৩৩৬. আদি বিষ্ণুমূর্ত্তি দর্শনার্থী নারদের শ্বেতদ্বীপগমন

৩৩৬তম অধ্যায়

আদি বিষ্ণুমূর্ত্তি দর্শনার্থী নারদের শ্বেতদ্বীপগমন

ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! দেবর্ষি নারদ সকল লোকের আশ্রয়স্থান ভগবান্ নারায়ণের সেই বাক্যশ্রবণ করিয়া পুনরায়, তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘হে দেব! তুমি স্বয়ম্ভু হইয়াও লোকের হিতসাধনের নিমিত্ত ধর্ম্মের আলয়ে চারি-অংশে অবতীর্ণ হইয়াছ। এক্ষণে তুমি স্বকার্য্যসাধন কর। আমি অদ্য তোমার শ্বেতদ্বীপস্থিত আদ্যামূৰ্ত্তি দর্শন করিবার নিমিত্ত প্রস্থান করি। আমি সতত গুরুলোকের অর্চ্চনা করিয়া থাকি; অন্যের গোপনীয় বিষয় কদাচ প্রকাশ করি নাই; যত্নপূৰ্ব্বক বেদাধ্যয়ন ও তপানুষ্ঠান করিয়াছি; কখনই মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ, অন্যায়লব্ধ দ্রব্যে উদরপূরণ, পরদারাপহরণ, অপবিত্রস্থানে সঞ্চরণ বা অন্যের দানগ্রহণ করি নাই; শত্রু ও মিত্রকে তুল্যজ্ঞান করিয়া থাকি এবং নিরন্তর ভক্তিভাবে সেই আদিদেবের আরাধনায় নিযুক্ত আছি। যখন আমি এই সমস্ত কার্য্যদ্বারা শুদ্ধসত্ত্ব [পবিত্র হৃদয়] হইয়াছি, তখন সেই অনন্তদেবের দর্শন লাভ করা আমার পক্ষে নিতান্ত অসম্ভব নহে।’ তখন মহাত্মা নারদ এই কথা কহিলে নিত্যধর্ম্মের রক্ষক ভগবান নারায়ণ পরম পরিতুষ্ট হইয়া তাহাকে যথোচিত উপচারে অর্চ্চনা করিয়া কহিলেন, “তপোধন! স্বচ্ছন্দে আপনার অভিলষিত স্থানে গমন কর।”

“তখন দেবর্ষি নারদ সেই পুরাতন ঋষি নারায়ণকে অর্চ্চনা করিয়া তাঁহার নিকট বিদায় গ্রহণপূৰ্ব্বক মহাবেগে নভোমণ্ডলে উত্থিত হইলেন এবং অবিলম্বে সুমেরুপৰ্ব্বতে উপস্থিত হইয়া উহার শিখরদেশে ক্ষণকাল উপবেশনপূর্ব্বক বায়ুকোণে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া দেখিলেন, ক্ষীরসমুদ্রের উত্তরদিকে শ্বেতনামে অতি-বিস্তীর্ণ দ্বীপ বিরাজমান রহিয়াছে। উহা সুমেরুপৰ্ব্বতের মূল হইতে দ্বাত্রিংশৎ সহস্র যোজন ঊর্ধ্ব। ঐ দ্বীপে বহুসংখ্যক বিশুদ্ধসত্ত্বসম্পন্ন পুরুষ বাস করেন। উঁহারা প্রাকৃতিক স্থূলদেহবিমুক্ত, শব্দাদিবিষয়ভোগশূন্য, নিশ্চেষ্ট, সুগন্ধযুক্ত ও পাপবিহিত। পাপাত্মারা উহাদিগকে অবলোকন করিলে তাহাদের নেত্র দগ্ধ হইয়া যায়। উঁহাদিগের দেহ বজ্রাস্থির ন্যায় সুদূঢ়, মস্তক ছত্রাকার ও চরণতল রেখাশতসংযুক্ত [শতরেখাযুক্ত]। উঁহারা মান ও অপমানে তুল্যজ্ঞান করিয়া থাকেন। উঁহাদিগের মুখ চারিটি, ক্ষুদ্র দন্ত আটটি ও দীর্ঘ দন্ত আটটি। ঐ সমস্ত অলৌকিক রূপযৌবনসম্পন্ন, যোগপ্রভাবলদ্বলবীর্য্যযুক্ত মহাপুরুষেরা, যাঁহা হইতে বেদ, ধৰ্ম্ম এবং প্রশান্তচিত্ত মুনি, দেবতা ও অন্যান্য প্রাণীগণ সৃষ্ট হইয়াছেন, সেই বিশ্বস্রষ্টা বিশ্বমুখ সূর্য্যের ন্যায় তেজস্বী কালকেও গ্রাস করিতে পারেন।”

শ্বেতদ্বীপপ্রসঙ্গে বিষ্ণুভক্ত-উপরিচরচরিত্র

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! ইন্দ্রিয়শূন্য, নিরাহার, স্পন্দবিরহিত, সুগন্ধযুক্ত, শ্বেতদ্বীপনিবাসী পুরুষেরা কিরূপে জন্মগ্রহণ করিলেন এবং তাঁহাদিগের কিরূপ সঙ্গতিই বা লাভ হইবে? ইহলোকে, যাঁহারা মুক্তিলাভ করেন, তাঁহারা কি শ্বেতদ্বীপনিবাসীদিগের ন্যায় লক্ষণসম্পন্ন হয়েন? আপনি সকল বিষয়ই জ্ঞাত আছেন; অতএব এক্ষণে আমার এই সংশয় ছেদন করুন। ইহা জ্ঞাত হইবার নিমিত্ত আমার একান্ত কৌতূহল উপস্থিত হইয়াছে।”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমি পূৰ্ব্বে পিতার মুখে যে কথা শ্রবণ করিয়াছি, এক্ষণে তোমার প্রশ্নের উত্তরপ্রদান উপলক্ষে সেই সুবিস্তীর্ণ অতি উকৃষ্ট কথা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বকালে উপরিচরনামে হরিভক্তিপরায়ণ পরমধাৰ্ম্মিক এক নরপতি ছিলেন। উহার তুল্য পিতৃভক্তিপরায়ণ ও অনলস ভূপতি আর কেহই ছিলেন না। ইন্দ্রের সহিত উহার সবিশেষ সখ্যভাব ছিল। ঐ মহীপাল পূৰ্ব্বে নারায়ণের বরপ্রভাবে সাম্রাজ্য অধিকার করিয়াছিলেন। উনি সর্ব্বাগ্রে সূর্য্যমুখনিঃসৃত পঞ্চরাত্ৰশাস্ত্র অবলম্বনপূর্ব্বক বিষ্ণুর অর্চ্চনা করিয়া পরিশেষে পিতৃগণের পূজা করিতেন। তৎপরে ব্রাহ্মণ ও আশ্রিতব্যক্তিদিগকে অন্নদান করিয়া স্বয়ং আহারে প্রবৃত্ত হইতেন। ঐ সত্যপরায়ণ ও দয়াবান্ ভূপতি অনাদি, অনন্ত, লোকস্রষ্টা, দেবদেব, ভগবান বিষ্ণুকে অন্তরের সহিত ভক্তিপ্রদর্শন করিতেন। দেবরাজ ইন্দ্র ঐ মহাত্মার গাঢ়তর বিষ্ণুভক্তিদর্শনে যারপরনাই প্রীত হইয়া উহার সহিত এক শয্যায় শয়ন ও এক আসনে উপবেশন করিতেন।

“রাজা উপরিচর আপনার রাজ্য, ধনসম্পত্তি, স্ত্রী ও যানবাহন প্রভৃতি সমুদয় ভোগ্যবস্তু নারায়ণপ্রসাদলব্ধ বলিয়া তাঁহাকেই সমস্ত সমৰ্পণ করিয়াছিলেন। তিনি পঞ্চরাত্ৰশাস্ত্র অবলম্বনপূর্ব্বক কাম্য ও নৈমিত্তিক যজ্ঞীয় কার্য্যসমুদয়ের অনুষ্ঠান করিতেন। তাঁহার আলয়ে পঞ্চরাত্রবিৎ প্রধান শ্রোত্রিয়েরা শাস্ত্রনির্দ্দিষ্ট ভোগ্য দ্রব্যসমুদয় প্রীতিপূৰ্ব্বক সর্ব্বাগ্রে ভোজন করিতেন। ঐ মহীপাল যখন ধর্ম্মানুসারে রাজ্যশাসন করিতেন, তৎকালে তাঁহার মুখ হইতে কদাচ মিথ্যাবাক্য বিনিঃসৃত বা মনোমধ্যে কোন অসৎ কল্পনা সমুদিত হইত না। তিনি অতি অল্পমাত্র পাপকাৰ্য্যেরও অনুষ্ঠান করিতেন না। ঐ রাজা সুরগুরু বৃহস্পতির নিকট নীতিশাস্ত্র প্রাপ্ত হইয়া তদনুসারে প্রজাপালন করিতেন। এক্ষণে ঐ নীতিশাস্ত্র যেরূপে প্রণীত হইল, তাহাও কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

ঋষিগণের শাস্ত্রপ্রণয়ন-বিবরণ

“পূৰ্ব্বে সুমেরুপৰ্ব্বতে মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরাঃ, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু ও মহাতেজাঃ বশিষ্ঠ এই সাতজন মহর্ষি অবস্থান করিতেন। ঐ সপ্তর্ষিমণ্ডল চিত্রশিখণ্ডীনামে বিখ্যাত। স্বায়ম্ভুব মনু উঁহাদিগের অষ্টম। ঐ সমস্ত একাগ্রচিত্ত, জিতেন্দ্রিয়, সংযমী, ত্রিকালজ্ঞ, সত্যধর্ম্মপরায়ণ মহর্ষি লোকসকলকে স্ব স্ব নিয়মে সংস্থাপিত করিয়া রাখিয়াছেন। উঁহারা একমতাবলম্বনপূৰ্ব্বক লোকের হিতকর বিষয়সমুদয় পর্য্যালোচনা করিয়া বেদচতুষ্টয়সম্মত এক উৎকৃষ্ট ধর্ম্মশাস্ত্র প্রস্তুত করেন। ঐ শাস্ত্রে ধৰ্ম্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের বিষয় কীৰ্ত্তিত এবং ভূলোক ও দ্যুলোকের নানাপ্রকার নিয়মপ্রণালী নির্দ্দিষ্ট আছে। ঐ সমস্ত মহর্ষি অন্যান্য তপোধনের সহিত দেবমানের সহস্র বৎসর ভগবান্ নারায়ণের আরাধনা করিয়াছিলেন। নারায়ণ তাঁহাদিগের প্রতি প্রসন্ন হইয়া দেবী সরস্বতীকে উঁহাদিগের শরীরে প্রবেশ করিবার নিমিত্ত আদেশ করাতে সরস্বতী লোকের হিতসাধনের নিমিত্ত উহাদের শরীরে প্রবেশ করেন।

“তপঃপরায়ণ ব্রাহ্মণগণ দেবী সরস্বতীর সাহায্য লাভ করিয়া সেই শব্দ, অর্থ ও হেতুগর্ভ শাস্ত্রপ্রণয়নে কৃতকার্য্য হয়েন। এই সর্ব্বোৎকৃষ্ট নীতিশাস্ত্রই সৰ্ব্বশাস্ত্রের অগ্রে প্রস্তুত হয়। মহর্ষিগণ এই ওঙ্কারস্বরসমলঙ্কৃত শাস্ত্র প্রণয়ন করিয়া সৰ্ব্বপ্রথমে পরমকারুণিক নারায়ণকে শ্রবণ করাইলেন। অচিন্ত্যদেহ ভগবান্ নারায়ণ ঐ শাস্ত্র-শ্রবণে যারপরনাই প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া অদৃশ্যভাবে সেই তপোধনগণকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, মহর্ষিগণ! তোমার এই যে লক্ষশ্লোকাত্মক উৎকৃষ্ট নীতিশাস্ত্র প্রস্তুত করিয়াছ, ইহা হইতেই সমগ্র লোকধর্ম্ম প্রবর্ত্তিত হইবে। ইহা ঋক্, যজুঃ, সাম ও অথৰ্ব্ববেদের অবিরোধী; সুতরাং ইহাই লোকের প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তিবিষয়ে সম্পূর্ণ প্রমাণস্থল হইবে। ব্রহ্মার প্রসন্নতা, রুদ্রদেবের ক্রোধ, তোমাদিগের প্রজাসৃষ্টি, সূর্য্য, চন্দ্র, বায়ু, ভূমি, সলিল, অগ্নি, নক্ষত্র ও অন্যান্য ভূতগণের স্ব স্ব অধিকারে অবস্থান এবং ব্রহ্মবাদিগণের আত্মাশ্রয় বিষয়ে যেমন কাহারই সংশয় উপস্থিত হয় না, সেইরূপ কহিতেছি, তোমাদিগের এই শাস্ত্রে কদাচ কাহারও সন্দেহ উপস্থিত হইবে না। স্বায়ম্ভুব মনু এই শাস্তুঅনুসারে ধর্ম্মকীৰ্ত্তন করিবেন। বৃহস্পতি ও শুক্র উৎপন্ন হইয়া তোমাদিগের এই নীতিশাস্ত্র অনুসারে সকলকে উপদেশ দিবেন। উঁহারা সৰ্ব্বত্র এই শাস্ত্রপ্রচারে প্রবৃত্ত হইলে রাজা উপরিচর বৃহস্পতি হইতে ইহা লাভ করিবেন। সেই রাজা সদ্ভাবসম্পন্ন ও আমার প্রতি অতিমাত্র ভক্তিপরায়ণ হইবেন। তিনি তোমাদিগের এই শাস্ত্রানুসারে সমস্ত কার্য্যানুষ্ঠান করিবেন। তোমাদিগের প্রণীত এই শাস্ত্ৰ সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ইহাতে ধৰ্ম্ম, অর্থ ও গুহ্যবিষয়সমুদয় বিশেষরূপে কীৰ্ত্তিত হইয়াছে। তোমরা এই নীতিশাস্ত্র প্রচার করিয়া পুত্রলাভ করিবে এবং রাজা উপরিচরও ইহার প্রভাবে সাতিশয় সমৃদ্ধিশালী হইবেন। উপরিচরের লোকান্তর প্রাপ্তি হইলে এই সনাতন নীতিশাস্ত্র অন্তর্হিত হইবে।’

“পুরুষোত্তম নারায়ণ এই বলিয়া সেই তপোধনগণকে বিদায় করিয়া তৎক্ষণাৎ তিরোহিত হইলেন। অনন্তর সত্যযুগে বৃহস্পতি জন্মগ্রহণ করিলে সেই মহর্ষিগণ তাঁহার হস্তে সেই বেদবেদাঙ্গমূলক নীতিশাস্ত্রের প্রচারভার সমর্পণ করিয়া তুপানুষ্ঠানার্থ অভিলষিত স্থানে প্রস্থান করিলেন।”