৩৫০. বেদব্যাসের পূর্ব্বজন্ম

৩৫০তম অধ্যায়

বেদব্যাসের পূর্ব্বজন্ম

জনমেজয় কহিলেন, ভগবন্! সাঙ্খ্যযোগ, পঞ্চরাত্র ও আরণ্যকবেদ এই তিন জ্ঞানশাস্ত্ৰসমুদয় লোকে প্রচারিত হইয়াছে; কিন্তু ঐ সমুদয় কি একধৰ্ম্ম প্রতিপাদন করিতেছে, না পৃথক পৃথক ধর্ম্ম প্রতিপাদন করিতেছে, তাহা আমি পরিজ্ঞাত হইতে পারি নাই; অতএব আপনি উহা যথাবিধি কীৰ্ত্তন করুন।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! সত্যবতী দ্বীপমধ্যে মহর্ষি পরাশরের সহযোগে যে পুত্র লাভ করিয়াছিলেন, আমি সেই ভগবান্ বেদব্যাসকে নমস্কার করি। পণ্ডিতেরা তাহাকে নারায়ণাংশসম্ভূত বিভূতিযুক্ত [অণিমাদি ঐশ্বর্য্যযুক্ত], বেদনিধি [সমগ্র বেদের আধার], দ্বৈপায়ন বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। সত্যযুগে ভগবান্ নারায়ণ হইতে সেই মহাত্মার জন্ম হয়।

জনমেজয় কহিলেন, ভগবন্! পূর্ব্বে আপনি বশিষ্ঠের পুত্র শক্তি, শক্তির পুত্র পরাশর ও পরাশরের পুত্র বেদব্যাস বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। এক্ষণে আবার বেদব্যাসকে ভগবান্ নারায়ণের পুত্র বলিয়া নির্দ্দেশ করিতেছেন; অতএব কিরূপে নারায়ণ হইতে ব্যাসের জন্ম হইয়াছিল, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! পূৰ্ব্বে আমার গুরু ধৰ্ম্মপরায়ণ মহাত্মা বেদব্যাস বেদার্থ অন্বেষণের নিমিত্ত হিমালয়ের একদেশে অবস্থান করিয়াছিলেন। ঐ সময় সুমন্তু, জৈমিনি, পৈল, শুকদেব ও আমি আমরা এই পাঁচজনই তাঁহার শিষ্য ছিলাম। তিনি এই মহাভারতগ্রন্থ প্রস্তুত করিয়া নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইলে, আমরা তাঁহার বিস্তর শুশ্রূষা করিয়াছিলাম। তিনি আমাদিগের সহিত মিলিত হইয়া বেদ ও ভারতার্থপাঠে প্রবৃত্ত হওয়াতে ভূতগণ পরিবেষ্টিত ভূতপতির ন্যায় তাঁহার অপূৰ্ব্ব শোভা হইয়াছিল।

একদিন আমরা অবসরক্রমে গুরু বেদব্যাসকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ভগবন্! আপনি আমাদিগের নিকট সমুদয় বেদ, ভারতার্থ এবং নারায়ণ হইতে আপনার জন্মের বিষয় কীৰ্ত্তন করুন।” তখন তত্ত্ববিদগণের অগ্রগণ্য ভগবান্ বেদব্যাস প্রথমে আমাদিগের নিকট বেদার্থ ও ভারতার্থ সমুদয় কীৰ্ত্তন করিয়া কহিলেন, “হে শিষ্যগণ! আমি সত্যযুগে ভগবান্ নারায়ণ হইতে যেরূপে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলাম, তপোবলে তাহা আমার বিদিত আছে। এক্ষণে আমি তোমাদের নিকট উহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বে সৰ্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা শুভাশুভবিবর্জ্জিত ভগবান্ নারায়ণের নাভি হইতে সপ্তমবার জন্মপরিগ্রহ করিলে, তিনি তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বৎস! তুমি আমার নাভি হইতে সমুদ্ভূত হইয়াছ, এক্ষণে স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় প্রাণীর সৃষ্টি কর।’ ”

তখন ভগবান্ কমলযোনি দেবদেব নারায়ণের এই বাক্যশ্রবণে নিতান্ত চিন্তাকুল হইয়া তাঁহাকে প্রণামপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! আমি নিতান্ত জ্ঞানবিহীন হইয়া রহিয়াছি; সুতরাং প্রজাগণের সৃষ্টি করিতে আমার ক্ষমতা নাই; অতএব আপনি উহার উপায়বিধান করুন।” ভগবান্ ব্ৰহ্ম ইহা কহিলে নারায়ণ তৎক্ষণাৎ অন্তর্হিত হইয়া বুদ্ধিকে চিন্তা করিবামাত্র তিনি তাঁহার সম্মুখে সমুপস্থিত হইলেন। তখন দেবদেব নারায়ণ স্বয়ং তাঁহাকে যোগৈশ্বর্য্য প্রদান করিয়া কহিলেন, “বৎসে! তুমি প্রজাগণের সৃষ্টিসাধনার্থ ব্রহ্মার শরীরে প্রবেশ কর।” মহাত্মা নারায়ণ এইরূপ অনুজ্ঞা করিলে বুদ্ধি অবিলম্বে ব্রহ্মার অন্তরে প্রবিষ্ট হইলেন। তখন নারায়ণ ব্রহ্মাকে বুদ্ধিসমন্বিত দেখিয়া পুনরায় কহিলেন, “বৎস! এক্ষণে তোমার জ্ঞানলাভ হইয়াছে; অতএব সমুদয় স্থাবরজঙ্গমাত্মক প্রাণীর সৃষ্টিবিধান কর।” নারায়ণ এই কথা কহিলে, সৰ্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা “ভগবানের আজ্ঞা শিরোধার্য্য করিলাম” বলিয়া তাঁহার বাক্য অঙ্গীকার করিলেন। তখন ভগবান নারায়ণ অবিলম্বে তথা হইতে অন্তর্হিত হইয়া স্বীয় প্রকৃতি প্রাপ্ত হইলেন।

কিয়ৎকাল পরে ভগবান্ নারায়ণের মনে এই উদয় হইল যে, লোকপিতামহ ব্রহ্মা সমুদয় লোকের সৃষ্টি করিয়াছেন। এক্ষণে এই বসুমতী দৈত্য, দানব, গন্ধৰ্ব্ব ও রাক্ষসগণে পরিপূর্ণ হইয়া একান্ত ভারাক্রান্ত হইয়াছেন। অতঃপর দৈত্য, দানব ও রাক্ষসগণ তপোবলে বরলাভপূৰ্ব্বক অপরিমিতবলশালী ও একান্ত দর্পিত হইয়া দেবতা ও ঋষিগণের প্রতি নিতান্ত অত্যাচার করিবে; অতএব বিবিধ মূৰ্ত্তি ধারণপূৰ্ব্বক অবনীমণ্ডলে অবতীর্ণ হইয়া যথাক্রমে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনদ্বারা পৃথিবীর ভারাবতরণ [ভার অপসারণ] করা আমার অবশ্য কর্ত্তব্য। আমি নাগমূৰ্ত্তি ধারণপূর্ব্বক রসাতলে অবস্থান করিয়া এই পৃথিবীকে ধারণ করিতেছি বলিয়া ইনি এই বিশ্বসংসার ধারণ করিতেছেন; অতএব অবনীতলে অবতীর্ণ হইয়া ইহার পরিত্রাণ করা আমার কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম। অতঃপর আমাকে বরাহ, নৃসিংহ, বামন ও মনুষ্য প্রভৃতি বিবিধ মূর্ত্তি ধারণ করিয়া দুর্ব্বিনীত দেবারিগণকে বিনাশ করিতে হইবে।

এইরূপ চিন্তা করিয়া ভগবান্ নারায়ণ “ভো” এই শব্দ উচ্চারণ করিলে, ঐ শব্দ হইতে অপান্তরতমানামে এক মহর্ষি সমুদ্ভূত হইলেন। তিনি ত্রিকালজ্ঞ, সত্যবাদী ও অধ্যবসায়শীল। অপান্তরতমা সমুদ্ভূত হইবামাত্র আদিদেব নারায়ণ তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ভদ্র! তোমাকে বেদবিভাগ করিতে হইবে।” নারায়ণ এইরূপ আজ্ঞা করিলে মহর্ষি অপান্তরতমা তাঁহার আজ্ঞা শিরোধার্য্য করিয়া বেদ বিভাগ করিলেন। তখন ভগবান্ নারায়ণ তাঁহার বেদবিভাগকার্য্য, তপস্যা, নিয়ম ও সংযমদ্বারা সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, “তুমি প্রতি মন্বন্তরে এইরূপ জন্মলাভ করিয়া বেদবিভাগাদি কাৰ্য্যানুষ্ঠান করিবে। কেহই তোমাকে অতিক্রম করিতে পারিবে না। কলিযুগ সমুপস্থিত হইলে, ভরতবংশে কৌরবনামে বিখ্যাত মহাত্মা নরপতিগণ তোমা হইতে সম্ভূত হইবে। তুমি তাহাদের সমীপে সমুপস্থিত না থাকাতে তাহারা পরস্পর ঘোরতর বিবাদ উপস্থিত করিয়া শমনসদনে গমন করিবে। ঐ যুগে তুমি কৃষ্ণবর্ণ, বিবিধ ধৰ্ম্মের প্রবর্ত্তক, জ্ঞানোপদেষ্টা ও তপস্বী হইয়া বেদবিভাগ করিবে; কিন্তু স্বয়ং কখনই বিষয়ানুরাগ হইতে মুক্ত হইতে পারিবে না। ভগবান্ ভূতভাবনের প্রসাদে তোমার যে পুত্র জন্মিবে, সে-ই বিষয়ানুরাগপরিশূন্য হইবে।

“ব্রাহ্মণগণ যে বশিষ্ঠদেবকে ব্রহ্মার মানসপুত্র ও তপোধনাগ্রগণ্য বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন, যাঁহার তেজঃপ্রভায় সূর্য্যপ্রভা তিরস্কৃত হইয়াছে, সেই মহর্ষি বশিষ্ঠদেবের বংশে মহাপ্রভাবসম্পন্ন পরাশরনামে মহর্ষি জন্মপরিগ্রহ করিবেন। তিনি বেদের আকর ও মহাতপস্বী হইবেন। তুমি তাঁহার ঔরসে অবিবাহিতা সত্যবতীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিবে। ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান কিছুই তোমার অবিদিত থাকিবে না এবং কিছুতেই তোমার সন্দেহ উপস্থিত হইবে না। তুমি তপোবলে অনায়াসে অতীত যুগসমুদয় অবগত হইতে পারিবে এবং ঐ কলিযুগ অবধি চিরকাল জীবিত থাকিয়া অসংখ্য যুগ অতিক্রান্ত হইতে দেখিবে। ঐ কলিযুগে আমি চক্ৰধারণপূব্র্বক তোমার নয়নগোচর হইব। তোমার যশঃসৌরভে জগৎ পরিপূর্ণ হইবে। যে মন্বন্তরে সূর্য্যপুত্র শনৈশ্চর সাবৰ্ণি মনুনামে বিখ্যাত হইবেন, সেই মন্বন্তরে তুমি মম্বাদিগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত হইবে। ত্রিলোকমধ্যে যেসকল পদার্থ বিদ্যমান রহিয়াছে, সে সমুদয়ই আমা হইতে সম্ভূত। যে যেরূপে কামনা করে, আমি অনায়াসেই তাহার সে অভিলাষ পরিপূর্ণ করিয়া থাকি।” ভগবান্ নারায়ণ অপান্তরতমাকে এই কথা কহিয়া তাঁহার আজ্ঞাপ্রতিপালনে আদেশ করিলেন।

নারায়ণের উপাসনায় সাঙ্খাদি শাস্ত্ৰসিদ্ধান্ত

হে শিষ্যগণ! স্বায়ম্ভূব মন্বন্তরে এইরূপে নারায়ণের প্রভাবে উদ্ভূত হইয়া আমি অপান্তরতমানামে বিখ্যাত হইয়াছিলাম। এক্ষণে বৈবস্বত মন্বন্তরে বশিষ্ঠবংশে পুনরায় জন্মগ্রহণ করিয়াছি। আমি উৎকৃষ্ট সমাধিবলে পূৰ্ব্বে ঘোরতর তপশ্চরণ করিয়াছিলাম। এই আমি তোমাদের জিজ্ঞাসানুসারে আমার পূর্ব্বজন্ম ও পরে আমার যাহা যাহা হইবে তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করিলাম।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এই আমি তোমার নিকট আমাদিগের উপাধ্যায় মহর্ষি বেদব্যাসের জন্মবৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিলাম। অতঃপর আর যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে, তাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর।

সাঙ্খ্যযোগ, পঞ্চরাত্র, বেদ ও পাশুপত প্রভৃতি নানাবিধ শাস্ত্র বিদ্যমান রহিয়াছে। তন্মধ্যে মহর্ষি কপিল সারে সাঙ্খ্যের, পুরাতনপুরুষ ব্রহ্মা যোগের, অপান্তরতমা বেদের, ব্রহ্মার পুত্র ভগবান্ মহাদেব পাশুপত ধৰ্ম্মের এবং ভগবান নারায়ণ স্বয়ং সমুদয় পঞ্চরাত্র শাস্ত্রের প্রণেতা। সাঙ্খ্যযোগাদিসমুদয়শাস্ত্রই একমাত্র নারায়ণকে, উপাস্য বলিয়া প্রতিপন্ন করিতেছে। অজ্ঞানান্ধ ব্যক্তিরা কখনই তাঁহাকে পরমাত্মস্বরূপ বলিয়া অবগত হইতে পারে না। শাস্ত্ৰকৰ্ত্তা মনীষিগণ ঐ নারায়ণকে অদ্বিতীয় পুরুষ পরমাত্মা বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। যাঁহারা বেদ ও অনুমানাদি-দ্বারা সন্দেহশূন্য হইয়াছেন, নারায়ণ সৰ্ব্বদা তাঁহাদের অন্তরে প্রকাশিত থাকেন। আর যাঁহারা কুতর্কনিবন্ধন সন্দিহান হয়, তাহারা কখন তাঁহার সন্দর্শনলাভে সমর্থ হয় না। পঞ্চরাত্ৰশাস্ত্রজ্ঞ একান্ত অনুরক্ত মহাত্মারা চরমে অনায়াসে নারায়ণে লীন হইয়া থাকেন! মহারাজ! মহর্ষিগণ সাস্থ্য, যোগ ও বেদ প্রভৃতি সমুদয় শাস্ত্রে এই জগৎ নারায়ণময় বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। ত্রিলোকমধ্যে যেসকল শুভাশুভ কার্য্য সংঘটিত হয়, সেসমুদয়ই নারায়ণ হইতেই সমুৎপন্ন বলিয়া অবগত হওয়া উচিত।