৩৪৩. অগ্নি ব্রাহ্মণের তুল্যরূপতা—ব্রাহ্মণমাহাত্ম্য

৩৪৩তম অধ্যায়

অগ্নি ব্রাহ্মণের তুল্যরূপতা—ব্রাহ্মণমাহাত্ম্য

বৈশম্পায়ন বলিলেন, অর্জ্জুন কৃষ্ণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! অগ্নি ও চন্দ্র এক যোনি হইতে কিরূপে উৎপন্ন হইলেন? আমার এই বিষয়ে অতিশয় সংশয় উপস্থিত হইয়াছে; তুমি উহা নিরাকৃত কর।”

কৃষ্ণ কহিলেন, “ধনঞ্জয়! আমি এই স্থলে আমারই প্রভাবসম্ভূত একটি পূর্ব্ববৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিতেছি, অনন্যমনে শ্রবণ কর। দেবমানের সহস্ৰযুগ অতিক্রান্ত হইলে স্থাবরজঙ্গাত্মক সমস্ত ভূতের একবার মহাপ্রলয় হইয়া থাকে। তৎকালে জ্যোতিঃ, বায়ু, ও পৃথিবী কিছুই থাকে না। সমুদয় প্রদেশই গাঢ়তর অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন হয়। তৎকালে কি দিবস, কি রাত্রি, কি কার্য্য, কি কারণ, কি স্থূল, কি সূক্ষ্ম কিছুই নিরীক্ষিত হয় না; কেবল ব্রহ্মস্বরূপ জলরাশি চতুর্দ্দিকে ব্যাপ্ত হইয়া থাকে। এইরূপ অবস্থায় অজর, অমর, ইন্দ্রিয়শূন্য, ইন্দ্রিয়াতীত, অযোনিসম্ভূত, সত্যস্বরূপ, অহিংসক, চিন্তামণিস্বরূপ, প্রবৃত্তিবিশেষপ্রবর্ত্তক, সৰ্ব্বব্যাপী, সর্ব্বস্রষ্টা, ঐশ্বর্য্যাদি গুণের একমাত্র আশ্রয়, প্রকৃতি হইতে অবিনাশী নারায়ণ প্রাদুর্ভূত হয়েন। এই হলে শ্রুতিমূলক একটি দৃষ্টান্ত কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। মহাপ্রলয়কালে কি দিবস, কি রজনী, কি ভুল, কি সূক্ষ্ম কিছুই ছিল না, কেবল বিশ্বব্যাপী প্রকৃতিই বিরাজিত ছিলেন, তিনিই বিশ্বরূপ নারায়ণের রজনীস্বরূপ।

“অনন্তর সেই প্রকৃতিসম্ভূত হরি হইতে ব্রহ্মার উৎপত্তি হইল। ব্রহ্মা প্রজা সৃষ্টি করিবার অভিলাষ করিয়া লোচনযুগল হইতে অগ্নি ও চন্দ্রের সৃষ্টি করিলেন। পরে ক্রমে ক্রমে সমস্ত প্রজা সৃষ্ট হইলে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় প্রভৃতি বর্ণবিভাগ কল্পিত হইল। চন্দ্র ব্রাহ্মণ এবং অগ্নি ক্ষত্রিয়স্বরূপ হইলেন। ক্ষত্রিয় হইতে ব্রাহ্মণ যে গুণবিষয়ে প্রধান হইলেন, ইহা সৰ্ব্বলোকপ্রত্যক্ষ। ব্রাহ্মণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ প্রাণী কেহই নহে। ব্রাহ্মণের মুখে হোম করিলেই প্রদীপ্ত হুতাশনে আহুতি প্রদান করা হয়। এই নিমিত্তই ব্রাহ্মণের প্রাধান্য সংস্থাপিত হইয়াছে। ব্রাহ্মণ ভূতসমুদয় সৃষ্টি করিয়া লোক প্রতিপালন করিতেছেন। যে অগ্নিকে যজ্ঞের মন্ত্র হোতা, কৰ্ত্তা এবং দেবতামনুষ্যাদি সমুদয় লোকের হিতসাধক বলিয়া বেদমন্ত্র ও শ্রুতিতে নির্দ্দেশ করিয়াছে, সেই অগ্নি ব্রাহ্মণ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকেন। যেমন মন্ত্র ব্যতিরেকে আহুতি প্রদত্ত ও পুরুষ ব্যতিরেকে তপ অনুষ্ঠিত হয় না, সেইরূপ অগ্নি ব্যতিরেকে বেদ, দেবতা, মনুষ্য ও ঋষিগণের পূজা হয় না; এই নিমিত্তই অগ্নি হোতা বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছেন।

“মনুষ্যগণমধ্যে ব্রাহ্মণেরই হোতৃকার্য্যে অধিকার আছে; ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের তদ্বিষয়ে কিছুমাত্র অধিকার নাই। এই নিমিত্তই ব্রাহ্মণেরা অগ্নিস্বরূপ। যজ্ঞসমুদয় দেবগণের তৃপ্তি সাধন করে। দেবতারা যজ্ঞে পরিতৃপ্ত হইয়া পৃথিবী প্রতিপালন করিয়া থাকেন। কিন্তু যজ্ঞানুষ্ঠান না করিয়া ব্রাহ্মণমুখে আহুতি প্রদান করিলেই পৃথিবী রক্ষিত হইতে পারে। যিনি ব্রাহ্মণমুখে আহুতি প্রদান না করেন, তাহার প্রদীপ্ত হুতাশনে হোম করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। ব্রাহ্মণগণ এই নিমিত্তই অগ্নি বলিয়া অভিহিত হয়েন। বিদ্বানেরা অগ্নির আরাধনা করিয়া থাকেন; বিষ্ণুরূপী অগ্নি সমস্ত প্রাণীতে প্রবিষ্ট হইয়া সকলকে জীবিত রাখিয়াছেন। এই স্থলে সনৎকুমার যেরূপ আত্মমত ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন, শ্রবণ কর।

“সকলের আদিভূত ভগবান্ ব্রহ্মা সর্ব্বাগ্রে সকল লোকের সৃষ্টি করেন; কিন্তু ঐ সমুদয় লোকমধ্যে ব্রাহ্মণেরাই বেদপাঠপূৰ্ব্বক স্বর্গে গমন করিয়াছিলেন। শৈক্য [শিকে—গোপেরা শিকায় পাত্র ঝুলাইয়া দধি-দুগ্ধাদি বহন করে] যেমন গব্যাদি ধারণ করে, সেইরূপ ব্রাহ্মণগণের বাক্য, কৰ্ম্ম, শ্রদ্ধা ও তপস্যা ভূলোক ও দ্যুলোক ধারণ করিতেছে। সত্য অপেক্ষা ধৰ্ম্ম, মাতার তুল্য গুরু এবং ব্রাহ্মণের তুল্য উৎকৃষ্ট জীব আর কেহই নাই। যে প্রদেশে ব্রাহ্মণেরা বৃত্তিবিহীন হইয়া অবস্থান করেন, তথায় বৃষ প্রভৃতি বাহন-সমুদয় কাহাকেও বহন করে না, যন্ত্র-সমুদয় সম্যক পরিচালিত হয় না এবং তথাকার লোকসমুদয় উৎসন্ন ও দস্যুবৃত্তিসম্পন্ন হইয়া থাকে। বেদ, পুরাণ ও ইতিহাসে কীর্ত্তিত আছে যে, সৰ্ব্বকৰ্ত্তা লোকের হিতকারী বরদ ব্রাহ্মণেরা নারায়ণের বাক্যসংযমকালে মুখ হইতে প্রাদুর্ভূত হইয়াছেন। ব্রাহ্মণ হইতে অন্যান্য বর্ণসমুদয় উৎপন্ন হইয়াছে। ব্রাহ্মণই দেবাসুরগণের সৃষ্টিকর্ত্তা। আমি ব্রহ্মস্বরূপ হইয়া ঐ ব্রাহ্মণগণকে উৎপাদন করিয়াছি এবং আমিই দেবাসুর ও মহর্ষিগণের প্রতি নিগ্রহপ্রদর্শন করি।

“ব্রাহ্মণের প্রভাব অতি আশ্চর্য্য। দেখ, দেবরাজ ইন্দ্র অহল্যার সতীত্বভ্রংশ করিয়াছিলেন বলিয়া গৌতমের শাপে তাঁহার মুখমণ্ডল হরিদ্বর্ণ শ্মশ্রুজালে সমাকীর্ণ এবং মহর্ষি কৌশিকের অভিশাপে তাঁহার মুষ্ক [অণ্ডকোষ] নিপতিত ও পরিশেষে মেষবৃষণদ্বারা তাঁহার বৃষণ নির্ম্মিত হয়। শর্য্যাতিরাজার যজ্ঞে মহর্ষি চ্যবন অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে যজ্ঞভাগ-প্রদানে কৃতসঙ্কল্প হইলে, ইন্দ্র তাঁহার প্রতি বজ্রনিক্ষেপে সমুদ্যত হইয়া তাঁহার শাপপ্রভাবে স্তম্ভিতবাহু হইয়াছিলেন।

“প্রজাপতি দক্ষবিনাশনিবন্ধন ক্রোধাবিষ্ট হইয়া তপানুষ্ঠান।পূৰ্ব্বক রুদ্রের ললাটে একটি নেত্র উৎপাদন করিয়া দিয়াছেন। যখন রুদ্র ত্রিপুরাসুরকে বধ করিবার নিমিত্ত দীক্ষিত হয়েন, তৎকালে ভৃগুনন্দন আপনার মস্তক হইতে একটা জটা উৎপাটনপূর্ব্বক রুদ্রের প্রতি নিক্ষেপ করিলে উহা হইতে ভুজঙ্গ সমুদয় প্রাদুর্ভূত হয়। সেই সমস্ত ভুজঙ্গ রুদ্রকে বারংবার দংশন করাতেই রুদ্রের কণ্ঠ নীলবর্ণ হইয়া গিয়াছে। কেহ কেহ কহেন যে, পূর্ব্বে স্বায়ম্ভুব মন্বন্তরে নারায়ণ হস্তদ্বারা মহাদেবের কণ্ঠ গ্রহণ করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহার কণ্ঠদেশ নীলবর্ণ হইয়াছে।

“সুরগুরু বৃহস্পতি অমৃতোৎপাদনকালে পুরশ্চরণ করিবার নিমিত্ত যখন সলিলে আচমন করেন, তৎকালে সলিল অতিশয় কলুষিত ছিল। তদ্দর্শনে বৃহস্পতি একান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সমুদ্রকে এই বলিয়া অভিশাপ প্রদান করিলেন যে, আমি পুরশ্চরণ করিবার নিমিত্ত আচমন করিতেছিলাম, কিন্তু তুমি এক্ষণে স্বচ্ছ হইলে না; অতএব আজ অবধি মৎস্য কচ্ছপ ও মকর প্রভৃতি জলজন্তুসকল তোমাকে কলুষিত করিবে। সেই অবধি সমুদ্র বিবিধ জলজন্তুতে সমাকীর্ণ রহিয়াছে। পূৰ্ব্বে বিশ্বরূপনামে ত্বষ্টার পুত্র দেবগণের পুরোহিত হইয়াছিলেন। উঁহার অপর নাম ত্রিশিরাঃ। তিনি অসুরদিগের ভাগিনেয় হইয়াও তাহাদিগকে গোপনে এবং দেবতাদিগকে প্রকাশ্যভাবে যজ্ঞভাগ প্রদান করিতেন। অনন্তর একদা অসুরগণ হিরণ্যকশিপুকে সমভিব্যাহারে লইয়া বিশ্বরূপের মাতার নিকট গমন করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘ভগিনি! তোমার পুত্র ত্রিশিরাঃ বিশ্বরূপ দেবগণের পুরোহিত হইয়া তাহাদিগকে প্রকাশ্যভাবে এবং আমাদিগকে গোপনে যজ্ঞভাগ প্রদান করিয়াছেন। সেই কারণে ক্রমশঃ আমাদিগের বলক্ষয় এবং দেবগণের বলবৃদ্ধি হইতেছে। অতএব যাহাতে ত্রিশিরাঃ দেবপক্ষ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক আমাদিগকে পক্ষ অবলম্বন করেন, তুমি অচিরাৎ তাহার উপায় কর।

“তখন বিশ্বরূপের মাতা ভ্রাতৃগণের বাক্যশ্রবণে তাহাদের প্রতি সদয় হইয়া নন্দনবনস্থিত স্বীয় পুত্র বিশ্বরূপের নিকট গমনপূৰ্ব্বক তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বৎসে! তুমি কি নিমিত্ত শত্রুপক্ষের বলবর্দ্ধন ও মাতুলপক্ষ বিনাশ করিতে উদ্যত হইয়াছ? এরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করা তোমার কদাপি কৰ্ত্তব্য নহে।

“বিশ্বরূপের মাতা এই কথা কহিলে তিনি মাতৃবাক্য নিতান্ত অনুল্লঙ্ঘনীয় বিবেচনা করিয়া দেবপক্ষ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক দানবেন্দ্র হিরণ্যকশিপুর নিকটে সমুপস্থিত হইলেন। বিশ্বরূপ সমুপস্থিত হইবামাত্র হিরণ্যকশিপু ব্ৰহ্মপুত্র বশিষ্ঠদেবকে পরিত্যাগপূর্ব্বক তাঁহাকে হোতৃপদে নিযুক্ত করিলেন। তখন বশিষ্ঠদেব হিরণ্যকশিপুকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘দানবরাজ! যখন তুমি আমাকে পরিত্যাগ করিয়া অন্য ব্যক্তিকে হোতৃপদে প্রতিষ্ঠিত করিলে, তখন কখনই তোমার যজ্ঞ সমাপ্ত হইবে না এবং তুমি অপূৰ্ব্ব জন্তুর হস্তে বিনষ্ট হইবে।’ দানবরাজ হিরণ্যকশিপু সেই ব্রহ্মশাপনিবন্ধন অচিরাৎ নৃসিংহমূৰ্ত্তি নারায়ণের হস্তে বিনষ্ট হইল।

“হিরণ্যকশিপুর বিনাশের পর বিশ্বরূপ মাতুলকুলের বলবর্দ্ধনবাসনায় অতি কঠোর তপানুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। ইন্দ্র তাঁহার তপঃপ্রভাবদর্শনে শঙ্কিত হইয়া তপোভঙ্গের নিমিত্ত তাঁহার নিকট কতকগুলি রূপলাবণ্যসম্পন্ন অপ্সরা প্রেরণ করিলেন। অপ্সরাদিগের রূপদর্শনে বিশ্বরূপের মন নিতান্ত বিচলিত হওয়াতে তিনি তাহাদের প্রতি অনুরক্ত হইলেন। কিয়দ্দিন পরে অপ্সরারা বিশ্বরূপকে নিতান্ত আসক্ত বিবেচনা করিয়া কহিল, মহাত্ম! আমরা এক্ষণে স্বস্থানে প্রস্থান করি।’

“বিশ্বরূপ অপ্সরাগণের সেই অসুখকর বাক্যশ্রবণে কাতর হইয়া তাহাদিগকে কহিলেন, ‘তোমরা কোথায় যাইবে? এই স্থানেই আমার সহিত পরমসুখে অবস্থান কর।’ তখন অপ্সরাগণ তাঁহাকে কহিল, ‘মহর্ষে! আমরা দেবাঙ্গনা অপ্সরা। আমরা বরদাতা দেবরাজ ইন্দ্রকে ভজনা করিয়া থাকি।’ অপ্সরাগণ এই কথা কহিবামাত্র বিশ্বরূপ ক্রোধে অধীর হইয়া তাহাদিগকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘তোমরা অচিরাৎ স্ব স্ব ইচ্ছানুরূপ প্রদেশে গমন কর; আমি আজই ইন্দ্রাদি দেবগণকে বিনষ্ট করিব।’ মহাতেজাঃ ত্রিশিরাঃ এই বলিয়া একাগ্রচিত্তে মন্ত্রজপ করিতে আরম্ভ করিলেন। সেই মন্ত্রবলে তাঁহার তেজ নিতান্ত পরিবর্দ্ধিত হওয়াতে তিনি এক মুখদ্বারা ব্রাহ্মণগণকর্ত্তৃক যজ্ঞে আহুত সমুদয় সোমরস পান, এক মুখদ্বারা অন্নভোজন ও অপর মুখদ্বারা ইন্দ্রাদি দেবগণের তেজোহ্রাস করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন ইন্দ্রাদি দেবগণ সোমরসপানে বিশ্বরূপকে পুলকিতনেত্র ও একান্ত বিবর্দ্ধিত অবলোকন করিয়া ব্রহ্মার নিকট গমনপূৰ্ব্বক তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘পিতামহ! বিশ্বরূপ সমুদয় যজ্ঞের সোমরস পান করিতেছে। আমরা একেবারে যজ্ঞভাগলাভে বঞ্চিত হইয়াছি। এক্ষণে অসুরপক্ষ বর্দ্ধিত হইতেছে ও আমরা ক্রমশঃ হীনবীর্য্য হইতেছি; অতএব আপনি অচিরাৎ আমাদিগের মঙ্গল বিধান করুন।

“দেবগণ এই কথা কহিলে লোকপিতামহ ব্রহ্মা তাঁহাদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘দেবগণ! মহর্ষি দধীচি ঘোরতর তপানুষ্ঠান করিতেছেন। তোমরা তাঁহার নিকট গমন করিয়া তাঁহাকে কলেবর পরিত্যাগ করিতে অনুরোধ কর। তোমরা অনুরোধ করিলেই তিনি শরীর পরিত্যাগ করিবেন। তখন তোমরা তাঁহার অস্থি গ্রহণপূৰ্ব্বক তদ্দারা বজ্ৰ নির্ম্মাণ করিবে। সেই বজ্ৰদ্বারা ত্রিশিরার প্রাণবিয়োগ হইবে।’

“ভগবান্ কমলযোনি এইরূপ উপদেশ প্রদান করিলে ইন্দ্রাদি দেবগণ মহর্ষি দধীচির আশ্রমে গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে সম্বোধন। করিয়া কহিলেন, ‘ভগবন্! নির্ব্বিঘ্নে আপনার তপানুষ্ঠান হইতেছে ত’?’ তখন দধীচি তাঁহাদিগকে স্বাগত প্রশ্ন করিয়া কহিলেন, ‘সুরগণ! আমাকে তোমাদের কি কার্য্য সাধন করিতে হইবে, তাহা ব্যক্ত কর। তোমরা আমাকে যে কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে বলিবে, আমি নিশ্চয়ই তাহা সম্পাদন করিব।’ তখন দেবগণ তাহাকে কহিলেন, ‘ভগবন্! ত্রিলোকের হিতসাধনার্থ আপনাকে কলেবর পরিত্যাগ করিতে হইবে।’ দেবগণ এই কথা কহিলে মহাযোগী দধীচি কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া ‘তথাস্তু’ বলিয়া আত্মসমাধানপূর্ব্বক শরীর পরিত্যাগ করিলেন। দধীচি দেহত্যাগ করিলে ব্রহ্মা তাঁহার অস্থিদ্বারা বজ্ৰাস্ত্র নির্ম্মাণ করিলেন এবং বিষ্ণু সেই বজ্ৰমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। দেবরাজ ইন্দ্র ব্রহ্মাস্থিসম্ভূত দুর্ভেদ্য বজ্ৰাস্ত্র প্রহারে বিশ্বরূপের মস্তকচ্ছেদন করিলেন। বিশ্বরূপের মস্তক ছিন্ন হইবামাত্র তাহার শরীর হইতে বৃত্রাসুর সমুদ্ভূত হইল। সুররাজ তাহাকেও অচিরাৎ বজ্ৰদ্বারা বিনাশ করিলেন।

“এইরূপে দুইটি ব্রহ্মহত্যা সম্পাদিত হইলে দেবরাজ ইন্দ্র ভয়প্রযুক্ত দেবরাজ্য পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অণিমাদি ঐশ্বর্য্যপ্রভাবে সূক্ষ্মশরীর ধারণ করিয়া মানস সরোবরসভৃত নলিনীর মৃণালসূত্র [পদ্মের ডাঁটা হইতে নির্গত সূক্ষ্ম সূত্র] মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া রহিলেন। ত্রিলোকনাথ শচীপতি ব্রহ্মহত্যাভয়ে পলায়ন করিলে জগৎ ঈশ্বর [শাসক] শূন্য হইল; দেবতাদিগের মধ্যে রজ ও তমোগুণের আবির্ভাব হইয়া উঠিল; মহর্ষিদিগের মন্ত্রের প্রভাব রহিল না; চতুর্দ্দিকে রাক্ষসকুল বৃদ্ধমূল হইতে লাগিল; বেদ উৎসন্নপ্রায় হইল এবং ত্রিলোক বলবীর্য্যবিহীন ও সুজেয় হইয়া উঠিল।

“এইরূপে সমুদয় বিশৃঙ্খল হইলে মহর্ষি ও দেবগণ একত্র হইয়া আয়ুর পুত্র নহুষকে দেবরাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন। নহুষ স্বীয় ললাটস্থিত সৰ্ব্বভূততেজোহর, প্রজ্বলিত পঞ্চশত জ্যোতিঃপ্রভাবে অনায়াসে স্বর্গ প্রতিপালন করিতে লাগিলেন। তখন সমুদয় লোক প্রকৃতিস্থ হইয়া প্রীত হইল। কিয়দ্দিন পরে রাজর্ষি নহুষ মনে মনে চিন্তা করিলেন, “আমি শচী ব্যতীত ইন্দ্রোপভুক্ত সমুদয় দ্রব্য অধিকার করিয়াছি; অতএব এক্ষণে শচীকে অধিকার করিবার নিমিত্ত তাহার নিকট গমন করি। আয়ুঃপুত্র এই বিবেচনা করিয়া ইন্দ্রাণীর নিকট গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে কহিলেন, সুন্দরি! আমি ইন্দ্ৰত্বলাভ করিয়াছি, অতএব তুমি আমাকে ভজনা কর।

“ইন্দ্রাণী কহিলেন, ‘রাজর্ষে! তুমি স্বভাবতঃ ধাৰ্মিক, বিশেষতঃ চন্দ্রবংশে জন্মপরিগ্রহ করিয়াছ; অতএব পরস্ত্রী স্পর্শ করা তোমার কৰ্ত্তব্য কৰ্ম্ম নহে।’ নহুষ কহিলেন, ‘সুন্দরি! আমি ইন্দ্ৰত্বলাভ ও ইন্দ্রোপভুক্ত সমুদয় রত্নাদি অধিকার করিয়াছি; তুমি ইন্দ্রোপভুক্ত; অতএব তোমাকে অধিকার করাতে আমার কিছুমাত্র অধৰ্ম্ম হইবে না।’ তখন ইন্দ্রাণী নহুষের নির্দ্ধাতিশয়[অত্যন্ত আগ্রহ]দর্শনে নিতান্ত দুঃখিত হইয়া তাঁহাকে বলিলেন, ‘মহাত্মন্! আমি একটি ব্রত প্রতিপালন করিতেছি, অদ্যাপি তাহা শেষ হয় নাই। কয়েক দিন মধ্যে ঐ ব্রত সমাপ্ত হইলেই আমি তোমার নিকট গমন করিব।’ শচী এই কথা কহিলে নরপতি নহুষ তথা হইতে প্রস্থান করিলেন।

“তখন পতিপরায়ণা ইন্দ্রাণী নহুষভয়ে নিতান্ত কাতর হইয়া স্বামীর সহিত সাক্ষাৎ করিবার উপায় উদ্ভাবনার্থ বৃহস্পতির নিকট সমুপস্থিত হইলেন। সুরগুরু শচীকে উদ্বিগ্ন দর্শন করিয়া ধ্যানবলে তাঁহার অভিপ্রায় অবগত হইয়া কহিলেন, ‘মহাভাগে! তুমি নিয়ম অবলম্বনপূৰ্ব্বক দেবী উপশ্রুতিকে আহ্বান কর। তাঁহার প্রভাবেই তোমার ভর্ত্তৃসন্দর্শনলাভ হইবে।’ শচী তখন পতিব্রতানিয়ম অবলম্বনপূৰ্ব্বক মন্ত্রপাঠ করিয়া উপশ্রুতিকে আহ্বান করিলেন। ইন্দ্রাণী আহ্বান করিবামাত্র উপশ্রুতি তাঁহার নিকট সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, ‘ইন্দ্রাণি! এই আমি তোমার সমীপে উপস্থিত হইয়াছি, এক্ষণে তোমার কি প্রিয়কার্য্য সাধন করিতে হইবে, তাহা কীৰ্ত্তন কর।’

‘তখন শচী তাঁহাকে প্রণাম করিয়া কহিলেন, ‘হে সত্যময়ি! আমি যাহাতে ভর্ত্তৃদর্শন লাভ করিতে পারি, আপনি তাহার উপায়বিধান করুন। শচী এই কথা কহিলে দেবী উপশ্রুতি অচিরাৎ তাঁহাকে মানস-সরোবরে উপনীত করিয়া মৃণালগ্রন্থি প্রবিষ্ট ইন্দ্রকে প্রদর্শন করাইলেন। ঐ সময় দেবরাজ ইন্দ্র আপনার সহধর্ম্মিণী শচীকে একান্ত কৃশ দেখিয়া মনে মনে কহিতে লাগিলেন, “হায়! কি কষ্ট! ইতিপুর্ব্বে আমি সমুদয় লোকের অধিপতি ছিলাম; কিন্তু আজ আমি এই মৃণালতন্তুমধ্যে লুক্কায়িত রহিয়াছি। দেবী শচী আমার অনুসন্ধান করিয়া দুঃখিতমনে এই স্থানে উপস্থিত হইয়াছেন।’ শচীনাথ মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া, মৃণালসূত্র হইতে বহির্গত হইয়া শচীকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘দেবি! এক্ষণে কেমন আছ?’ শচী কহিলেন, ‘নাথ! রাজা নহুষ আমাকে পত্নীত্বে পরিগ্রহ করিবার অভিলাষ প্রকাশ করিয়াছে; আমিও তাহাকে কিছুদিন অপেক্ষা করিতে কহিয়াছি।’ দেবরাজ ইন্দ্র শচীর নিকট সেই অপ্রিয়কথা শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘প্রিয়ে! এক্ষণে তুমি রাজা নহুষের নিকট গমন করিয়া বল, মহারাজ! ইন্দ্রের মনঃপ্রীতিকর নানাপ্রকার আরোহণ বাহন আছে, আমি তাহাতে অনেকবার আরোহণ করিয়াছি। অতএব এক্ষণে তুমি অপূৰ্ব্ব ঋষিযুক্তযানে আরোহণ করিয়া আমাকে আমার আবাস হইতে আনয়ন কর।’ বাসব এই কথা কহিলে শচী পুলকিতমনে অবিলম্বে নহুষসন্নিধানে গমন করিলেন। দেবরাজ ইন্দ্রও মৃণালগ্রন্থি মধ্যে পুনৰ্ব্বার প্রবিষ্ট হইলেন।

“শচী নহুষসন্নিধানে সমুপস্থিত হইবামাত্র নহুষ তাঁহাকে দর্শন করিয়া কহিলেন, ‘সুরসুন্দরি! তুমি আমাকে কিছুদিন অপেক্ষা করিতে কহিয়াছিলে, এক্ষণে কি সেই সময় পূর্ণ হইয়াছে?’ শচী কহিলেন ‘মহারাজ! এক্ষণে আমি আপনাকে ভজনা করিব; কিন্তু আমার মনে একটি অভিলাষ আছে, আপনাকে তাহা পূর্ণ করিতে হইবে। আমি ইন্দ্রের সহিত নানা প্রকার যানে আরোহণ করিয়াছি, এক্ষণে আপনি ঋষিযুক্ত যানে আরোহণপূৰ্ব্বক আমাকে আমার আবাস হইতে আনয়ন করুন।’

‘শচী এই কথা কহিয়া প্রস্থান করিলে মহারাজ নহুষ ঋষিবাহ্য যানে আরোহণপূৰ্ব্বক শচীর নিকট গমন করিতে লাগিলেন। তিনি কিয়ৎক্ষণ পরে যানের গতি পরিবর্দ্ধিত করিবার নিমিত্ত বাহক মহর্ষিগণকে তিরস্কার করিয়া তাঁহাদের মধ্যে একজনের মস্তকে পদাঘাত করিলেন। ঐ মহর্ষির মস্তকে অগস্ত্যদেব বাস করিতেছিলেন। তিনি আপনার দেহে নহুষকে পদাঘাত করিতে দেখিয়া ক্রোধভরে তাঁহাকে কহিলেন, ‘রে পাপাত্মন্‌! তুই নিতান্ত অকার্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়াছিস্‌, অতএব এক্ষণে আমি তোকে অভিশাপ প্রদান করিতেছি, যে পর্য্যন্ত পৃথিবী থাকিবে, তদবধি তুই সর্প হইয়া তথায় অবস্থান কর।’ অগস্ত্যদেব এই কথা কহিবামাত্র নহুষ তৎক্ষণাৎ যান হইতে ভূতলে নিপতিত হইলেন।

“নহুষ নিপতিত হইলে ত্রিলোক পুনরায় ইন্দ্ৰশূন্য হইল। তখন দেবতা ও মহর্ষিগণ ইন্দ্রের নিমিত্ত ভগবান্ বিষ্ণুর শরণাপন্ন হইয়া কহিলেন, ‘ভগবন! বাসব ব্রহ্মহত্যাপাপে লিপ্ত হইয়াছেন। আপনি তাঁহাকে এই পাপ হইতে মুক্ত করুন।’ বরদাতা নারায়ণ দেবগণের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘সুরগণ! এক্ষণে দেবরাজ ইন্দ্র বিষ্ণুর উদ্দেশে অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করুন। তাহা হইলে তিনি। পুনরায় আপনার পদলাভে সমর্থ হইবেন।’

“নারায়ণ এই বাক্য কহিলে দেবতা ও মহর্ষিগণ ইন্দ্রের অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন, কিন্তু কুত্রাপি তাঁহার সন্দর্শন পাইলেন না। তখন তাঁহারা শচীকে কহিলেন, ‘সুভগে! তুমি অবিলম্বে দেবরাজকে আনয়ন কর।’ তখন দেবী শচী পুনরায় সেই মানসসরোবরে গমনপূৰ্ব্বক ইন্দ্রের নিকট সমূদয় বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিলেন। ইন্দ্রও শচীর বাক্য শ্রবণে অচিরাৎ সেই সরোবর হইতে উত্থিত হইয়া বৃহস্পতির নিকটে সমুপস্থিত হইলেন।

অনন্তর সুরগুরু বৃহস্পতি দেবরাজের নিমিত্ত এক অশ্বমেধযজ্ঞানুষ্ঠান করিলেন এবং ঐ যজ্ঞে কৃষ্ণবর্ণ অতিপবিত্র এক অশ্ব প্রেক্ষিত করিয়া সেই অশ্বেই ইন্দ্রকে আরোপণপূৰ্ব্বক স্বস্থানে উপনীত করিলেন। তখন দেবরাজ ব্রহ্মহত্যা হইতে বিমুক্ত এবং দেবতা ও মহর্ষিগণকর্ত্তৃক সংস্তুত হইয়া স্বচ্ছন্দে দেবলোকে বাস করিতে লাগিলেন। তাঁহার সেই ব্ৰহ্মহত্যাজনিত পাপ চারিভাগে বিভক্ত হইয়া বনিতা, অগ্নি, বৃক্ষ ও গোসমুদয়ে অবস্থান করিতে লাগিল। এইরূপে দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণের তেজঃপ্রভাবে শত্রুবধ করিয়া পুনরায় দেবরাজ্য অধিকার করিয়াছিলেন।

“পূৰ্ব্বে মহর্ষি ভরদ্বাজ আকাশগঙ্গা মন্দাকিনীতে অবতীর্ণ হইয়া আচমন করিতেছিলেন। এই অবসরে ভগবান বিষ্ণু ত্রিবিক্ৰমমূৰ্ত্তি ধারণপূৰ্ব্বক তথায় আগমন করিলেন। মহর্ষি তাঁহাকে দেখিবামাত্র আকাশগঙ্গার সলিলদ্বারা তাঁহার বক্ষঃস্থলে আঘাত করিলেন। বক্ষঃস্থলে আহত হইবামাত্র তাঁহাতে একটি চিহ্ন অঙ্কিত হইল। সেই অবধি বক্ষঃস্থল শ্রীবৎসচিহ্নে অঙ্কিত রহিয়াছে। মহর্ষি ভৃগুর অভিশাপে অগ্নি সৰ্ব্বভক্ষতা প্রাপ্ত হইয়াছেন।

“পূৰ্ব্বে দেবমাতা অদিতি দেবতারা ‘এই অন্নভোজন করিয়া অসুরগণকে বিনাশ করিবে’ মনে করিয়া তাঁহাদের নিমিত্ত অন্নপাক করিতেছিলেন। তাঁহার পাক সমাপ্ত হইলে বুধ ব্রতসমাপন করিয়া তাঁহার নিকট আগমনপূৰ্ব্বক ভিক্ষা প্রার্থনা করিলেন। অদিতি ‘দেবগণের ভোজন না হইলে অন্য ব্যক্তি অগ্রে এই অন্ন ভোজন করিতে পারিবে না এই বিবেচনা করিয়া তৎকালে বুধকে ভিক্ষা প্রদান করিলেন না। তখন বুধ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া অদিতিকে অভিশাপ প্রদানপূর্ব্বক কহিলেন, ‘তোমার উদরে একটি ব্যথা জন্মিবে।’

“প্রজাপতি দক্ষের যে ষষ্টিসংখ্যক দুহিতা ছিল, তিনি তন্মধ্যে কশ্যপকে ত্রয়োদশটি, ধৰ্ম্মকে দশটি, মনুকে দশটি এবং চন্দ্রকে সপ্তবিংশতিটি প্রদান করেন। চন্দ্রের পত্নীগণ সকলেই একরূপ রূপলাবণ্যময়ী ছিলেন; কিন্তু চন্দ্র একমাত্র রোহিণীর প্রতি নিতান্ত অনুরক্ত হওয়াতে তাঁহার অপর পত্নীগণ নিতান্ত ঈর্ষাপরবশ হইয়া পিতার নিকট গমনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘পিতঃ! আমরা সকলেই তুল্যরূপ রূপলাবণ্যসম্পন্ন; কিন্তু চন্দ্র একমাত্র রোহিণীর প্রতি সমধিক প্রীতি প্রকাশ করিতেছেন। কন্যাগণ এইরূপ দুঃখ প্রকাশ করিলে, প্রজাপতি দক্ষ নিতান্ত রোযাবিষ্ট হইয়া কহিলেন, ‘অদ্যাবধি চন্দ্র যক্ষ্মারোগে সমাক্রান্ত হইবে।

“অনন্তর চন্দ্র দক্ষের শাপপ্রভাবে যক্ষ্মারোগে সমাক্রান্ত হইয়া প্রজাপতি দক্ষের নিকট উপস্থিত হইবামাত্র তিনি কহিলেন, ‘বৎস! তুমি আমার কন্যাগণের প্রতি তুল্যরূপ প্রীতি প্রকাশ কর নাই বলিয়া আমি তোমাকে শাপ প্রদান করিয়াছি। ঐ সময় ঋষিগণ চন্দ্রকে ক্ষীণ হইতে দেখিয়া সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “নিশাপতে! তুমি যক্ষ্মারোগপ্রভাবে ক্রমশঃ ক্ষীণ হইতেছ; অতএব পশ্চিম সমুদ্রের সমীপে হিরণ্যসরোবরতীর্থে গমন করিয়া স্নান কর, তাহা হইলেই রোগ হইতে মুক্ত হইবে।’

“ঋষিগণ এই কথা কহিলে, চন্দ্র তাঁহাদের বাক্যানুসারে হিরণ্যসরোবরতীর্থে গমনপূৰ্ব্বক অবগাহন করিয়া পাপ হইতে মুক্ত হইলেন। ভগবান্ চন্দ্রমা ঐ তীর্থজলে অবগাহনপূর্ব্বক দীপ্তিশালী হইয়াছিলেন বলিয়া তদবধি ঐ তীর্থ প্রভাসনামে বিখ্যাত হইয়াছে। দক্ষের সেই শাপপ্রভাবে অদ্যাপি ভগবান্ চন্দ্রমা প্রতি পৌর্ণমাসীর পর দিন দিন এক এক কলা পরিহীন হইয়া অমাবস্যায় সম্পূর্ণরূপে অপ্রকাশিত হয়েন। ঐ শাপপ্রভাবে অদ্যাপি তাঁহার শরীরে মেঘলেখা[মেঘতুল্য কৃষ্ণাভ রেখা]সদৃশ শশলাঞ্ছন [শশকচিহ্ন] পরিস্ফুটরূপে লক্ষিত হইয়া থাকে।

“পূৰ্ব্বকালে একদা স্থূলশিরানামে এক মহর্ষি সুমেরুপৰ্ব্বতের উত্তর-পূৰ্ব্বদিকে ঘোরতর তপশ্চরণ করিতেছিলেন, এমন সময়ে পবিত্র বায়ু প্রবাহিত হইয়া তাঁহার শরীর স্পর্শ করিল। তিনি তপক্লেশে নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়াছিলেন, সুতরাং শীতল সমীর স্পর্শ হওয়াতে পরমপরিতুষ্ট হইলেন। ঐ সময় মহর্ষি বায়ুস্পর্শজনিত প্রীতি প্রকাশ করিলে, বনস্পতিগণ বায়ুর প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হইয়া মহর্ষিকে পুষ্পশোভা প্রদর্শন করিতে আরম্ভ করিল। মহর্ষি স্থূলশিরা তদ্দর্শনে তাহাদের দুরভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া এই শাপ প্রদান করিলেন যে, অদ্যাবধি আর তোমরা সকল সময়ে পুষ্পশোভা প্রদর্শন করিতে সমর্থ হইবে না।’

“পূৰ্ব্বে ভগবান্ নারায়ণ ত্রিলোকের হিতসাধনার্থ বড়বামুখনামে মহর্ষি হইয়া সুমেরুপৰ্ব্বতে তপশ্চরণ করিতে করিতে সমুদ্রকে আহ্বান করিয়াছিলেন; কিন্তু সমুদ্র তাঁহার সমীপে উপস্থিত হইল না। তখন তিনি নিতান্ত রোষাবিষ্ট হইয়া স্বীয় রোষজনিত গাত্রোত্তাপে সমুদ্রজল স্তিমিত [নিশ্চল] এবং স্বেদজল [ঘর্ম্ম] সদৃশ লবণাক্ত করিয়া, তাহাকে কহিলেন, “হে নদীনাথ! অদ্যাবধি তোমার জল অপেয় হইল। কেবল যখন বড়বামুখ অনল তোমার জল পান করিবে, সেই সময়ই তোমার জল সুমধুর হইবে।’ এই কারণবশতঃ অদ্যাপি কেবল বড়বামুখ অনলই সমুদ্রজল পান করিয়া থাকে।

“পূৰ্ব্বে ভগবান রুদ্রদেব হিমালয়ের নিকট তাঁহার কন্যা পার্ব্বতীর পাণিগ্রহণের অভিলাষ প্রকাশ করাতে হিমালয় তাঁহার প্রার্থনায় সম্মত হইয়াছিলেন। হিমালয় রুদ্রদেবকে কন্যাপ্রদান করিতে অঙ্গীকার করিবার পর মহর্ষি ভৃগু তাঁহার নিকট সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, ‘পৰ্ব্বতেশ্বর! তুমি আমাকে তোমার এই কন্যাটি সম্প্রদান কর।’ তখন হিমালয় কহিলেন, ‘মহর্ষে! আমি রুদ্রদেবকে সম্প্রদান করিব বলিয়া স্থির করিয়াছি।’ হিমাচল এই কথা কহিলে, মহর্ষি ভৃগু রোষাবিষ্টচিত্তে তাঁহাকে কহিলেন, যখন তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করিলে, তখন আমার শাপপ্রভাবে আজ অবধি আর তুমি রত্নভাজন [১] হইবে না।’ অদ্যাবধি সেই মহর্ষির বাক্যপ্রভাবে হিমাচল রত্নবিহীন হইয়া রহিয়াছেন। হে ধনঞ্জয়। ব্রাহ্মণের মাহাত্ম এইরূপ অত্যাশ্চর্য্য ও অনির্ব্বচনীয়। ক্ষত্রিয়গণ ব্রাহ্মণের প্রসাদবলেই এই সসাগরা ধরিত্রী উপভোগ করিতেছেন। এইরূপে ব্রহ্মস্বরূপ অগ্নি ও সোমত্ত্বক জগৎসংসার রক্ষিত হইতেছে।

ভগবানের হরি প্রভৃতি অন্যান্য নাম

“অগ্নিস্বরূপ সূর্য্য ও চন্দ্র নিরন্তর এই জগতের হর্ষবিধান করিতেছেন। তাঁহারা আমার চক্ষু এবং তাঁহাদের কিরণজাল আমার কেশস্বরূপ; এই নিমিত্ত আমি ‘হৃষীকেশ’ বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছি। আমি মন্ত্রকর্ত্তৃক আহূত হইয়া যজ্ঞভাগ হরণ করি এবং আমার বর্ণ হরিণ্মণির ন্যায়, এই নিমিত্ত লোকে আমাকে ‘হরি’ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকে।

“আমি সমুদয় লোকের ধামস্বরূপ এবং আমা হইতেই ঋত অর্থাৎ সত্যের বিচারনিষ্পত্তি হয়; এই নিমিত্ত ব্রাহ্মণগণ আমাকে ‘ঋতধামা’ বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন।

“পূর্ব্বে আমি রসাতলগত গোরূপধরা ধরিত্রীর উদ্ধার করিয়াছিলাম, এই নিমিত্ত দেবগণ ‘গোবিন্দ’ নাম উচ্চারণপূর্ব্বক আমার স্তব করিয়া থাকেন।

“আমি শিপি অর্থাৎ তেজঃপ্রকাশ করিয়া সমূদয় পদার্থে প্রবেশ করি; এই নিমিত্ত আমার নাম ‘শিপিবিষ্ট’ হইয়াছে।

“মহর্ষি জাস্ক সমুদয় যজ্ঞে আমাকে ‘গূঢ়’ নামে স্তব করিয়া আমার প্রসাদে পাতালগত নিরুক্ত শাস্ত্রের উদ্ধার করিয়াছেন।

“আমি নিরন্তর প্রাণীগণের দেহমধ্যে আত্মরূপে অবস্থান করি। কোনকালে জন্মগ্রহণ করি নাই, করিবও না; এই নিমিত্ত পণ্ডিতেরা আমাকে ‘অজ’ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন।

“আমি কখন ক্ষুদ্র, অশ্লীল অথবা মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করি নাই এবং সৎ অসৎ সমুদয় আমাতে বিনিবেশিত রহিয়াছে; এই নিমিত্ত ব্রহ্মলোকবাসী মহর্ষিগণ আমাকে ‘সত্য’ নামে কীৰ্ত্তন করেন।

“আমি কখন সত্ত্বগুণ হইতে চ্যুত হই নাই। আমা হইতে সত্ত্বগুণের সৃষ্টি হইয়াছে। আমি নিরন্তর নিষ্পাপ থাকিয়া সত্ত্বগুণসহকারে নিষ্কাম কৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করি এবং জ্ঞানবান ব্যক্তিরা সত্ত্বগুণময় জ্ঞানদ্বারাই আমাকে দর্শন করিয়া থাকেন। এই নিমিত্ত আমার ‘সাত্বত’ নাম বিখ্যাত হইয়াছে।

“আমি লাঙ্গলফলকরূপী হইয়া পৃথিবী কৰ্ষণ করি এবং আমার বর্ণও কৃষ্ণ এই নিমিত্ত আমি ‘কৃষ্ণ’ নাম ধারণ করিয়াছি।

“আমি কুণ্ঠিত না হইয়া সলিলের সহিত পৃথিবীকে, বায়ুর সহিত আকাশকে ও তেজের সহিত বায়ুকে মিলিত করিয়াছি; এই নিমিত্ত পণ্ডিতেরা আমাকে ‘বৈকুণ্ঠ’ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন।

“আমি কখনই নিৰ্ব্বাণস্বরূপ পরব্রহ্ম হইতে চ্যুত হই নাই; এই নিমিত্ত আমার নাম ‘অচ্যুত’।

“অধঃ শব্দে পৃথিবী, অক্ষ শব্দে আকাশ ও জল শব্দে ধারণকৰ্ত্তা। আমি তেজঃপ্রভাবে পৃথিবী ও আকাশকে ধারণ করিয়াছি বলিয়া আমার নাম ‘অরধোক্ষজ’ হইয়াছে। শব্দার্থচিন্তাপরায়ণ বেদবিদ্‌ পণ্ডিতেরা যজ্ঞশালায় উপবিষ্ট হইয়া অধোক্ষজ নামোচ্চারণপূৰ্ব্বক আমার স্তব করেন। পূৰ্ব্বে মহর্ষিগণ একাগ্রচিত্ত হইয়া কহিয়াছিলেন, ‘ভগবান্ নারায়ণ ভিন্ন আর কাহাকেও অধোক্ষজ বলিয়া সম্বোধন করা যায় না।’

“প্রাণীগণের প্রাণধারণের হেতুভূত ধৃত আমার তেজঃস্বরূপ, এই নিমিত্ত বেদজ্ঞ পণ্ডিতেরা আমাকে ‘ঘৃতাচ্চি’ বলিয়া থাকেন।

‘পিত্ত, শ্লেষ্ম ও বায়ু এই ত্রিবিধ কর্ম্মজ ধাতু প্রভাবেই প্রাণীগণের প্রাণরক্ষা হয়। ঐ ধাতুত্রয়ের ক্ষয় হইলেই প্রাণীগণ ক্ষীণ হইয়া যায়। আমি এই তিন ধাতুস্বরূপ হইয়া প্রাণীগণের দেহে অবস্থান করি; এই নিমিত্ত আয়ুর্ব্বেদবিদ্‌ পণ্ডিতেরা আমাকে ‘ত্রিধাতু’ বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন।

“ভগবান ধৰ্ম্ম জনসমাজে বৃষনামে বিখ্যাত আছেন। এই নিমিত্ত নৈর্ঘণ্টক নামক বৈদিক কোষ [অভিধান গ্রন্থ] আমাকে ‘বৃষ’ নামে নির্দ্দিষ্ট করিয়াছে।

“পণ্ডিতেরা কপি শব্দে বরাহশ্রেষ্ঠ ও বৃষ শব্দে ধৰ্ম্ম বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন; এই নিমিত্ত ভগবান্ কশ্যপ প্রজাপতি আমাকে ‘বৃষাকপি’ নাম প্রদান করিয়াছেন।

“কি দেবগণ, কি অসুরগণ, কেহই আমার আদি, মধ্য ও অন্ত পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ নহেন; এই নিমিত্ত পণ্ডিতেরা আমাকে ‘অনাদি’, ‘অমধ্য’ ও ‘অনন্ত’ বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন।

“আমি পাপস্পর্শ না করিয়া পবিত্র বাক্যসমুদয় শ্রবণ করি, এই নিমিত্ত আমার নাম ‘শুচিশ্রবা’ হইয়াছে।

“পূর্ব্বে আমি একশৃঙ্গ [একদন্ত] ও ত্রিককুদ্‌ [তিনটি ঝুঁটি] বরাহমূর্ত্তি ধারণ করিয়া পৃথিবী উদ্ধৃত করিয়াছিলাম; এই নিমিত্ত আমি ‘একসৃঙ্গ’ ও ‘ত্রিককুদ্‌’ নামে বিখ্যাত হইয়াছি।

“সাঙ্খ্যশাস্ত্রবিশারদ পণ্ডিতেরা যাহাকে বিরিঞ্চ বলিয়া নির্দ্দেশ করিতেছেন, তাঁহার সহিত আমার কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। ঐ পণ্ডিতেরা আমাকে বিদ্যাসহায়বান আদিত্যমণ্ডলস্থ ‘কপিল’ বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। যে মহাত্মা বেদমধ্যে সংস্তুত হইয়া থাকেন এবং যিনি ভক্তিযোগদ্বারা পূজিত হয়েন, আমিই সেই হিরণ্যগর্ভ। আমি একবিংশতি সহস্র শাখাসম্পন্ন ঋগ্বেদ, বেদবিৎ মহর্ষিগণ গীত আরণ্যক, বেদমধ্যে সহস্রশাখাযুক্ত সামবেদ, ষট্‌পঞ্চাশৎ অষ্ট ও সপ্তত্রিংশৎ শাখাযুক্ত যজুর্ব্বেদ এবং মারণোচ্চাটন প্রভৃতি আভিচারিক [পরানিষ্টকারক ধ্বংসাত্মক অনুষ্ঠানে পরিপূর্ণ] কার্য্যপরিপূর্ণ পঞ্চকল্পান্তক অথৰ্ব্ববেদস্বরূপ। বেদমধ্যে যে সমস্ত শাখাভেদ নির্দ্দিষ্ট আছে, ঐ সমস্ত শাখায় যে সমস্ত গীত নিবন্ধ রহিয়াছে এবং ঐ সমুদয় গীতের যে স্বর ও বর্ণোচ্চারণপ্রণালী বিহিত হইয়াছে, তৎসমুদয়ই মৎকৃত। আমি বরদাতা হয়গ্রীব; আমি বেদপাঠের পদবিভাগ ও অক্ষরবিভাগ সবিশেষ পরিজ্ঞাত আছি। মহাত্মা পাঞ্চাল আমারই অনুগ্রহে বামদেব হইতে বেদপাঠের পদবিভাগ শিক্ষা করিয়াছিলেন। বাভ্রব্যগোত্রসমুৎপন্ন মহর্ষি গালব আমারই পূৰ্ব্বমূৰ্ত্তি নারায়ণ হইতে বরলাভ ও অত্যুৎকৃষ্ট যোগলাভ করিয়া সর্ব্বাগ্রে বেদের পদবিভাগ ও শিক্ষাপ্রণালী সংস্থাপন করিয়াছিলেন। মহারাজ ব্রহ্মদত্ত ও তাঁহার মন্ত্রী মণ্ডরীক সাতজন্ম মৃত্যুজনিত দুঃখ অনুভব করিয়া পশ্চাৎ আমারই অনুগ্রহে যোগসিদ্ধি লাভ করেন।

“আমি কোন কারণবশতঃ ধৰ্ম্মের ঔরসে দুই মূৰ্ত্তিতে জন্মগ্রহণ করিয়া নর ও নারায়ণনামে প্রখ্যাত হইয়া গন্ধমাদনপৰ্ব্বতে ধৰ্ম্মাযানে আরোহণপূৰ্ব্বক তপস্যা করিয়াছিলাম। ঐ সময় প্রজাপতি দক্ষ এক যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া উহাতে রুদ্রের যজ্ঞভাগ কল্পনা করেন নাই। তদ্দর্শনে রুদ্রদেব নিতান্ত ক্রোধাবিষ্ট হইয়া দধীচির বাক্যানুসারে দক্ষের যজ্ঞ বিনষ্ট করিবার নিমিত্ত প্রজ্বলিত শূল নিক্ষেপ করেন। ঐ শূল দক্ষের যজ্ঞ ধ্বংস করিয়া বদরিকাশ্রমে নারায়ণের সন্নিধানে আগমনপূর্ব্বক মহাবেগে নারায়ণের বক্ষঃস্থলে নিপতিত হইয়াছিল। সেই রুদ্রনিক্ষিপ্ত শূলের প্রখর তেজঃপ্রভাবে নারায়ণের কেশ মুঞ্জ অর্থাৎ হরিদ্বর্ণ হইয়া গেল। এই নিমিত্ত আমার নাম ‘মুঞ্জকেশ’ হইয়াছে।

“অনন্তর সেই রুদ্রশূল মহাত্মা নারায়ণের হুঙ্কারদ্বারা প্রতিহত হইয়া পুনরায় শঙ্করের হস্তে গমন করিল। তখন রুদ্রদেব রোষপরবশ হইয়া নরনারায়ণের প্রতি ধাবমান হইলেন। বিশ্বাত্মা নারায়ণ রুদ্রকে মহাবেগে আগমন করিতে দেখিয়া হস্তদ্বারা তাঁহার কণ্ঠ গ্রহণ করিলেন। সেই অবধি রুদ্রের কণ্ঠদেশ নীলবর্ণ হইয়া রহিয়াছে।

“নারায়ণ রুদ্রের কণ্ঠগ্ৰহণ করিলে নর রুদ্রকে বিনাশ করিবার অভিলাষে এক ঈষিকা গ্রহণ করিয়া মন্ত্রপূত করিলেন। ঈষিকা মন্ত্রপূত হইবামাত্র পরশুর আকার ধারণ করিল। তখন নর সেই পরশু রুদ্রের প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। পরশু নিক্ষিপ্ত হইবামাত্র রুদ্র তদ্দণ্ডে উহা খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। এই কারণে আমার নাম ‘খণ্ডপরশু’ হইয়াছে।”

রুদ্র-রনরনারায়ণসমরে নরনারায়ণের জয়

অর্জ্জুন কহিলেন, “বাসুদেব! রুদ্র ও নরনারায়ণের সেই ত্রৈলোক্যবিনাশন যুদ্ধে কে জয়লাভ করিয়াছিলেন, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর।”

বাসুদেব কহিলেন, “হে ধনঞ্জয়! এইরূপে রুদ্র ও নরনারায়ণ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে, সমুদয় লোক অতিশয় ভীত হইল। ঐ সময় হুতাশন যজ্ঞীয় হবিঃ গ্ৰহণ করিলেন না; মহর্ষিগণের মুখে বেদ স্ফুরিত হইল না; রজ ও তমোগুণ দেবগণের অন্তঃকরণ আক্রমণ করিল; আকাশস্থ সমস্ত পদার্থ নিপতিত হইতে লাগিল; চন্দ্র, সূর্য্য প্রভৃতি জ্যোতিষ্কসমুদয় জ্যোতিহীন হইয়া গেল; প্রজাপতি ব্রহ্মা আসন হইতে পরিভ্রষ্ট হইলেন; সাগর শুষ্কপ্রায় ও হিমাচল বিদীর্ণ হইয়া গেল। এইরূপ দুর্নিমিত্তসমুদয় প্রাদুর্ভূত হইলে সৰ্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা দেবতা ও মহর্ষিগণসমভিব্যাহারে যুদ্ধস্থলে সমুপস্থিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে রুদ্রদেবকে কহিলেন, ‘হে বিশ্বনাথ! আপনি বিশ্বের হিতানুষ্ঠানার্থ অস্ত্রশস্ত্র পরিত্যাগ করুন। ত্রিলোকের মঙ্গল হউক। যিনি অক্ষর, অব্যক্ত, কূটস্থ, কৰ্ত্তা, অকৰ্ত্তা, নিদ্বন্দ্ব ও লোকস্রষ্টা, এই নর ও নারায়ণ তাঁহারই মূর্ত্তি। ইঁহারা এক্ষণে ধৰ্ম্মের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়া অতিকঠোর তপানুষ্ঠান করিতেছেন। আমি কোন কারণবশতঃ সেই ব্রহ্মের প্রসন্নতা হইতে উদ্ভূত হইয়াছি; আর আপনিও তাঁহারই ক্রোধ হইতে উৎপন্ন হইয়াছেন; অতএব এক্ষণে আপনি আমার এবং অন্যান্য দেবতা ও মহর্ষিগণের সহিত এই বরদাতা নারায়ণকে প্রসন্ন করুন। অচিরাৎ ত্রিলোকের শান্তিলাভ হউক।’

“প্ৰজাপতি ব্রহ্মা এইরূপ কহিলে, রুদ্রদেব ক্রোধ প্ৰতিসংহারপূর্ব্বক আদিদেব সর্ব্বশ্রেষ্ঠ নারায়ণকে প্রসন্ন করিয়া তাঁহার শরণাপন্ন হইলেন। ব্রহ্মাদি দেবতা ও মহর্ষিগণ তাঁহার পূজা করিতে লাগিলেন। তখন জিতক্রোধ জিতেন্দ্রিয় ভগবান নারায়ণ প্রসন্নতা লাভ করিয়া মহেশ্বরকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে রুদ্র! যে ব্যক্তি তোমাকে জানে, সে আমাকেও জ্ঞাত আছে; আর যে ব্যক্তি তোমার অনুগত, সে আমারও অনুগত। ফলতঃ আমাদিগের উভয়ের কোন বিষয়ে কিচ্ছুমাত্র প্রভেদ নাই। এ বিষয়ে যেন বিপরীত সংস্কার না জন্মে। আমার বক্ষঃস্থলে তোমার নিক্ষিপ্ত শূলের আঘাতে যে চিহ্ন হইয়াছে; অদ্যাবধি উহা ‘শ্রীবৎস’ নামে প্রথিত হইবে এবং আমি তোমার কণ্ঠগ্ৰহণ করাতে উহাতে, একটি করচিহ্ন অঙ্কিত হইয়াছে, তন্নিবন্ধন অদ্যাবধি তোমার নাম ‘শ্রীকণ্ঠ’ হইবে।

“রুদ্র ও নারায়ণ এইরূপে পরস্পর চিহ্ন উৎপাদন ও সখ্যভাব সংস্থাপন করিলে, দেবগণ প্রফুল্লচিত্তে নর ও নারায়ণের নিকট বিদায়গ্রহণপূৰ্ব্বক স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন। সুরগণ বিদায় হইলে তপোধনাগ্রগণ্য নারায়ণ পুনরায় স্থিরচিত্তে ঘোরতর তপানুষ্ঠান করিতে লাগিলেন।

“হে অর্জ্জুন! এই আমি তোমার নিকট রুদ্র-নারায়ণসংগ্রামে নারায়ণের বিজয়বৃত্তান্ত এবং মহর্ষিগণনির্দ্দিষ্ট আমার নামের প্রকৃত অর্থসমুদয় কীৰ্ত্তন করিলাম। আমি এইরূপ বহুবিধ রূপ। ধারণপূৰ্ব্বক পৃথিবী, ব্রহ্মলোক ও গোলোকে সঞ্চরণ করিয়া থাকি। তুমি আমারই বাহুবলে রক্ষিত হইয়া জয়লাভ করিয়াছ। তোমার সংগ্রামের সময় যিনি তোমার অগ্রে অগ্রে গমন করিতেন, তিনি দেবদেব রুদ্র। আমি তোমাকে পূর্ব্বেই কহিয়াছি, তিনি আমার ক্রোধ হইতে উৎপন্ন হইয়া কালরূপে প্রাদুর্ভূত হইয়াছেন। তুমি যেসমস্ত শত্ৰু সংহার করিয়াছ, তিনি অগ্রেই তাঁহাদিগকে বিনাশ করিয়াছেন; তুমি কেবল উপলক্ষ মাত্র। যিনি আমার ক্রোধ হইতে উৎপন্ন হইয়াছেন এবং যাঁহার প্রভাব তোমার অবিদিত নাই, এক্ষণে সেই দেবাদিদেব উমাপতিকে পূতমনে নমস্কার কর।”