৩৫২তম অধ্যায়
অনিরুদ্ধাদি চতুর্ব্যূহাত্মক নারায়ণের ঐক্য
ব্রহ্মা বলিলেন, “হে বৎস! পণ্ডিতেরা ভগবান নারায়ণকে শাশ্বত, অব্যয়, অপ্রমেয় ও সর্ব্বময় বলিয়া থাকেন। কি তুমি, কি আমি, কি অন্যানা ব্যক্তি কেহই তাঁহাকে দর্শন করিতে সমর্থ হয় না। তিনি বুদ্ধীচ্ছিসম্পন্ন শমদমদিবিহীন মূঢ়দিগের জ্ঞানের অগোচর। ঐ নিরাকার পুরুষ সমুদয় লোকের শরীরে অবস্থান করিয়াও শুভাশুভ কার্য্যসমুদয়ে নির্লিপ্ত রহিয়াছেন। তিনি আমাদিগের সকলেরই অন্তরাত্মা ও সাক্ষিস্বরূপ; অথচ আমরা কেহই তাঁহাকে পরিজ্ঞাত হইতে পারি না। সমুদয় ব্রহ্মাণ্ডই তাঁহার মস্তক, ভুজ, পদ ও নাসিকাস্বরূপ। তিনি একাকী স্বেচ্ছাচারী হইয়া পরমসুখে সৰ্ব্বদেহে বিচরণ করিতেছেন। শরীররূপ ক্ষেত্র ও শুভাশুভ কৰ্ম্মরূপ বীজ তাঁহার বিদিত আছে, এই নিমিত্ত তিনি ক্ষেত্রজ্ঞ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকেন। তিনি কিরূপে প্রাণীগণের দেহ ও আশ্রয় কিরূপে পরিত্যাগ করেন, তাহা কেহই পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ হয় না। আমি সাস্থ্যবিধি ও যোগবল আশ্রয় করিয়া তত্ত্বচিন্তায় তৎপর হইয়াছি, কিন্তু কোনরূপেই সেই পরমতত্ত্ব পরিজ্ঞাত হইতে পারিতেছি না। এক্ষণে আত্মজ্ঞানানুসারে সেই সনাতন পুরুষের একত্ব ও মহত্ত্ব কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
“পণ্ডিতেরা তাঁহাকে অদ্বিতীয় পুরুষ বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। মহাপুরুষ শব্দ কেবল তাঁহাতেই অবস্থিত রহিয়াছে। যেমন একমাত্র হুতাশন বিবিধরূপে প্রজ্বলিত হয়েন, তদ্রূপ সেই একমাত্র নারায়ণ বিবিধরূপে প্রকাশিত হইয়া থাকেন। যেমন একমাত্র সূর্য্য সমুদয় জগৎ প্রকাশিত করেন, তদ্রূপ সেই একমাত্র পুরুষদ্বারা সমুদয় জগৎ প্রকাশিত হয়। যেমন একমাত্র বায়ু ইহলোকে সৰ্ব্বত্র প্রবাহিত হইয়াও কিছুতেই লিপ্ত হয়েন না, তদ্রূপ সেই একমাত্র নারায়ণ সর্ব্বত্ৰ সঞ্চরণ করিয়াও নির্লিপ্তভাবে অবস্থান করেন এবং যেমন সমুদ্র সমুদয় জলের উৎপত্তি ও লয়ের স্থান, তদ্রূপ সেই একমাত্র পুরুষ সমুদয় জগতের উৎপত্তি ও প্রলয়ের কারণ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকেন। যে ব্যক্তি দেহেন্দ্রিয়াদির অভিমান, শুভাশুভকার্য্য এবং সত্য ও মিথ্যা পরিত্যাগ করিতে পারেন, তিনি নির্গুণ হইয়া থাকেন। যে মহাত্মা যোগবলে সেই মনের আগোচর পরমপুরুষকে পরিজ্ঞাত হইয়া ক্ৰমে অনিরুদ্ধের সহিত প্রদ্যুম্নের, প্রদ্যুম্নের সহিত সঙ্কর্ষণের ও সঙ্কর্ষণের সহিত বাসুদেবের একীভাব সম্পাদনপূৰ্ব্বক সমাধি করিতে পারেন, তিনিই সেই পরমপুরুযে প্রবেশ করিতে সমর্থ হয়েন।
‘যোগবিৎ পণ্ডিতেরা সেই পরমপুরুষ পরমাত্মাকে জীবাত্মা হইতে শ্রেষ্ঠ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। সাঙ্খ্যবিৎ পণ্ডিতেরা জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। পণ্ডিতেরা পরমাত্মাকেই নির্গুণ, সৰ্ব্বময় ও নারায়ণ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। পদ্মপত্র যেমন সলিলে লিপ্ত হয় না, তদ্রূপ তিনি সর্ব্বদাই কৰ্ম্মফলে নির্লিপ্ত রহিয়াছেন। জীবাত্মা কখন মোক্ষপ্রাপ্ত, কখন বা বিষয়ভোগে আসক্ত হইতেছেন। তাঁহাকে লিঙ্গশরীরে অধিষ্ঠিত হইয়া দেবমনুষ্যাদি বিবিধ মূৰ্ত্তিধারণপূৰ্ব্বক অবস্থান করিতে হয়। এই নিমিত্ত পণ্ডিতেরা পুরুষের বহুত্ব স্বীকার করেন। কিন্তু বস্তুতঃ পুরুষ একমাত্র। সেই সৰ্ব্ব প্রকাশক পুরুষই মন্তা ও মন্তব্য [মানী, মননযোগ্য], ভোক্তা ও ভোগ্য, রসাস্বাদনকৰ্ত্তা ও রসনীয়, ঘ্রাণকর্ত্তা ও ঘ্ৰেয়, স্পর্শকৰ্ত্তা ও স্পর্শনীয়, দ্রষ্টা ও দর্শনীয়, শ্রোতা ও শ্রবণীয়; জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এবং সগুণ ও নির্গুণ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকেন। সেই শাশ্বত অব্যয় পুরুষ হইতেই মহত্তত্ত্ব সমুদ্ভূত হইয়াছে। ব্রাহ্মণগণ তাঁহাকেই অনিরুদ্ধ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। তিনি সমুদয় বৈদিক কার্য্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। লোকে তাঁহারই প্রীতিসাধনার্থ কাম্যকর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে। জিতেন্দ্রিয় মহর্ষিগণ তাঁহাকেই যজ্ঞভাগ প্রদান করেন। আমি সেই নারায়ণ হইতে উৎপন্ন হইয়া তোমাকে উৎপাদন করিয়াছি এবং তোমা হইতে সমুদয় স্থাবরজঙ্গমাত্মক প্রাণী ও সরহস্য বেদের সৃষ্টি হইয়াছে। সেই ভগবান্ নারায়ণ পরমাত্মা, জীবাত্মা, বুদ্ধি ও মন এই চারিপ্রকারে বিভক্ত হইয়া দেহমধ্যে ক্রীড়া করেন। জীবাত্মা আত্মজ্ঞানপ্রভাবে প্রতিবোধিত হইতে পারিলেই পরমাত্মায় লীন হইয়া থাকেন। হে পুত্র! সাঙ্খ্যজ্ঞান ও যোগশাস্ত্রে যেরূপ পরমতত্ত্ব বর্ণিত আছে, এই আমি তোমার নিকট তাহা সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম।”