্টি হল। সর্বভারতীয় সম্মেলন তো বটেই, কয়েকজন সাহেব-মেমও এসেছে। এই পার্টিতে হল আমার এক নতুন অভিজ্ঞতা। এখানেই আমি প্রথম সাক্ষাৎ পেলুম একটু শিক্ষিত, শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান বেকার যুবকের।
আমি অল্প কয়েকমাস আগে ভারত থেকে এসেছি এবং শিগগিরই ভারতে ফিরে যাব শুনে এই যুবকটি বেশ আগ্রহের সঙ্গে আলাপ করতে লাগল আমার সঙ্গে। ছেলেটিকে সবাই ডিক বলে ডাকছিল। (বাংলা রামা-শ্যামা-যদুর ইংরেজি হল টম-ডিক অ্যান্ড হ্যারি। আজকাল বাঙালিদের মধ্যে রাম-শ্যাম-যদু নাম বিশেষ শোনা যায় না, কিন্তু এদেশে টম-ডিক-হ্যারি এখনও অজস্র) ডিকের বয়স তিরিশের কাছাকাছি, মাঝারি উচ্চতা, মাথার চুল কোঁকড়া। অধিকাংশ আমেরিকানের মুখেই একটা অহংকারী আত্মপ্রত্যয়ের ভাব থাকে, সেই তুলনায় এর মুখখানি বেশ বিনীত আর তৈলাক্ত। সেই দেখেই আমার সন্দেহ করা উচিত ছিল, কিন্তু ছেলেটি আমায় পরিচয় দিল যে সে টিভি-তে সোপ-অপেরার স্ক্রিপ্ট লেখে, ছোটখাটো ভূমিকায় অভিনয়ও করে।
ডিক খুব সিনেমায় উৎসাহী, পৃথিবীর মধ্যে ভারতেই সবচেয়ে বেশি সিনেমা তৈরি হয় কেন, সে সম্পর্কে ওর খুব কৌতূহল। আমি আবার এই সব ব্যাপার খুবই কম জানি। হু-হাঁ দিয়ে কাজ চালাতে লাগলুম। ডিক বাংলা ফিলম সম্পর্কেও কিছু খবর রাখে। কথায়-কথায় ও আমায় জিগ্যেস করল, তুমি সত্যজিৎ রায়কে চেনো? তিনি তো ক্যালকাটা বেজড, তাই না? তোমার সঙ্গে আলাপ আছে নিশ্চয়ই?
সত্যজিৎ রায় পৃথিবীবিখ্যাত মানুষ, আমাদের কাছে অনেক দূরের লোক। দূর থেকে তাঁকে দু-একবার দেখেছি বটে কিন্তু কখনও কথা বলার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারিনি। কিন্তু এই সব ক্ষেত্রে একটু আধটু মিথ্যে কথা বলার লোভ সংবরণ করা শক্ত। আমি সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বললুম, হ্যাঁ হ্যাঁ চিনি।
ছেলেটিও তৎক্ষণাৎ বলল, তুমি সত্যজিৎ রায়কে বলে ওঁর কোনও ফিলমে আমার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারো।
এবার আমার আকাশ থেকে পড়ার মতন অবস্থা। চাকরি? সত্যজিৎ রায়ের কাছে? আমি তার ব্যবস্থা করে দেব? আমতা-আমতা করে বললুম, মানে, সত্যজিৎ রায়ের নিজস্ব ইউনিট আছে, তা ছাড়া দেশবিদেশের অনেকেই ওঁর সঙ্গে কাজ করার জন্য উন্মুখ শুনেছি, সেইজন্য সুযোগ পাওয়া খুবই শক্ত।
–তুমি তাহলে অন্য কোনও বাংলা ছবিতে আমার একটা কাজ জোগাড় করে দিতে পারবে? আমার কিছু কিছু অভিজ্ঞতা আছে, আমার বেশি টাকা চাই না, আমি কষ্ট করেও থাকতে পারব।
আমি মনে মনে ভাবলুম, বাংলা সিনেমার যা দুরবস্থার কথা শুনেছি, অনেক টেকনিশিয়ানই খেতে পায় না, সেখানে একজন আমেরিকান পোষা তো অসম্ভব ব্যাপার। তা ছাড়া এক বর্ণ বাংলা-না-জানা সাহেব নিয়ে বাংলা সিনেমা করবেই বা কী?
ডিক বলল, তোমায় আমার বায়োডাটা আর কিছু কিছু ক্রেডেনশিয়ালস দিয়ে দিতে পারি, তুমি যদি ইন্ডিয়াতে আমার জন্য একটা চাকরির চেষ্টা করো–
আমি একটা অছিলা দেখিয়ে উঠে পড়লুম তার পাশ থেকে, তবু সে সঙ্গ ছাড়ে না। বারবার ওই একই কথা বলতে লাগল।
অনেক রাত্তিরে পার্টির বেশিরভাগ লোক চলে যাওয়ার পর শম্ভুদার সঙ্গে আমরা কয়েকজন বসলুম জমিয়ে আড্ডা দিতে। বিনতাবউদি জিগ্যেস করলেন, ওই ডিক তোমাকে অত কথা কী বলছিল?
আমি বললুম, আমার কাছে চাকরি চাইছিল। ভেবে দেখুন ব্যাপারটা, ভারতে কোটি কোটি বেকার, আমি স্বয়ং বেকার, আর আমার কাছেই কিনা চাকরি চাইছে একজন আমেরিকান।
বিনতাবউদি বললেন, এখন এদেশেও ষোলো পার্সেন্ট বেকার!
সিরাজুল বলল, সাবধান, ও কিন্তু সুযোগ পেলেই টাকা ধার চাইবে। আমার কাছ থেকে পঁচিশ ডলার নিয়েছে।
শম্ভুদা বললেন, ছেলেটা খুব কষ্টে পড়েছে। একটা কলেজে চাকরি করত, কী কারণে যেন চাকরি গেছে, আমাদের ইউনিভার্সিটিতে আপাতত কোনও পোস্ট খালি নেই, আমি চেষ্টা করছি ওর জন্য…ওর বউটাও পালিয়েছে ওকে ছেড়ে, একটা আট বছরের ছেলেকে নিয়ে ও ট্রেলার হাউসে থাকে, খুব টানাটানির মধ্যে পড়েছে
আমি বললুম, ও যে বলছিল, টিভি-র নাটকের স্ক্রিপ্ট লেখে, অভিনয় করে?
শম্ভুদা বললেন, ধুৎ! সে সব বাজে কথা। কয়েকটা স্ক্রিপ্ট পাঠিয়েছে, একটাও নেয়নি ওরা। দু-একটা কমার্শিয়ালে শুধু মুখ দেখানো অভিনয় করেছে, তাতে কী হয়!
পরদিন সকালেই ডিক আমার কাছে এসে হাজির। সঙ্গে একগাদা কাগজপত্র। ওর নানান যোগ্যতার সার্টিফিকেটের কপি। বারবার বলতে লাগল ইনিয়ে বিনিয়ে, ইন্ডিয়াতে গিয়ে কাজ করার খুব ইচ্ছে, তুমি যদি একটা কাজ জোগাড় করে দিতে পারো, মাইনে বেশি চাই না, অন্তত তিনশো ডলার হলেই আমি চালিয়ে নিতে পারব–।
তিনশো ডলার ও দেশে খুবই সামান্য টাকা, মাস চালানো কঠিন। কিন্তু ভারতীয় মুদ্রায় তা সাতাশ শো টাকা। অত টাকা এদেশে কজন রোজগার করে!
এ ক্ষেত্রে নিরুপায় হয়ে আমায় মিথ্যে স্তোকবাক্য দিতেই হল, হ্যাঁ হ্যাঁ, চেষ্টা করব, আমি নিশ্চয়ই চেষ্টা করব তোমার জন্য–।