৩৪২তম অধ্যায়
নারায়ণের বিভিন্ন নামোৎপত্তি বিবরণ
জনমেজয় কহিলেন, ব্রহ্ম! মহাত্মা ব্যাস শিষ্যগণের সহিত যেসমস্ত নামোচ্চারণপূৰ্ব্বক মহাত্মা মধুসূদনকে স্তব করিয়াছিলেন, সেই সকল নামের প্রকৃত অর্থ কি, আপনি তাহা কীৰ্ত্তন করুন। আমি উহা শ্রবণ করিয়া শরৎকালীন বিমল শশাঙ্ক [চন্দ্র] মণ্ডলের ন্যায় নিৰ্ম্মল হইব।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! ভগবান্ হরি অর্জ্জুনের নিকট আপনার গুণ ও কৰ্ম্মানুসারে নামসমুদয়ের যেরূপ অর্থ ব্যক্ত করিয়াছেন, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা মহাত্মা অর্জ্জুন বাসুদেবকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “হে কেশব! তুমি, সৰ্ব্বভূতের স্রষ্টা এবং ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান এই ত্রিকালের অধিপতি। তুমি সকলকে অভয় প্রদান করিয়া থাক। এক্ষণে মহর্ষিগণ বেদ ও পুরাণমধ্যে তোমার যেসমস্ত গুণকৰ্ম্মানুরূপ নাম কীৰ্ত্তন করিয়াছেন, তৎসমুদয়ের অর্থ জ্ঞাত হইতে আমার অভিলাষ হইতেছে; অতএব অনুগ্রহ করিয়া উহা ব্যক্ত কর। তোমা ব্যতিরেকে উহা কীৰ্ত্তন করা অন্যের সাধ্যায়ত্ত নহে।”
বাসুদেব কহিলেন, “হে অর্জ্জুন! মহর্ষিগণ বেদচতুষ্টয়, উপনিষৎ, পুরাণ, জ্যোতিষ, সাঙ্খ্য, যোগশাস্ত্র ও আয়ুৰ্ব্বেদে আমার প্রভূত নাম কীৰ্ত্তন করিয়া গিয়াছেন। ঐ সমস্ত নামের মধ্যে কতকগুলি গুণসম্ভূত ও কতকগুলি কর্ম্মসম্ভূত। তুমি আমার অর্ধাঙ্গস্বরূপ; অতএব এক্ষণে তুমি আমার কর্ম্মসম্ভূত নামসমুদয়ের অর্থ অবহিতচিত্তে শ্রবণ কর।
“সেই নির্গুণ গুণস্বরূপ পরমাত্মাকে নমস্কার। তাঁহার প্রসাদে ব্রহ্মা ও ক্রোধে রুদ্র উৎপন্ন হইয়াছেন; তিনি স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমস্ত বিশ্বের কারণ এবং অষ্টাদশগুণযুক্ত সত্ত্বস্বরূপ। তিনি আমার উৎপত্তিস্থান। তিনিই ভূলোক ও দ্যুলোকরূপ লোকসকলকে ধারণ করিয়া রহিয়াছেন। তিনি কৰ্ম্মফল ও চিন্মাত্রস্বরূপ; তিনিই সকল লোকের আত্মা ও আরাধ্য। তাহা হইতেই সৃষ্টিস্থিতি প্রলয় হইতেছে। তিনি তপ, যজ্ঞ, যাজ্ঞিক, চিরন্তন পুরুষ ও বিরাট। তিনি লোকের সৃষ্টিসংহারকর্ত্তা অনিরুদ্ধ। ব্রহ্মার রাত্রি অতীত হইলে তাঁহারই প্রসাদে ঐ পদ্মে ব্রহ্মা জন্মগ্রহণ করেন। অনন্তর ব্রহ্মার দিবস অতিবাহিত হইলে ঐ দেবদেব অনিরুদ্ধের ক্রোধ হইতে লোকসংহারক রুদ্র প্রাদুর্ভূত হয়েন। এইরূপে ব্রহ্মা ও রুদ্র অনিরুদ্ধের প্রসন্নতা ও ক্রোধ হইতে উৎপন্ন হইয়া তাঁহার আদেশানুসারে সৃষ্টি ও সংহার করিয়া থাকেন। ফলতঃ অনিরুদ্ধই সৃষ্টিসংহার কর্ত্তা; ব্রহ্মা ও মহেশ্বর কেবল তদ্বিষয়ে নিমিত্তমাত্র। জটাজুটসম্পন্ন শ্মশানালয়বাসী কঠোর ব্রতপরায়ণ পরমযোগী ভীমমূৰ্ত্তি দক্ষযজ্ঞবিনাশক সূর্য্যের নেত্রোৎটক রুদ্রদেব নারায়ণেরই অংশস্বরূপ। আমি সকলের আত্মা; রুদ্রদেব আবার আমার আত্মস্বরূপ; এই নিমিত্তই আমি তাঁহাকে অর্চ্চনা করিয়া থাকি। যদি আমি তাঁহার অর্চ্চনা না করি, তাহা হইলে কেহই আমার সৎকার করিবে না। আমি যে নিয়ম স্থাপন করিয়াছি, সকলে তাহারই অনুসরণ করিয়া থাকে। নিয়মসমুদয় সকলেরই আদরণীয় হয়; এই নিমিত্ত আমি সর্ব্বসাধারণকে আত্মার পূজায় নিরত থাকিবার অভিলাষে রুদ্রদেবের পূজার নিয়ম করিয়াছি। যিনি রুদ্রদেবকে জানেন, তিনি আমাকেও জ্ঞাত আছেন। যিনি তাঁহার অনুগত, তিনি আমার অনুগত। রুদ্র ও আমি আমরা উভয়েই একাত্মা। আমরা আত্মরূপে সমস্ত ব্যক্তিতে অবস্থানপূৰ্ব্বক উহাদিগকে কার্য্যসমুদয়ে প্রবর্ত্তিত করিয়া থাকি। রুদ্র ভিন্ন আর কেহই আমাকে বর প্রদান করিতে সমর্থ নহে, আমি এই বিবেচনা করিয়া পুত্রের নিমিত্ত রুদ্রদেবের আরাধনা করিয়াছিলাম। আত্মস্বরূপ রুদ্র ব্যতিরেকে আমি আর কোন দেবতাকেই প্রণাম করি না। ব্রহ্মা, রুদ্র ও ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতা ও মহর্ষিগণ সকলেই ত্রিকালজ্ঞ সর্ব্বশ্রেষ্ঠ সকলের পূজ্য নারায়ণকে অর্চ্চনা করিয়া থাকেন। অতএব তুমিও এক্ষণে শরণাগতবৎসল, হব্যকব্যভোক্তা, বরদাতা হরিকে নমস্কার কর।
“এই জগতে আমার ভক্তেরা চারি শ্রেণীতে বিভক্ত। তন্মধ্যে একান্ত অনুরক্ত ব্যক্তিরাই সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। তাহারা আমা ভিন্ন আর অন্য দেবতার উপাসনা করে না। আমিই তাহাদের অনন্য গতি। তাহারা কামনাপরিশূন্য হইয়া সমুদয় কার্য্য সম্পাদন করিয়া থাকে। অবশিষ্ট তিন শ্রেণীর ভক্তগণ ফলকামনা করিয়া কৰ্ম্মানুষ্ঠান করে; সুতরাং চরমে তাহাদিগকে অধঃপতিত হইতে হয়। জ্ঞানী ব্যক্তিদিগের নিশ্চয়ই মুক্তিলাভ হইয়া থাকে। উহারা একান্তভক্তিসহকারে ব্রহ্মা ও মহাদেব প্রভৃতি অন্যান্য দেবতার সেবা করিয়াও চরমে আমাকে প্রাপ্ত হয়। এই আমি তোমার নিকট ভক্তের বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম। তুমি ও আমি আমরা উভয়ে নরনারায়ণ; আমরা কেবল পৃথিবীর ভারলাঘবের নিমিত্ত মনুষ্যদেহ ধারণ করিয়া ম্যর্ত্ত্যভূমিতে অবতীর্ণ হইয়াছি। আমি যে ও যাহা হইতে সম্ভূত হইয়াছি, তাহা সবিশেষ অবগত আছি। অধ্যাত্মযোগ, মোক্ষধৰ্ম্ম ও লোকের মঙ্গলকর কার্য্য কিছুই আমার অবিদিত নাই। আমি মানবদিগের একমাত্র আশ্রয়।
‘সলিল নর হইতে উদ্ভূত হইয়াছে বলিয়া উহার নাম নার। ঐ সলিল পূৰ্ব্বে আমারই অয়ন অর্থাৎ আশ্রয়স্থান ছিল, এই কারণে আমার নাম ‘নারায়ণ’ হইয়াছে।
“বাসু শব্দের অর্থ নিবাস ও দেব শব্দের অর্থ প্রকাশক। আমি সূর্য্যস্বরূপ হইয়া কিরণজালদ্বারা জগৎসংসার প্রকাশিত করি এবং সমুদয় জীব আমাতেই বাস করিয়া থাকে, এই নিমিত্ত আমার নাম ‘বাসুদেব’।
“বিষ্ণু শব্দের অর্থ গতি, উৎপাদ’, ব্যাপক, দীপ্তিমান এবং প্রবেশ ও নির্গমের স্থান। আমি জীবগণের একমাত্র গতি ও জনয়িতা; আমি এই বিশ্বসংসারে ব্যাপ্ত হইয়া অবস্থান করিতেছি; আমার কান্তি সর্ব্বাপেক্ষা সমুজ্জ্বল এবং আমা হইতে সমুদয় জীব সম্ভূত ও পুনরায় আমাতে লীন হইয়া থাকে; এই নিমিত্তই আমার নাম ‘বিষ্ণু’ হইয়াছে।
“মানবগণ দমগুণদ্বারা সিদ্ধিলাভবাসনায় ত্রিশোকস্বরূপ আমাকে কামনা করে বলিয়া আমার নাম ‘দামোদর’ হইয়াছে।
“পৃশ্নি শব্দের অর্থ বেদ, জল, অন্ন ও অমৃত। ঐ বেদাদি পদার্থসমুদয় আমার গর্ভমধ্যে অবস্থিত রহিয়াছে; এই কারণে আমার নাম ‘পৃশ্নিগর্ভ’। মহর্ষিরা কহিয়া থাকেন যে, একত ও দ্বিত এই উভয়ে ত্রিতকে কূপে নিপতিত করিলে, ত্ৰিত ‘হে পৃশ্নিগর্ভ! আমাকে উদ্ধার কর’ এই বলিয়া আমার নামোচ্চারণ করাতে উদপান [সঙ্কীর্ণ জলাশয়] হইতে উত্তীর্ণ হইয়াছিল।
“সূর্য্য, অনল ও চন্দ্রের যেসকল কিরণজাল প্রকাশিত হয়, সেসমুদয় আমার কেশস্বরূপ। এই নিমিত্ত ব্রাহ্মণগণ আমাকে ‘কেশব’ নামে নির্দ্দেশ করিয়াছেন। মহাত্মা উতথ্য স্বীয় পত্নীতে গর্ভাধান করিয়া প্রস্থান করিলে, একদা বৃহস্পতি সেই উতথ্য পত্নীর সহবাসবাসনায় তাঁহার সমীপে সমুপস্থিত হইয়াছিলেন। বৃহস্পতি আগমন করিলে ঐ গর্ভস্থ বালক তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, ‘মহাত্মন! আমি জননীর গর্ভে অবস্থান করিতেছি; অতএব আপনি আর আমার জননীকে আক্রমণ করিবেন না।’ গর্ভস্থ বালক এই কথা কহিলে বৃহস্পতি ক্রোধে একান্ত অভিভূত হইয়া তাহাকে এই বলিয়া শাপ প্রদান করিলেন, যে, যখন তুমি আমাকে সম্ভোগসুখে বঞ্চিত করিলে, তখন নিশ্চয়ই জন্মান্ধ হইয়া জন্মপরিগ্রহ করিবে। অনান্তর কিয়দ্দিন পরে উতথ্যের পুত্র বৃহস্পতি শাপপ্রভাবে অন্ধ হইয়া জন্মপরিগ্রহ করিল। ঐ পুত্র জন্মান্ধ হওয়াতে প্রথমে দীর্ঘতমানামে বিখ্যাত হয়, কিন্তু পরিশেষে সাঙ্গবেদাধ্যয়ন সমাপনপূর্ব্বক বারংবার আমার ‘কেশব’ এই নাম কীৰ্ত্তন করিয়া চক্ষুলাভ করে। তদবধি তাহার নাম গৌতম বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছে। হে কৌন্তেয়! কি দেবতা, কি ঋষি, যে ব্যক্তি ভক্তিভাবে আমার ‘কেশব’ এই নাম কীৰ্ত্তন করে, নিশ্চয়ই তাহার সমুদয় কামনা সিদ্ধ হয়।
“অনল ও চন্দ্র ইঁহারা উভয়ে একস্থান হইতে সমুৎপন্ন হইয়া এই চরাচর বিশ্বসংসার রক্ষা করিতেছেন। উঁহারা তাপপ্রদান ও বস্তুপ্রকাশনদ্বারা লোকসমুদয়কে আহ্লাদিত করেন বলিয়া হৃষীনামে অভিহিত হয়েন। ঐ অগ্নি ও চন্দ্র আমার কেশস্বরূপ বলিয়া আমার নাম ‘হৃষীকেশ’।