৩৩তম অধ্যায় – গদাযুদ্ধপর্ব্বাধ্যায়
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমার পুত্র দুর্য্যোধন স্বভাবতই ক্রোধপরায়ণ। সে তৎকালে বিপক্ষগণ কর্ত্তৃক ঐরূপ তিরস্কৃত হইয়া কি করিল? পূৰ্ব্বে এরূপ তিরস্কারবাক্য কখনই তাহার কর্ণগোচর হয় নাই। সে রাজত্ব নিবন্ধন সৰ্ব্বদা সকল লোকের মান্য হইয়া কালযাপন করিয়াছে। হায়! পূৰ্ব্বে যে ব্যক্তি আতপত্রচ্ছায়ায় দণ্ডায়মান হইয়া ‘আমি পরের ছায়া আশ্রয় করিলাম’ বলিয়া খেদ করিত, সূর্যের প্রভাও যাহার অসহ্য হইত, সে কিরূপে অরাতিগণের কটুবাক্য সহ্য করিল? হে সঞ্জয়! ম্লেচ্ছ ও আটবিক-সমবেত সমুদয় পৃথিবী যাহার প্রসাদে প্রতিপালিত হইয়াছে, সেই দুর্য্যোধন এক্ষণে স্বজনবিহীন হইয়া নির্জ্জনে সলিলমধ্যে অবস্থানপূর্ব্বক বারংবার পাণ্ডবগণের তিরস্কারবাক্য শ্রবণ করিয়া তাহাদিগকে কি প্রত্যুত্তর প্রদান করিল, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন কর।”
দুৰ্য্যোধনের জল হইতে বহিরাগমন
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনার পুত্র দুর্য্যোধন হ্রদমধ্যে অবস্থানপূর্ব্বক যুধিষ্ঠির ও তাঁহার ভ্রাতৃগণের সেই তিরস্কারবাক্য শ্রবণ করিয়া বারংবার দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ ও বাহুদ্বয় কম্পন করিয়া সলিলমধ্য হইতে বহির্গত হইলেন এবং যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “হে কুন্তীনন্দন! তোমাদিগের বন্ধুবান্ধব, রথ ও বাহন সমস্তই বিদ্যমান রহিয়াছে, কিন্তু আমি একাকী, বিরথ, হতবাহন ও পরিশ্রান্ত হইয়া জীবিত রহিয়াছি। তোমরা অনেকে রথারূঢ় হইয়া শস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক আমার চতুর্দ্দিক পরিবেষ্টন করিলে আমি পদাতি ও অস্ত্রশস্ত্রবিহীন হইয়া কিরূপে তোমাদের সহিত যুদ্ধ করিতে পারি? অতএব তোমরা একে একে আমার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হও। এক ব্যক্তির, বিশেষতঃ বর্ম্মহীন, পরিশ্রান্ত, বিপন্ন, ক্ষতবিক্ষত ও শ্রান্তবাহন ব্যক্তির সহিত এককালে বহু বীরের যুদ্ধ করা কোনরূপেই যুক্তিসঙ্গত নহে। হে ধৰ্ম্মরাজ! এক্ষণে কি তুমি, কি ভীমসেন, কি অর্জ্জুন, কি নকুল, কি সহদেব, কি সাত্যকি, কি বাসুদেব, কি পাঞ্চালগণ, কি অন্যান্য সৈনিকগণ, তোমাদের কাহাকেও দেখি আমার ভয়সঞ্চার হইতেছে না। আমি একাকী তোমাদের সকলকেই নিবারণ করিব। হে মহারাজ! সাধুদিগের কীৰ্ত্তি ধর্মমূলক। আমি সেই ধর্ম ও কীৰ্ত্তি রক্ষা করিয়া কহিতেছি যে, সংবৎসর যেমন ক্রমে ক্রমে সমুদয় ঋতুতে মিলিত হয়, তদ্রূপ আমি তোমাদের সকলের সহিত মিলিত হইব। হে পাণ্ডবগণ! তোমরা কিয়ৎক্ষণ সুস্থির হও। আমি বিরথ ও শস্ত্রবিহীন হইয়াও প্রভাতসময়ে সূৰ্য্য যেমন কিরণজাল বিস্তারপূর্ব্বক নক্ষত্রগণকে বিনাশ করেন, তদ্রূপ তোমাদের সকলকেই সংহার করিব। হে যুধিষ্ঠির! আমি তোমাকে তোমার ভ্রাতৃগণের সহিত নিপাতিত করিয়া বাহ্লীক, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, জয়দ্ৰথ, ভগদত্ত, শল্য, ভূরিশ্রবা, শকুনি এবং আমার পুত্রগণ, বন্ধুবান্ধবগণ ও অন্যান্য ক্ষত্রিয়গণের ঋণ পরিশোধ করিব।
দুৰ্য্যোধনের যুদ্ধনিয়ম নির্ধারণ
“হে মহারাজ! আপনার পত্র দুর্য্যোধন যুধিষ্ঠিরকে এই কথা বলিয়া নিরস্ত হইলেন। তখন যুধিষ্ঠির কুরুরাজের সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে দুর্য্যোধন! তুমি ভাগ্যবলে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম অবগত হইয়াছ এবং ভাগ্যবলেই তোমার যুদ্ধে বাসনা হইয়াছে; তুমি ভাগ্যবলেই বীরপদবী প্রাপ্ত এবং সমরব্যাপার সম্যক অবগত হইয়া একাকীই আমাদিগের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবার অভিলাষ করিতেছ। অতএব অভীষ্ট আয়ুধ গ্রহণপূর্ব্বক আমাদিগের মধ্যে যে কোন বীরের সহিত সমাগত হইয়া যুদ্ধ কর। আমরা সকলে রণস্থলে অবস্থানপূর্ব্বক যুদ্ধব্যাপার নিরীক্ষণ করিব। আমি কহিতেছি, তুমি আমাদের মধ্যে একজনকে বিনাশ করিতে পারিলে সমুদয় রাজ্য তোমার হইবে।’ তখন দুর্য্যোধন কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! যদি আমাকে একজনের সহিত যুদ্ধ করিতে হয়, তাহা হইলে আমি তোমাদের মধ্যে সৰ্ব্বাপেক্ষা সমধিক বলশালী ব্যক্তির সহিত যুদ্ধ করিব; আর তুমি আমাকে যে কোন আয়ুধ মনোনীত করি গ্রহণ করিতে কহ্যিছ, আমি তদনুসারে এই গদা মনোনীত করিলাম। এক্ষণে তোমাদের মধ্যে যিনি আমার বলবীৰ্য্য সহ্য করিতে সমর্থ হইবেন, সেই বীর পদচারে আমার সহিত গদাযুদ্ধে প্রবৃত্ত হউন। ইতিপূৰ্ব্বে বারংবার অত্যাশ্চৰ্য্য রথযুদ্ধ হইয়া গিয়াছে, এক্ষণে এই অদ্ভুত গদাযুদ্ধ আরম্ভ হউক। লোকে অস্ত্রের পরিবর্তন করিয়া থাকে, আজ তোমার সম্মতিক্রমে যুদ্ধের পরিবর্তন উপস্থিত হউক। হে যুধিষ্ঠিরা! আমি গদাপ্রভাবে তোমাকে, তোমার অনুজদিগকে এবং পাঞ্চাল, সৃঞ্জয় ও অন্যান্য সৈন্যগণকেও পরাজিত করিব। সমরাঙ্গনে দেবরাজ ইন্দ্রকে অবলোকন করিয়াও আমার অন্তঃকরণে কিছুমাত্র ভয়সঞ্চার হয় না। তখন ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে গান্ধারীতনয়! তুমি এক্ষণে হ্রদমধ্য হইতে সমুত্থিত হইয়া আমার বা আমার পক্ষীয় অন্য কোন ব্যক্তির সহিত গদাযুদ্ধে প্রবৃত্ত হও এবং অবহিত হইয়া পুরুষকার প্রদর্শন কর। আজ যদি ইন্দ্রও তোমাকে আশ্রয় প্রদান করেন, তথাপি তুমি বিনষ্ট হইবে সন্দেহ নাই।’
গদাহস্তে দুৰ্য্যোধনের উত্তরণ—রণনীতি ঘোষণা
“হে মহারাজ! আপনার আত্মজ রাজা দুর্য্যোধন যুধিষ্ঠিরের বাক্য শ্রবণ করিয়া বিলমধ্যলীন ভুজঙ্গের ন্যায় নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। উত্তম অশ্ব যেমন কশাঘাত সহ্য করিতে পারে না, তদ্রূপ তিনি ধর্মরাজের সেই বাক্য কোনক্রমে সহ্য করিতে সমর্থ হইলেন না। তখন তিনি পৰ্ব্বতের ন্যায় সুদৃঢ় ভীষণ লৌহময় গদা স্কন্ধে লইয়া সলিলরাশি বিক্ষোভিত করিয়া প্রচণ্ড মার্তণ্ডের ন্যায়, সশৃঙ্গ পৰ্ব্বতের ন্যায়, শূলপাণি রোষোদ্ধত রুদ্রের ন্যায় হ্রদ হইতে সমুত্থিত হইলেন। পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ তাঁহাকে হ্রদমধ্য হইতে উত্থিত হইতে দেখিয়া পরস্পর করস্পর্শ করিয়া আহ্লাদ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তখন রাজা দুর্য্যোধন উহা উপহাস বিবেচনা করিয়া নয়নদ্বয় উর্ধে উত্তোলন, ললাটে ত্রিশিখ ভ্রুকুটি বন্ধন ও বারংবার দশনচ্ছদ [অধর] দংশনপূর্ব্বক বাসুদেবের সহিত পাণ্ডবগণকে দগ্ধ করতে সমুদ্যত হইয়াই যেন কহিতে লাগিলেন, ‘হে পাণ্ডবগণ! তোমরা অবিলম্বে এই উপহাসের ফল লাভ করিবে। আমি অচিরাৎ তোমাদিগকে পাঞ্চালগণের সহিত যমালয়ে প্রেরণ করিব।
“হে মহারাজ! আপনার আত্মজ রাজা দুর্য্যোধন এই বলিয়া গদাহস্তে সলিলসিক্ত কলেবরে হ্রদের কূলে দণ্ডায়মান হইয়া নির্ঝর-জলস্রাবী [ঝরণার জলমোচনকারী] মহীধরের [পৰ্ব্বতের] ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন। তৎকালে পাণ্ডবগণ তাঁহাকে গদা উদ্যত করিতে দেখিয়া উৰ্দ্ধবাহু নিতান্ত ক্রুদ্ধ কৃতান্তের ন্যায় বোধ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবল-পরাক্রান্ত রাজা দুর্য্যোধন হর্ষভরে বৃষভের ন্যায় চীৎকার করিয়া মেঘগম্ভীর-নির্ঘোষে পাণ্ডবগণকে গদাযুদ্ধে আহ্বানপূর্ব্বক ধৰ্ম্মরাজকে কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! তোমরা একে একে আমার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও, এক ব্যক্তির সহিত এককালে বহু লোকের যুদ্ধ হওয়া নিতান্ত অন্যায় হইবে। বিশেষেতঃ আমি নিতান্ত পরিশ্রান্ত, সলিলসিক্ত, বৰ্মহীন ও ক্ষতবিক্ষত-কলেবর হইয়াছি এবং আমার বাহন ও সৈন্যসকল বিনষ্ট হইয়াছে; আমি ক্রমে ক্রমে সকলেরই সহিত যুদ্ধ করিব। তুমি ন্যায়ান্যায় বিবেচনা করিতে পার, এক্ষণে ন্যায়ানুসারে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও।
“তখন যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে দুর্য্যোধন! যখন বহুসংখ্যক মহারথ একত্র হইয়া অভিমন্যুকে বিনাশ করিয়াছিলে, তখন তোমার এরূপ প্রজ্ঞা কোথায় ছিল? ক্ষত্রিয়ধর্ম নিতান্ত ক্রুর ও নিরপেক্ষ, ইহাতে দয়ার লেশমাত্রও নাই। নচেৎ তোমরা সকলেই ধৰ্ম্মজ্ঞ ও বীরপুরুষ হইয়া তৎকালে কিরূপে অভিমন্যুকে বিনাশ করিলে? ন্যায়ানুসারে যুদ্ধ করিলে ইন্দ্রলোকপ্রাপ্তি হয়, তাহার কিছুমাত্র সংশয় নাই। অনেকে একত্র হইয়া একজনকে বিনাশ করিলে যদি অধৰ্ম হয়, তবে কিরূপে তোমার মতানুসারে বীরগণ সমবেত হইয়া অভিমন্যুকে সংহার করিল? বিপদকালে সকলেই ধর্মচিন্তা করিয়া থাকে; কিন্তু সম্পদের সময় পরলোকের দ্বার রুদ্ধ অবলোকন করে। যাহা হউক, এক্ষণে তুমি কবচ পরিধান, কেশকলাপ বন্ধন ও যে কোন দ্রব্যের অভাব থাকে, তাহা গ্রহণ কর। আমি এখনও কহিতেছি যে, তুমি পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে যাহার সহিত অভিরুচি হয়, যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও, হয়ে তাহাকে বিনাশ করিয়া রাজ্যপদ লাভ কর, না হয় তাহার হস্তে নিহত হইয়া স্বর্গসুখ অনুভব কর। হে বীর! এক্ষণে তোমার জীবন রক্ষা ব্যতীত আর কি হিতসাধন করিতে হইবে, তাহা নির্দেশ কর।’ “হে মহারাজ! ধর্মরাজ এই কথা কহিলে আপনার পুত্র সুবর্ণময় বৰ্ম ও কনকমণ্ডিত বিচিত্র শিরস্ত্রাণ গ্রহণ করিয়া সুমেরু পৰ্ব্বতের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন এবং গদা সমুদ্যত করিয়া পাণ্ডবগণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে বীরগণ! এক্ষণে তোমাদিগের মধ্যে সহদেব, ভীমসেন, নকুল, অর্জ্জুন অথবা যুধিষ্ঠির একজন আসিয়া আমার সহিত সমরে প্রবৃত্ত হও। আমি নিশ্চয়ই তাঁহাকে পরাজিত করিয়া কৃতকাৰ্য্য হইব। আমি ক্রমে ক্রমে তোমাদের সকলকেই বিনাশ করিয়া বৈরানল নিৰ্ব্বাণ করিব। বোধ হয়, ন্যায়ানুসারে গদাযুদ্ধে তোমরা কেহই আমার সমকক্ষ হইবে না। স্বমুখে এরূপ উদ্ধত বাক্যপ্রয়োগ করা কর্তব্য নহে। যাহা হউক, আমি অচিরাৎ তোমাদিগের সমক্ষে আপনার বাক্য সফল করিব। এক্ষণে আমার সহিত যুদ্ধ করিতে যাঁহার অভিরুচি হয়, তিনি গদা গ্রহণ করুন, আমার বাক্য সত্য কি মিথ্যা, তাহা অবিলম্বে প্রকাশ পাইবে।’