৩৫তম অধ্যায়
জীবন্মুক্তি–জীব-ঈশ্বরের ঐক্য
অর্জ্জুন কহিলেন, “বাসুদেব! এক্ষণে তোমার প্রসাদবলে সূক্ষ্মবিষয় অবগত হইতে আমার একান্ত অভিলাষ হইতেছে; অতএব তুমি যথার্থরূপে আমার নিকট পরম ব্রহ্মের স্বরূপ কীৰ্ত্তন, কর।”
তখন বাসুদেব অৰ্জ্জুনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “ধনঞ্জয়! আমি এই উপলক্ষ্যে গুরুশিষ্যসংবাদ নামক এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা এক শিষ্য আসনোপবিষ্ট স্বীয় উপাধ্যায়কে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘ভগবন্! আমি মুক্তিপরায়ণ হইয়া আপনার শরণাগত হইলাম; অতএব এক্ষণে আমি যে যে বিষয় জিজ্ঞাসা করিতেছি এবং যাহা আমার পক্ষে শ্রেয়ঃ, আপনি অনুগ্রহপূর্ব্বক আমার নিকট তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করুন।’
“শিষ্য এই কথা কহিলে আচার্য্য তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বৎস! যেসমুদয় বিষয়ে তোমার সংশয় উপস্থিত হইয়াছে, তৎসমুদয় ব্যক্ত কর, আমি একাদিক্রমে তোমার সমুদয় সংশয় অপনোদন করিব। তখন শিষ্য কহিলেন, “ভগবন্! আমার জিজ্ঞাস্য এই যে, আপনার, আমার এবং এই অন্যান্য স্থাবরজঙ্গম পদার্থসমুদয়ের উৎপত্তির কারণ কে? জীবগণ কাহার প্রভাবে জীবিত রহিয়াছে? প্রাণীগণের পরমায়ু এবং সত্য ও তপস্যা কি পদার্থ? সাধুগণ কোন্ কোন্ গুণের প্রশংসা করেন? কোন্ কোন্ পথ মঙ্গলজনক এবং কাহাকে পুণ্য ও কাহাকেই বা পাপ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়? আপনি আমার এই সমুদয় প্রশ্নের সদুত্তর প্রদান করুন। আপনি ভিন্ন এ সমুদয় প্রশ্নের সদুত্তরদাতা আর কেহই নাই। লোকে আপনাকে মোক্ষধৰ্ম্মপারদর্শী বলিয়া কীর্ত্তন করিয়া থাকে। এক্ষণে আমিও মুমুক্ষু হইয়া আপনার নিকট সমাগত হইয়াছি; অতএব আপনি আমার এই সমুদয় সংশয় অপনোদন করুন।’
“শান্তিগুণাবলম্বী, দমগুণসম্পন্ন, ছায়ার ন্যায় গুরুর একান্ত অনুগত, ব্রহ্মচর্য্যনিরত শিষ্য এইরূপ প্রশ্ন করিলে, ব্ৰতাবলম্বী, অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন আচার্য্য তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘বৎস! তুমি বেদবিদ্যানুসারে আমার নিকট যেসমুদয় প্রশ্ন করিলে, আমি তাহার উত্তর প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর। জ্ঞানই পরব্রহ্ম এবং সন্ন্যাসই উৎকৃষ্ট তপস্যা। যে ব্যক্তি নিগৃঢ়ভাবে জ্ঞানতত্ত্ব অবগত হইতে সমর্থ হয়, তাহার সমুদয় কামনা পরিপূর্ণ হইয়া থাকে। যিনি দেহের সহিত আত্মার অভিন্ন ও ভিন্নভাব এবং জীবের সহিত ঈশ্বরের অভিন্ন ও ভিন্নভাব দর্শন করেন, তাঁহার দুঃখের লেশমাত্র থাকে না। যে ব্যক্তি অহঙ্কার ও মমতাপরিশুন্য হইয়া মায়া, সত্ত্বাদিগুণ ও সৰ্ব্বভূতের কারণকে অবগত হইতে পারেন, তিনিই জীবন্মুক্ত। যে ব্যক্তি ব্ৰহ্মরূপ বীজপ্রভাবে প্রকৃতিকে অঙ্কুরিত, বুদ্ধিরূপ স্কন্ধ, অহঙ্কাররূপ পল্লব, ইন্দ্রিয়রূপ কোটর, মহাভূতরূপ শাখা, কাৰ্য্যরূপ প্রশাখা, আশারূপ পত্র, সঙ্কল্পরূপ পুষ্প ও শুভাশুভঘটনারূপ ফলসম্পন্ন দেহরূপ বৃক্ষকে সবিশেষ অবগত হইয়া জ্ঞানরূপমহাখড়্গদ্বারা ছেদন করিতে পারেন, তাঁহাকে কখনই জন্মমৃত্যুজনিত দুঃখসম্ভোগ করিতে হয় না।
‘এক্ষণে মনীষিগণ যাঁহাকে অবগত হইলে সিদ্ধিলাভ করিতে সমর্থ হয়েন, সেই ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমানের আদি, ধৰ্ম্ম, কাম ও অর্থের নিশ্চয়জ্ঞ, সিদ্ধিসমূহের পরিজ্ঞাত, নিত্য, সর্ব্বোৎকৃষ্ট ঈশ্বরের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা প্রজাপতি দক্ষ, ভরদ্বাজ, গৌতম, ভার্গব, বশিষ্ঠ, কশ্যপ, বিশ্বামিত্র ও অত্রি কর্ম্মপথ পরিভ্রমণনিবন্ধন একান্ত শ্রান্ত হইয়া বৃহস্পতিকে পুরোবৰ্ত্ত করিয়া ভগবান্ ব্রহ্মার নিকট গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভগবন! কিরূপে সৎকৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য? কি প্রকারে পাপ হইতে মুক্ত হওয়া যায়? কোন্ পথ আমাদিগের মঙ্গলজনক? সত্য ও পাপের লক্ষণ কি? মৃত্যু ও মোক্ষপথের বৈলক্ষণ্য কি এবং প্রাণীগণের উৎপত্তি ও বিনাশই বা কিপ্রকারে হইয়া থাকে, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
মুক্তিকামীর কর্ত্তব্যনির্ণয়—বর্ণাশ্রমসেবা
‘মহর্ষিগণ এইরূপ জিজ্ঞাসা করিলে, ভগবান ব্রহ্মা তাঁহাদিগকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “হে তপোধনগণ! স্থাবরজঙ্গমাত্মক ভূতসমুদয় একমাত্র সত্যস্বরূপ ঈশ্বর হইতে উৎপন্ন হইয়া স্ব স্ব কৰ্ম্মপ্রভাবে জীবিত থাকে। উহারা কর্ম্মদ্বারা আপনাদিগের নিত্যমুক্ত স্বভাব পরিত্যাগপূৰ্ব্বক জন্মমৃত্যুভাব প্রাপ্ত হইয়া অবস্থান করিতেছে। সত্য স্বভাবতঃ নির্গুণ। যখন উহা সগুণ হয়, তখন উহাকে ঈশ্বর, ধর্ম্ম, জীব, আকাশাদি ভূত ও জরায়ুজাদি প্রাণী এই পাঁচ প্রকার বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। এই হেতু ব্রাহ্মণেরা নিত্যযোগপরায়ণ, ক্রোধশূন্য, সন্তাপবিমুক্ত ও ধর্ম্মের সেতুস্বরূপ হইয়া সত্যকে আশ্রয় করিয়া থাকেন।
“এক্ষণে যাঁহারা পরস্পরের তমঃপ্রভাবে কদাচই ধৰ্ম্ম অতিক্রম করেন না, সেই বিদ্যমান্ ধৰ্ম্মপ্রবর্ত্তক লোকভাবন ব্রাহ্মণগণের শুভসম্পাদনার্থ চারিবর্ণ ও চারি আশ্রমের নিত্য চতুষ্পদ ধৰ্ম্ম, ধর্ম্মার্থ প্রভৃতি চতুৰ্ব্বর্গ এবং বিজ্ঞ লোকেরা ব্রহ্মভাবলাভের নিমিত্ত যে পথ অবলম্বন করিয়াছিলেন, সেই শুভজনক পথের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। আশ্রমচতুষ্টয়ের মধ্যে ব্রহ্মচর্য্যাশ্রম প্রথম, গার্হস্থ্য দ্বিতীয়, বানপ্রস্থ তৃতীয় ও সন্ন্যাস চতুর্থ। যে কাল পর্য্যন্ত যোগীদের আত্মজ্ঞানলাভ না হয়, সেই কাল পর্য্যন্ত তাহারা জ্যোতি, আকাশ, আদিত্য, বায়ু, ইন্দ্র ও প্রজাপতি প্রভৃতি বিবিধ বিভিন্ন রূপ দর্শন করেন, কিন্তু আত্মজ্ঞান লাভ হইলে আর তাঁহাদিগের বিভিন্নজ্ঞান থাকে না। তখন তাঁহাদিগের হৃদয়ে একমাত্র ব্রহ্মই উদ্ভাসিত হইতে থাকে। এক্ষণে মোক্ষের উপায় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ব্রহ্মচর্য্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস এই তিনটিই মোক্ষসাধক প্রধান ধর্ম্ম। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণেরই ওই ধৰ্ম্মত্ৰয়ে অধিকার আছে। গার্হস্থ্যধৰ্ম্ম সমুদয় বর্ণের পক্ষে বিহিত হইয়াছে। পণ্ডিতগণ শ্রদ্ধাকে ওই ধর্ম্মের প্রধান লক্ষণ বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়াছেন।
“এই আমি তোমাদিগের নিকট ব্রহ্মজ্ঞানের উপায়ভূত পথসমুদয় কীৰ্ত্তন করিলাম। সাধু ব্যক্তিরা সঙ্কৰ্ম্মসহকারে ওই সমুদয় পথে পদার্পণ করিয়া থাকেন। যে ব্যক্তি ব্রতপরায়ণ হইয়া ওই ব্রহ্মচর্য্য প্রভৃতি ধৰ্ম্মের অন্যতম আশ্রয় করেন, তিনি কালসহকারে মুক্ত হইয়া প্রাণীগণের জন্মমৃত্যুদর্শনে সমর্থ হয়েন। অতঃপর যথার্থরূপে তত্ত্বসমুদয়ের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার, প্রকৃতি, একাদশ ইন্দ্রিয়, পৃথিব্যাদি পঞ্চভূত, গন্ধাদি পঞ্চ বিষয় এবং জীবাত্মা এই পঞ্চবিংশতিকে তত্ত্ব বলিয়া কীৰ্ত্তন করা যায়। যে ব্যক্তি ওই পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের উৎপত্তি ও বিনাশ অবগত হইতে সমর্থ হয়েন, তাঁহাকে আর কখনই মুগ্ধ হইতে হয় না। ফলতঃ যিনি ওই সমুদয় তত্ত্ব, সত্ত্বাদিগুণ ও ইন্দ্রিয়াধিষ্ঠাত্রী দেবতাগণকে সবিশেষ অবগত হয়েন, তাহার পাপের লেশমাত্র থাকে না। তিনি সমুদয় বন্ধন হইতে বিমুক্ত হইয়া সমুদয় লোকলাভে সমর্থ হইয়া থাকেন।”