৩৪১. প্রবৃত্তি-নিবৃত্তিবিষয়ক প্রশ্ন

৩৪১তম অধ্যায়

প্রবৃত্তি-নিবৃত্তিবিষয়ক প্রশ্ন

শৌনক কহিলেন, সূতনন্দন! বেদবেদাঙ্গবিদ ভগবান নারায়ণ একাকী কিরূপে যজ্ঞের ভোক্তা ও কৰ্ত্তা হইলেন এবং কি নিমিত্তই বা স্বয়ং নিবৃত্তিধৰ্ম্মনিরত, ক্ষমাশীল ও নিবৃত্তিধৰ্ম্মের স্রষ্টা হইয়া দেবগণের মধ্যে অতি অল্পসংখ্যকমাত্র মহাত্মাকে নিবৃত্তিধর্ম্মাবলম্বী করিয়া অসংখ্য দেবতাকে প্রবৃত্তিমার্গানুসারী যজ্ঞের ভাগগ্রাহী করিলেন? এই সমুদয় বিষয়ে আমার অতি সংশয় উপস্থিত হইয়াছে। তুমি বিশেষরূপে নারায়ণকথা শ্রবণ করিয়াছ; অতএব আমার এই সংশয় দূর করিয়া দাও।

সৌতি কহিলেন, মহর্ষে! মহাত্মা বৈশম্পায়ন জনমেজয়কর্ত্তৃক জিজ্ঞাসিত হইয়া তাঁহাদের নিকট যাহা কহিয়াছিলেন, আমি আপনার নিকট সেই কথা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন, তাহা হইলেই আপনার সংশয় দূরীভূত হইবে।

একদা মহারাজ জনমেজয় মহাত্মা বৈশম্পায়নের নিকট নারায়ণমাহাত্ম্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ভগবন্! আপনি কহিলেন, একমাত্র মোক্ষই পরমসুখের মূল; যাঁহারা পাপপুণ্যবিবর্জ্জিত হইয়া মোক্ষলাভ করিতে পারেন, তাঁহারাই, অতুলতেজঃসম্পন্ন ভগবান্ নারায়ণে লীন হইতে সমর্থ হয়েন। কিন্তু যখন অসুর ও মানবগণ প্রবৃত্তিধৰ্ম্মে নিরত হইয়া যাগযজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করিতেছেন এবং ব্রহ্মাদি দেবগণ সকলেই মোক্ষধর্ম্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক প্রবৃত্তিধৰ্ম্মে নিরত হইয়া হব্যকব্যভোজনে আসক্ত হইয়াছেন তখন আমার বোধ হয়, মোক্ষধৰ্ম্ম নিতান্ত দুরনুষ্ঠেয় [কষ্টসাধ্য]। নিশ্চয় বোধ হইতেছে, ব্রহ্মাদি দেবগণ পরমাত্মায় লীন হইবার উপায় পরিজ্ঞাত নহে। সেই নিমিত্তই কি তাঁহারা শাশ্বত মোক্ষমার্গ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক প্রবৃত্তিমার্গ আশ্রয় করিয়া বারংবার স্থানচ্যুত হইতেছেন? যাহা হউক, যখন ব্রহ্মাদি দেবগণও নিবৃত্তিমার্গ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক প্রবৃত্তিমার্গ আশ্রয় করিয়াছেন, তখন মোক্ষধৰ্ম্মকে কিরূপে শ্রেষ্ঠ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে? হে দ্বিজবর! এই সংশয় হৃদয়নিখাত [হৃদয়ক্ষেত্রে প্রোথিত] শল্যের [খোঁটার] ন্যায় আমাকে উদ্বেলিত করিতেছে; অতএব আপনি, দেবতারা কি নিমিত্ত যজ্ঞের ভাগহারী হইলেন এবং কি নিমিত্তই বা লোকে যজ্ঞস্থলে তাঁহাদিগকে আরাধনা করে, বিশেষতঃ যে দেবতারা যজ্ঞের ভাগ গ্রহণ করিয়া থাকেন, তাঁহারা আবার মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠানপূৰ্ব্বক কাহাকে ভাগ প্রদান করেন, এই সমুদয় বিস্তারিতরূপে কীৰ্ত্তন করিয়া আমার সন্দেহ ভঞ্জন করুন।

মহর্ষি বেদব্যাসের ধৰ্ম্মমীমাংসা

মহারাজ জনমেজয় এইরূপ প্রশ্ন করিলে, মহর্ষি বৈশম্পায়ন তাঁহাকে কহিলেন, মহারাজ! তুমি আমার নিকট অতি গূঢ় বিষয়ের প্রশ্ন করিয়াছ। তপস্যা, বেদবিদ্যা ও পুরাণবিদ্যা না থাকিলে কেহই ঐ প্রশ্নের উত্তর করিতে সমর্থ হয় না। পূর্ব্বে আমরা ঐ প্রশ্ন করাতে আমাদিগের আচার্য্য মহর্ষি বেদব্যাস আমাদের নিকট যাহা কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন, এক্ষণে আমি তোমার নিকট তাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। সুমন্ত, জৈমিনি, পৈল, শুকদেব ও আমি, আমরা পাঁচজন তাঁহার নিকট অধ্যয়ন করিতাম। আমরা সকলেই শৌচাচারপরায়ণ, জিতক্রোধ ও জিতেন্দ্রিয় ছিলাম। তিনি আমাদিগকে চারি বেদ ও মহাভারত অধ্যয়ন করাইতেন। এক্ষণে তুমি আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিলে, আমরাও একদা সিদ্ধচারণসেবিত পরমরমণীয় হিমালয়পৰ্ব্বতে বেদাভ্যাস করিতে করিতে গুরুর নিকট এই প্রশ্ন করিয়াছিলাম। আমরা প্রশ্ন করিলে অজ্ঞাননাশী পরাশরপুত্র মহর্ষি বেদব্যাস আমাদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে শিষ্যগণ! আমি পূৰ্ব্বে অতি কঠোর তপশ্চরণ করিয়াছিলাম। সেই তপোবলে ভূত, ভবিষ্যত ও বর্ত্তমান সমুদয় অবগত আছি। আমি ইন্দ্রিয়সংযমপূৰ্ব্বক অতি কঠোর তপানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলে ক্ষীরোদনিবাসী ভগবান নারায়ণ আমার প্রতি প্রসন্ন হইয়াছিলেন। তাঁহার প্রসন্নতানিবন্ধনই আমার ত্রৈকালিক জ্ঞানের আবির্ভাব হয়। আমি জ্ঞানচক্ষুদ্বারা কল্পের প্রথমাবস্থায় যেসমুদয় ঘটনা অবলোকন করিয়াছি তাহা আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

সংক্ষেপ সৃষ্টিতত্ত্ব

‘‘সাঙ্খ্য ও যোগশাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা যাঁহাকে পরমাত্মা বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন, যিনি স্বীয় কৰ্ম্মবলে মহাপুরুষসংজ্ঞা লাভ করিয়াছেন, সেই মহাপুরুষ হইতে অব্যক্ত প্রকৃতি এবং ঐ অব্যক্ত প্রকৃতি হইতে ত্রিলোক সৃষ্টি করিবার জন্য ব্যক্ত অনিরুদ্ধ উৎপন্ন হইয়াছেন। ঐ অনিরুদ্ধকেও সৰ্ব্বতেজোময় অহঙ্কার বলিয়া কীৰ্ত্তন করা যায়। উনি লোকপিতামহ ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করিয়াছেন। উহা হইতে পৃথিবী, জল, বায়ু, আকাশ ও জ্যোতি এই পঞ্চমহাভূত সমুৎপন্ন হইয়াছে। পঞ্চমহাভূতের সৃষ্টির পর উহাদের গুণসমুদয়ের সৃষ্টি হয়। মরীচি, অঙ্গিরাঃ, অত্রি, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, বশিষ্ঠ ও স্বায়ম্ভুব মনু এই আট মহাত্মা ব্রহ্মার প্রভাবে ঐ পঞ্চমহাভূত হইতে সমুৎপন্ন হইয়াছেন। উঁহারাই এই বিশ্বসংসারের প্রতিষ্ঠাতা ও সৃষ্টিকর্ত্তা, লোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা। লোকপ্রতিষ্ঠার নিমিত্ত সাঙ্গবেদ ও সাঙ্গযজ্ঞের সৃষ্টি করিয়াছেন। ব্রহ্মার ক্রোধ হইতে মহারুদ্র সম্ভূত হইয়া অন্য দশ রুদ্রের সৃষ্টি করেন। এই একাদশ রুদ্র সকলেই ব্রহ্মার অংশস্বরূপ। এইরূপে একাদশ রুদ্র ও মরীচি প্রভৃতি দেবর্ষিসমুদয় সমুৎপন্ন হইয়া লোকসৃষ্টির নিমিত্ত ব্রহ্মার নিকট উপস্থিত হইয়া কহিলেন, “ভগবন! আপনি ত’ আমাদিগের সৃষ্টি করিলেন; এক্ষণে আমরা কে, কোন্ অধিকারে অবস্থান ও কিরূপে উহা প্রতিপালন করিব এবং কাহার কিরূপ ক্ষমতা থাকিবে, তাহা নির্দ্দেশ করিয়া দিন।’

“দেবগণ এই কথা কহিলে, লোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা তাঁহাদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘হে দেবগণ! তোমরা অতি উৎকৃষ্ট প্রস্তাব করিয়াছ; তোমাদিগের মঙ্গল হউক। তোমরা যে বিষয় চিন্তা করিতেছ, আমারও ঐ চিন্তা উপস্থিত হইয়াছে। এক্ষণে কিরূপে ত্রিলোকের নিস্তার এবং কিরূপেই বা তোমাদিগের ও আমার বলরক্ষা হইবে, সেই চিন্তাতেই আমি নিমগ্ন রহিয়াছি। অতএব এক্ষণে চল, আমরা সকলে সমবেত হইয়া লোকসাক্ষী অপ্রকাশ্যরূপী ভগবান্ নারায়ণের নিকট গমনপূৰ্ব্বক তাঁহার শরণাগত হই; তিনিই আমাদিগকে সদুপদেশ প্রদান করিবেন।

ঋষিপ্রমুখ দেবগণের তপস্যা—বিষ্ণুবরলাভ

“ভগবান্ ব্রহ্মা এই কথা কহিলে, দেবতা ও ঋষিগণ তাঁহার সহিত সমবেত হইয়া ক্ষীরোদসমুদ্রের উত্তরকূলে গমনপূর্ব্বক বেদশাস্ত্রানুসারে মহানিয়মনামে ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করিয়া, একাগ্রচিত্তে ঊৰ্দ্ধদৃষ্টি ঊৰ্দ্ধবাহু হইয়া একপদে স্থাণুর ন্যায় স্থিরভাবে অবস্থান করিতে লাগিলেন। এইরূপে তপানুষ্ঠান করিতে করিতে দেবমানের সহস্র বৎসর অতীত হইলে ভগবান নারায়ণের এই বেদবেদাঙ্গভূষিত সুমধুর বাক্য তাঁহাদিগের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল যে, ‘হে ব্রহ্মাদি দেবগণ! হে তপোধনগণ! আমি তোমাদিগকে সদুপদেশ প্রদান করিতেছি। তোমরা ত্রিলোকহিতকর মহৎকার্য্যানুষ্ঠানের চেষ্টা করিতেছ, তাহা আমি অবগত হইয়াছি। এক্ষণে তোমাদিগের বলবর্দ্ধন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। তোমরা আমার আরাধনার্থ কঠোর তপানুষ্ঠান করিয়াছ; অতএব তোমাদিগকে তাহার অনুরূপ উৎকৃষ্ট ফল প্রদান করিতেছি, উপভোগ কর। তোমরা সকলে একাগ্রচিত্তে আমার উদ্দেশে যজ্ঞানুষ্ঠানপূর্ব্বক আমার ভাগ কল্পনা কর, তাহা হইলেই আমি তোমাদিগের অধিকার নির্দ্দেশ করিয়া দিব।’

বিষ্ণুর আদেশে দেবগণের যজ্ঞভাগ ব্যবস্থা

“তখন ব্রহ্মাদি দেবতা ও মহর্ষিগণ দেবদেব নারায়ণের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া প্রীতিপ্রফুল্লচিত্তে বেদোক্ত বিধি অনুসারে বৈষ্ণবযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলেন। ঐ যজ্ঞে স্বয়ং ব্রহ্মা এবং দেবতা ও মহর্ষিগণ সকলেই মায়াতীত, সর্ব্বোত [সৰ্ব্বব্যাপী], সৰ্ব্বগামী ভাস্করের ন্যায় ভাস্বর [উজ্জ্বল] পরমপুরুষ নারায়ণের উদ্দেশে ভাগ কল্পনা করিয়া তাঁহাকে প্রদান করিতে লাগিলেন। তখন নারায়ণ অলক্ষিতভাবে নভোমণ্ডলে অবস্থান করিয়া সুরগণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে দেবগণ! তোমরা যেরূপ ভাগ কল্পনা করিয়াছ, তৎসমুদয়ই আমার নিকট সমুপস্থিত হইয়াছে। এক্ষণে আমি তোমাদিগের প্রতি অতিমাত্র প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া বর প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর। মৎপ্রদত্ত বরপ্রভাবে তোমরা প্রতিযুগেই প্রভূত দক্ষিণাদানসহকারে যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া তাহার ফলভাগী হইবে। এই ত্রিলোকমধ্যে যাহারা যজ্ঞানুষ্ঠান করিবে, তাহাদিগকে বেদবিধানানুসারে তোমাদিগের নিমিত্ত ভাগকল্পনা করিতে হইবে। আর এই যজ্ঞে তোমাদিগের মধ্যে আমার নিমিত্ত যিনি যেরূপ ভাগ নির্দ্দেশ করিবেন, তিনি সেইরূপ যজ্ঞভাগ প্রাপ্ত হইবেন। বেদমধ্যে আমিই এরূপ ব্যবস্থা সংস্থাপন করিয়াছি। তোমরা সকল লোকের হিতচিন্তা করিয়া থাক; অতএব এক্ষণে স্ব স্ব অধিকারানুসারে লোকসকল প্রতিপালন করিতে প্রবৃত্ত হও।

‘এই জীবলোকে প্রবৃত্তিফলমূলক যেসমস্ত ক্রিয়াকলাপ প্রবর্ত্তিত হইবে, তদ্বারা তোমরা পরিতৃপ্ত হইয়া লোকরক্ষা করিতে পারিবে। তোমরা মনুষ্যগণকর্ত্তৃক সৎকৃত হইয়া পশ্চাৎ আমার সৎকার করিবে। বেদ, যজ্ঞ ও ওষধিসকল তোমাদেরই প্রীতিসাধনার্থ নির্ম্মিত হইয়াছে; এই সমস্ত বস্তু নিয়মানুসারে ব্যবহৃত হইলেই তোমরা প্রীত হইবে। যে অবধি কল্পক্ষয় না হয়, তদবধি তোমরা স্ব স্ব অধিকারে অবস্থান করিবে; অতএব এক্ষণে তোমরা স্ব স্ব অধিকারানুসারে লোকরক্ষায় নিযুক্ত হও। মরীচি, অঙ্গিরাঃ, অত্রি, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু ও বশিষ্ঠ এই সাতজন মহর্ষি ব্রহ্মার মন হইতে উৎপন্ন হইয়াছেন। ইঁহারা সকলেই বেদবেত্তা বেদাচার্য্য ও কাম্যকৰ্ম্মপরতন্ত্র। ইঁহারা প্রজা উৎপাদন করিবার নিমিত্তই সৃষ্ট হইয়াছেন। যাঁহারা যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপের অনুষ্ঠান করিবেন, তাঁহাদিগের এই পথ নির্দ্দেশ করিলাম। এক্ষণে নিবৃত্তিপথাবলম্বীদিগের বিষয়ও উল্লেখ করিতেছি, শ্রবণ কর।

অধিকারি=নিরূপণ—প্রবৃত্তি-নিবৃত্তিপথ

‘সন, সনৎসুজাত, সনক, সনন্দ, সনৎকুমার, কপিল ও সনাতন এই সাতজন মহর্ষি ব্রহ্মার মন হইতে উৎপন্ন হইয়াছেন। ইঁহাদিগের বিজ্ঞানবল স্বতঃসিদ্ধ। ইঁহারা সকলেই নিবৃত্তিধর্ম্মাবলম্বী। ইঁহারা যোগ ও সাঙ্খ্যজ্ঞানবিশারদ, মোক্ষধৰ্ম্মের আচার্য্য ও মোক্ষধৰ্ম্মপ্রবর্ত্তক। প্রকৃতি হইতে অহঙ্কার, সত্ত্বাদি গুণত্রয় ও মহত্তত্ত্ব উৎপন্ন হইয়াছে। ক্ষেত্রজ্ঞ সেই প্রকৃতি হইতে শ্রেষ্ঠ। আমিই সেই ক্ষেত্রজ্ঞ। আমি কর্ম্মীদিগের প্রবৃত্তিপথ ও জ্ঞানীদিগের নিবৃত্তিপথস্বরূপ। যে ব্যক্তি যেরূপ পথ অবলম্বন করে, তাহার তদনুরূপ ফললাভ হয়।

‘হে দেবগণ! এই ব্ৰহ্ম সৰ্ব্বলোকগুরু, জগতের আদিকৰ্ত্তা ও তোমাদিগের পিতামাতার স্বরূপ। ইনি আমার আদেশানুসারে জীবলোকের উপকারসাধনে প্রবৃত্ত হইবেন। রুদ্রদেব ইঁহার ললাটদেশ হইতে উৎপন্ন হইয়াছেন। তিনি ব্রহ্মার আদেশানুসারে লোকের হিতসাধন করিবেন। এক্ষণে তোমরা অবিলম্বে স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিয়া আপন আপন অধিকারানুরূপ কার্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হও। এই ত্রিলোকমধ্যে অচিরাৎ যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপ প্রবর্ত্তিত করিয়া প্রাণীগণের কৰ্ম্ম, গতি ও নিয়মিত আয়ুর বিষয় সমালোচনা কর। এই সত্যযুগ সকল কাল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এই সত্যযুগে যজ্ঞানুষ্ঠানপূর্ব্বক পশুচ্ছেদন করা নিতান্ত নিষিদ্ধ। এই যুগে ধৰ্ম্ম চারিপাদ। সত্যযুগের পর ত্রেতাযুগ উপস্থিত হইবে। এই যুগে ধর্ম্ম ত্রিপাদ। তৎকালে যাগযজ্ঞে পশুসকলকে মন্ত্রপূত করিয়া ছেদন করিবার কিছুমাত্র বাধা থাকিবে না। ত্রেতাযুগের পর দ্বাপরযুগ উপস্থিত হইবে; তখন ধৰ্ম্ম দ্বিপাদ হইবে। ঐ সময় পাপ ও পুণ্য তুল্যরূপ আধিপত্য প্রদর্শন করিবে। দ্বাপরের পর কলিযুগ উপস্থিত হইবে; ঐ যুগে ধৰ্ম্ম একপাদ বিরাজিত থাকিবে।’

ক্ষীণপুণ্য কলিকালের কর্ত্তব্যনির্ণয়

“ভগবান্ নারায়ণ এই কথা কহিলে, মহর্ষি ও দেবগণ তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘ভগবন্! কলিযুগে ধর্ম্ম একপাদমাত্র অবিশিষ্ট থাকিলে আমাদিগের কিরূপ অনুষ্ঠান করিতে হইবে, আপনি তদ্বিষয়ে আমাদিগকে উপদেশ প্রদান করুন।’

“তখন নারায়ণ কহিলেন, ‘হে মহাপুরুষগণ! ঐ সময় যথায় বেদ, যজ্ঞ, তপ, সত্য, ইন্দ্রিয়নিগ্রহ ও অহিংসা থাকিবে, তোমরা সেই স্থানেই ধর্ম্মপরায়ণ হইয়া অবস্থান করিবে। ঐ সময় যথায় অবস্থান করিলে অধৰ্ম্ম তোমাদিগকে স্পর্শও করিতে না পারে, সেই স্থানেই বাস করা তোমাদের কর্ত্তব্য।

হয়গ্রীবমূৰ্ত্তির আবির্ভাব

“ভগবান্ নারায়ণ এইরূপ উপদেশ প্রদান করিলে মহর্ষি ও দেবগণ তাঁহার অনুজ্ঞা গ্রহণপূৰ্ব্বক তাঁহাকে নমস্কার করিয়া স্ব স্ব অভিলষিত স্থানে প্রস্থান করিলেন। কেবল একমাত্র ব্রহ্মাই নারায়ণকে দর্শন করিবার মানসে তথায় অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন ভগবান্ নারায়ণ হয়গ্রীবমূর্ত্তি ধারণপূৰ্ব্বক কমণ্ডলু ও ত্রিদণ্ড হস্তে লইয়া সাঙ্গবেদ উচ্চারণ করিতে করিতে ব্রহ্মার সমক্ষে প্রাদুর্ভূত হইলেন। লোকপিতামহ ব্রহ্মা সেই অমিতপরাক্রম হয়গ্রীব নারায়ণকে দর্শন করিবামাত্র প্রণাম করিয়া ত্রিলোকের হিতসাধনাৰ্থে কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহার অগ্রভাগে দণ্ডায়মান হইলেন। তখন ভগবান্ নারায়ণ তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া কহিলেন, ‘ব্রহ্মন্‌! তুমি নির্দ্দিষ্ট নিয়মানুসারে ত্রিলোকের কার্য্যভার বহন কর। তুমি সমুদয় ভূতের সৃষ্টিকর্ত্তা ও জগতের নিয়ন্তা। আমি তোমার উপর সমুদয় ভার সমর্পণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইলাম। যখন দেবগণের কার্য্যভার বহন করা তোমার পক্ষে নিতান্ত দুঃসাধ্য হইবে, তখন আমি অংশে [অবতাররূপে] অবতীর্ণ হইব।’ ভগবান্ নারায়ণ এই কথা বলিয়া অন্তর্হিত হইলে লোকাপতান ব্ৰহ্মাও তৎক্ষণাৎ স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন।

“এইরূপে নারায়ণ যজ্ঞের অগ্রভাগ গ্রহণ ও যজ্ঞানুষ্ঠানের উপদেশ প্রদানদ্বারা স্বয়ং উহার অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। তিনি স্বয়ং মুমুক্ষুদিগের প্রধান গতি নিবৃত্তিমার্গ অবলম্বন করিয়া অন্যান্য লোকের নিমিত্ত প্রবৃত্তিধর্ম্ম নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন। তিনি আদি, অন্ত ও মধ্য। তিনি প্রজাগণের বিধাতা, ধ্যেয়, কৰ্ত্তা ও কার্য্য। তিনি যুগান্তকালে ত্রিলোক সংহার করিয়া নিদ্রাসুখ অনুভব; আবার যুগের আদিসময়ে জাগরিত হইয়া পুনরায় সমুদয় জগৃতের সৃষ্টি করেন। তিনি নির্গুণ, অজ, বিশ্বরূপ ও দেবগণের তেজঃস্বরূপ। তিনি পঞ্চমহাভূত, একাদশ রুদ্র, আদিত্য, বসু, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, বায়ু, বেদ, বেদাঙ্গ, যজ্ঞ, তপস্যা, তেজ, যশ, বাক্য ও নদীসমুদয়ের অধিপতি। তিনি সমুদ্রবালা, নিত্য, মুঞ্জকেশী [মুঞ্জতৃণের ন্যায় কেশসমন্বিত] ও শান্তস্বরূপ। জীবগণ তাঁহা হইতেই মোক্ষধৰ্ম্মের জ্ঞানলাভ করে। তিনি কপর্দ্দী, বরাহ, একশৃঙ্গ, ধীমা, বিবস্বান্, হয়গ্রীব, চতুর্মূৰ্ত্তিধারী, পরমগুহ্য, জ্ঞানশূন্য, ক্ষর ও অক্ষর। তিনি অব্যাহতগতি প্রভাবে সৰ্ব্বত্র সঞ্চরণ করিতেছেন। কেবল জ্ঞানচক্ষুদ্বারা সেই পরব্রহ্মকে সন্দর্শন করা যায়। হে শিষ্যগণ! আমি জ্ঞানবলে এইরূপে এই সমুদয় অবগত হইয়াছি, এক্ষণে তোমরা জিজ্ঞাসা করাতে বিস্তারিতরূপে সমুদয় কীৰ্ত্তন করিলাম। অতঃপর তোমরা আমার বচনানুসারে বেদপাঠদ্বারা সেই নারায়ণের স্তুতিগান, তাঁহার সেবা ও তাঁহার পূজায় একান্ত অনুরক্ত হও।”

নারায়ণমাহাত্ম-শ্রবণফল

হে জনমেজয়! ধীমান মহর্ষি বেদব্যাস এইরূপ কহিলে, তাঁহার পুত্র শুকদেব ও আমরা সকলে তাঁহার সহিত সমবেত হইয়া ঋগবেদ-পাঠদ্বারা নারায়ণের স্তব করিলাম। ইতিপূর্ব্বে তুমি আমাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে, তাহা কীৰ্ত্তন করিলাম। আমাদিগের আচার্য্য বেদব্যাস পূর্ব্বে আমাদের নিকট এইরূপ কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন। যিনি ভগবান্ নারায়ণকে নমস্কার করিয়া তাঁহার মাহাত্ম্য শ্রবণ বা কীৰ্ত্তন করেন, তাঁহার রোগের লেশমাত্রও থাকে না। প্রত্যুত তিনি অলৌকিক রূপবান্ হইয়া থাকেন। এই স্তব পাঠ বা শ্রবণ করিলে আতুর ব্যক্তি রোগ হইতে এবং বদ্ধ ব্যক্তি বন্ধন হইতে বিমুক্ত হয়; কামী ব্যক্তিরা পূর্ণকাম ও দীর্ঘায়ুযুক্ত হয়; বন্ধ্যা স্ত্রীর বন্ধ্যতাদোষ দূরীভূত হইয়া যায় এবং ব্রাহ্মণেরা সৰ্ব্বজ্ঞতা, ক্ষত্রিয়েরা বিজয়, বৈশ্যগণ বিপুল ঐশ্বর্য্য, শূদ্রগণ সমুদয় সুখ, পুত্রবিহীন ব্যক্তি পুত্র এবং কন্যা অভিলষিত পতিলাভ করে। গর্ভিণী গর্ভবেদনায় নিতান্ত কাতর হইয়া এই স্তব শ্রবণ করিলে অচিরাৎ পুত্র প্রসব করে। পান্থজনেরা পথিমধ্যে এই স্তব পাঠ করিলে নিরাপদে পথ অতিক্রান্ত করিতে পারে। ফলতঃ এই স্তব পাঠ করিলে যে যাহা কামনা করে, সে অনায়াসেই তাহা লাভ করিতে সমর্থ হয়। ভক্তগণ মহর্ষি বেদব্যাসের মুখনিৰ্গত এই নারায়ণমাহাত্ম্য এবং মহর্ষি ও দেবগণের একত্র সমাগমবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া অনায়াসে পরমসুখে কালযাপন করিয়া থাকেন।