৩৫৫. প্রশ্নশ্রবণে গৃহাগত অতিথির ধর্ম্মভাব স্ফুরণ

৩৫৫তম অধ্যায়

প্রশ্নশ্রবণে গৃহাগত অতিথির ধর্ম্মভাব স্ফুরণ

ভীষ্ম বলিলেন, “অনন্তর অতিথি সম্পূর্ণরূপে পরিশ্ৰমাপনোদন করিলে, ব্রাহ্মণ তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘ব্রহ্মন্! আমি আপনার দর্শন ও সুমিষ্ট বাক্যশ্রবণে অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি। এক্ষণে আপনাকে মিত্রভাবে কিছু কহিতেছি, অনন্যমনে তাহা শ্রবণ করুন। গার্হস্থ্যধৰ্ম্মের সমস্ত ভার পুত্রের উপর সমর্পণ করিয়া সন্ন্যাসধর্ম্ম অবলম্বনপূৰ্ব্বক জীবাত্মা ও পরমাত্মার একতা প্রতিপাদন করিতে আমার অভিলাষ হইয়াছে; কিন্তু আমি বিষয়পাশে বদ্ধ হইয়া উহার অনুষ্ঠান করিতে পারিতেছি না। যাহা হউক, অতঃপর আমি যাবৎকাল জীবিত থাকিব, সেই বহুফলাত্মক [পরলোক গমনে পথের সম্বলস্বরূপ ফলপ্রদানস্বভাব কৰ্ম্ম করিয়াই কাল কাটাইব] পারলৌকিক পাথেয় করিয়াই কালাতিপাত করিব। এই ভবসাগরের পরপারে গমন করিবার নিমিত্ত আমার শুভবুদ্ধি উপস্থিত হইয়াছে; কিন্তু এক্ষণে ধৰ্ম্মময় ভেলা কোথায় পাইব? দেবতা প্রভৃতি সকলেই ধৰ্ম্মফলপ্রভাবে একবার স্বর্গে গমন ও পুনরায় ভূলোকে আগমন করিতেন; যমরাজের ধ্বজপতাকাসদৃশ রোগশোকাদি নিরন্তর প্রজাগণমধ্যে সঞ্চরণ করিতেছে এবং পরিব্রাজকেরা অন্নবস্ত্রের নিমিত্ত লোকের দ্বারে দ্বারে লালায়িত হইয়া পরিভ্রমণ করিতেছেন। এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া আমার মন কোন ধর্ম্মেই অনুরক্ত হইতেছে না; অতএব এক্ষণে আপনি বুদ্ধিবল আশ্রয়পূর্ব্বক আমাকে কোন উৎকৃষ্ট ধর্ম্মপথে নিয়োগ করুন।

“ধৰ্ম্মার্থী ব্রাহ্মণ এইরূপ বাক্য প্রয়োগ করিলে মহাপ্রাজ্ঞ অতিথি মধুরবাক্যে কহিলেন, “ব্ৰহ্মন্! আপনার ন্যায় আমারও উৎকৃষ্ট ধর্ম্মলাভে অতিশয় স্পৃহা হইতেছে; কিন্তু কোটি ধৰ্ম্ম, তাহা নির্ণয় করিতে গিয়া আমি নিতান্ত বিমুগ্ধ হইয়াছি। আমার সংশয় কোনক্রমেই অপনীত হয় নাই। ইহলোকে কোন কোন মহাত্মারা মুক্তির ও কেহ কেহ যজ্ঞফলের সবিশেষ প্রশংসা করেন এবং কেহ কেহ গার্হস্থ্য, কেহ কেহ বানপ্রস্থ, কেহ কেহ জ্ঞানধৰ্ম্ম, কেহ কেহ গুরুশ্রূষাদি ধৰ্ম্ম ও কেহ কেহ বাক্‌সংযমকে প্রিয়তর জ্ঞান করিয়া থাকেন। কতকগুলি বুদ্ধিমান লোক কেবল মাতাপিতার সেবা, কেহ কেহ অহিংসাধৰ্ম্মের অনুষ্ঠান, কেহ কেহ সত্যপ্রতিপালন, কেহ কেহ সর্ম্মুখযুদ্ধে দেহপরিত্যাগ, কেহ কেহ উচ্চব্রতসাধন এবং কেহ কেহ বেদব্রতপরায়ণ ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া অনবরত বেদাধ্যয়ন করিয়া স্বর্গলাভ করিয়াছেন। কোন কোন সরলপ্রকৃতি মহাত্মা কুটিলব্যক্তিকর্ত্তৃক নিহত হইয়া দেবলোকে বিহার করিতেছেন। হে মহাত্ম! এইরূপ বহুবিধ ধর্ম্মের দ্বার উন্মুক্ত রহিয়াছে, কিন্তু কোনটি শ্রেয়ঃ, তাহা স্থির করিতে গিয়া আমার মন সমীরণসঞ্চালিত [বায়ুচালিত মেঘের] জলদের ন্যায় নিতান্ত চঞ্চল হইয়াছে! ”