৩৩০. নারদ-শুক সাক্ষাৎকার—নারদের উপদেশ

৩৩০তম অধ্যায়

নারদ-শুক সাক্ষাৎকার—নারদের উপদেশ

ভীষ্ম কহিলেন, “হে মহারাজ! বেদব্যাস গমন করিলে দেবর্ষি নারদ আকাশপথ অবলম্বনপূৰ্ব্বক স্বাধ্যায়নিরত মহাত্মা শুকদেবের সমীপে পুনরায় সমুপস্থিত হইলেন। ব্যাসতনয় নারদকে দর্শন করিবামাত্র অতিমাত্র আহ্লাদিত হইয়া বেদার্থ জিজ্ঞাসা করিবার অভিপ্রায়ে বেদবিধি অনুসারে তাঁহাকে অর্ঘ্যাদি প্রদানপূর্ব্বক পূজা করিলেন। দেবর্ষি নারদ শুকের ভক্তি-দর্শনে প্রীত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে ধাৰ্ম্মিকশ্রেষ্ঠ! এক্ষণে আমি তোমার কোন্ শ্রেয়স্কর কার্য্য সম্পাদন করিব, তাহা কীৰ্ত্তন কর।’ শুকদেব কহিলেন, ‘দেবর্ষে! যদি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে ইহলোকে যাহা হিতকর, আপনি আমাকে তদ্বিষয়ে উপদেশ প্রদান করুন।’

“নারদ কহিলেন, ‘বৎস! পূৰ্ব্বকালে মহর্ষিগণ ভগবান্ সনৎকুমারের নিকট তত্ত্বকথা জিজ্ঞাসা করাতে তিনি কহিয়াছিলেন, বিদ্যার সদৃশ চক্ষুঃ, সত্য তুল্য তপস্যা, দানের ন্যায় সুখ এবং বিষয়ানুরাগের সমান দুঃখ আর কিছুই নাই। পাপকার্য্য হইতে নিবৃত্ত, পুণ্যকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান, সদাচার ও সদ্ব্যবহারই সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেয়ঃপদার্থ। এই দুঃখনিদান মনুষ্যদেহ লাভ করিয়া যিনি বিষয়ে আসক্ত হয়েন, তাহাকেই মুগ্ধ হইতে হয়; তিনি আর কখন দুঃখের হস্ত হইতে পরিত্রাণলাভে সমর্থ হয়েন না। ফলতঃ বিষয়াসক্তই দুঃখের মূল কারণ। বিষয়াসক্ত ব্যক্তির বুদ্ধি সতত বিচলিত হয় এবং সে মোহজালে জড়িত হইয়া কি ইহলোকে, কি পরলোকে উভয় লোকেই অনন্তকাল দুঃখভোগ করে। কাম ও ক্রোধ শ্ৰেয়োনাশের আদি কারণ। অতএব ঐ শত্রুকে নিগৃহীত করা অবশ্য কর্ত্তব্য। ক্রোধ হইতে তপস্যাকে, মৎসরতা হইতে আত্মশ্রীকে, মানাপমান হইতে বিদ্যাকে এবং প্রমাদ হইতে আত্মাকে রক্ষা করা সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। অনৃংশসতার সদৃশ ধৰ্ম্ম, ক্ষমার তুল্য বল, আত্মজ্ঞানের সমান জ্ঞান এবং সত্যের সমান শ্রেষ্ঠ পদার্থ আর কিছুই নাই।

‘সত্যবাক্য প্রয়োগ করা সকলেরই কর্ত্তব্য; কিন্তু যে স্থলে সত্যবাক্য প্রয়োগ করিলে লোকের অনিষ্ট হয়, সে স্থলে সত্যবাক্য পরিত্যাগপূৰ্ব্বক মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করাই উচিত। আমার মতে যে বাক্যদ্বারা জীবের সমধিক মঙ্গললাভ হয়, তাহাই সত্যবাক্য। যিনি দারপরিগ্রহ না করেন এবং আহারাদিসমুদয় কার্য্য পরিত্যাগ করেন, তিনিই যথার্থ জ্ঞানবান্ ও পণ্ডিত। যাঁহারা শান্তচিত্ত ও নির্ব্বিকার হইয়া, ইন্দ্রিয় সমুদয়কে আত্মার বশীভূত করিয়া অনাসক্তচিত্তে বিষয়ভোগ করেন, তাঁহারা অচিরাৎ মুক্ত হইয়া শ্ৰেয়োলাভে সমর্থ হয়েন। যাঁহাদিগের কোন জীবের সহিত সন্দর্শন, সংস্পর্শ ও সম্ভাষণ না থাকে, তাঁহারাই শ্ৰেয়োলাভের উপযুক্ত পাত্র। কোন প্রাণীর হিংসা করা কর্ত্তব্য নহে। সকলের সহিত মিত্রের ন্যায় ব্যবহার করা উচিত। দুর্ল্লভ জন্ম লাভ করিয়া কাহারও সহিত শত্রুতাচরণ করা বিধেয় নহে।

‘আত্মতত্ত্বজ্ঞ জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তির পক্ষে সমুদয় বিষয়ে অনৈশ্বর্য্য [তুচ্ছবোধ], নিত্যসন্তোষ, নিস্পৃহত্ব ও অচপলতাই পরমশ্রেয়ঃ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। এক্ষণে তুমি পরিগ্রহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক জিতেন্দ্রিয় হও। যাঁহাকে আশ্রয় করিলে কি ইহলোকে, কি পরলোকে কোন লোকেই শোক বা ভয়ের লেশমাত্র থাকে না, তাঁহার আশ্রয় গ্রহণ কর। লোভবিহীন ব্যক্তিরা কিছুতেই শোকযুক্ত হয়েন না, অতএব লোভ পরিত্যাগ করা সৰ্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য। যিনি তপানুষ্ঠাননিরত, দমগুণসম্পন্ন ও সংযতাত্মা হইয়া ব্ৰহ্মপদলাভের বাসনা করেন, সঙ্গ পরিত্যাগ করা তাঁহার অবশ্য কৰ্ত্তব্য। ব্রাহ্মণ বিষয়াসক্ত না হইয়া সদাচারনিষ্ঠ হইলে তাঁহাকে কখনই দুঃখভোগ করিতে হয় না। যিনি আপনার চতুর্দ্দিকে দাম্পত্যসুখ পরিতৃপ্ত অসংখ্য ব্যক্তিকে অবলোকন করিয়াও তাঁহাদের মধ্যে স্বয়ং একাকী অবস্থান করিতে সমর্থ হয়েন, তিনিই যথার্থ জ্ঞানতৃপ্ত। তাঁহাকে কদাপি শোক প্রকাশ করিতে হয় না। কৰ্ম্মবশীভূত মানবগণ শুভকার্য্যফলে দেবত্ব, শুভাশুভকার্য্যফলে মনুষ্যত্ব এবং অশুভকৰ্ম্মফলে অধোগতি লাভ করিয়া থাকে। সকল মনুষ্যই জরামৃত্যুকর্ত্তৃক সমাক্রান্ত হইয়া বিনষ্ট হইতেছে, ইহা কি তোমার বোধগম্য হইতেছে না? তুমি অহিতকে হিত, অধ্রুবকে ধ্রুব ও অনর্থকে অর্থ বলিয়া জ্ঞান করিতেছ এবং কি নিমিত্তই বা মোহবশতঃ কোষকার কীটের ন্যায় স্বীয় কর্ম্মসূত্রে বদ্ধ রহিয়াছ?

‘পরিগ্রহ বিবিধ দোষের আকর; অতএব পরিগ্রহ পরিত্যাগ করাই বিধেয়। কোষকার কীট স্বীয় মুখলালাপরিগ্রহ করিয়াই বদ্ধ হইয়া থাকে। স্ত্রী, পুত্র ও অন্যান্য পরিবারবর্গে একান্ত অনুরক্ত হইলে পঙ্কনিমগ্ন মত্ত-মাতঙ্গের ন্যায় নিতান্ত অবসন্ন হইতে হয়। মানবগণ অজ্ঞানদ্বারা জল হইতে সমুদ্ধত মৎস্যের ন্যায় স্নেহজালে জড়িত হইয়া বিবিধ দুঃখভোগ করিতেছে। স্ত্রী, পুত্র, পরিবার, শরীর ও সঞ্চিত ধনসমুদয় পরলোকে সহগামী হয় না; কেবল পুণ্যপাপ পরলোকে সহচর হইয়া থাকে। যখন তোমাকে সমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক কালের বশবর্ত্তী হইয়া গমন করিতে হইবে, তখন তুমি কি নিমিত্ত স্বকার্য্যসাধনে যত্নবান্ না হইয়া অনর্থকর বিষয়ে আসক্ত রহিয়াছ? তুমি অবলম্বন ও পাথেয় সঞ্চয় না করিয়া কিরূপে একাকী পরলোকগমনে অন্ধকারাচ্ছন্ন দুর্গমপথে গমন করিবে? তুমি পরলোকে প্রস্থান করিলে সুকৃত ও দুষ্কৃত ব্যতীত আর কেহই তোমার অনুগমন করিবে না।

‘বিদ্যা, কৰ্ম্ম, শৌচ ও বিবিধ জ্ঞানদ্বারা পরমার্থের অনুসন্ধান করিতে হয়। পরমার্থসিদ্ধ হইলেই মুক্তিলাভ হইয়া থাকে। গৃহস্থাশ্রমে অবস্থান করিতে অনুরক্ত হইলে মায়াপাশে বদ্ধ হইতে হয়, পুণ্যাত্মা ব্যক্তিরাই ঐ পাশ ছেদন করিয়া অনায়াসে মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু মূঢ়াত্মারা কোনক্রমেই উহা ছেদন করিতে পারে না। সংসারনদী অতি ভীষণ। রূপ ঐ নদীর কূল, মন উহার স্রোত, স্পর্শ উহার দ্বীপ, রস উহার প্রবাহ, গন্ধ উহার পঙ্ক এবং শব্দ উহার জলস্বরূপ। ক্ষমারূপ ক্ষেপণী[দাঁড়]সম্পন্ন, ধর্ম্মস্থৈর্য্য[ধর্ম্মে দৃঢ়তা] রূপ। আকর্ষণরজ্জুযুক্ত, দান [দানরূপ] বায়ুপরিচালিত শরীরনৌকাদ্বারা ঐ নদী পার হওয়া সৰ্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। এক্ষণে তুমি প্রথমতঃ সংকল্পপরিত্যাগদ্বারা ধৰ্ম্ম, লোভপরিত্যাগদ্বারা অধৰ্ম্ম, বুদ্ধিদ্বারা সত্যমিথ্যা এবং পরমাত্মতত্ত্বনির্ণয়দ্বারা বুদ্ধি পরিত্যাগ করিয়া পরিশেষে এই অস্থিস্নায়ুযুক্ত, মাংসশোণিতলিপ্ত, মূত্রপুরীষপরিপূর্ণ, জরাশোকসম্পন্ন, রোগের আকরস্বরূপ, অনিত্য দেহ পরিত্যাগ কর।

‘এই স্থাবরজঙ্গমাত্মক বিশ্বসংসার পঞ্চমহাভূত হইতে সমুদ্ভূত। পঞ্চমহাভূত, পাঁচ ইন্দ্রিয়, শরীরস্থ পঞ্চবায়ু এবং বুদ্ধি ও সত্ত্বাদিগুণ এই সপ্তদশকে অব্যক্ত বলিয়া কীৰ্ত্তন করা যায়। ঐ সপ্তদশ অব্যক্ত, রূপাদি পঞ্চবিষয় এবং অহিংসা ও মমতা এই চতুর্ব্বিংশতি পদার্থ তত্ত্ব বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। ঐ চতুৰ্ব্বিংশতি তত্ত্বকে ব্যক্ত ও অব্যক্ত এই উভয় নামেই নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে। জীবাত্মা এই চতুর্ব্বিংশতি তত্ত্বে সংযুক্ত হইলেই পুরুষনামে অভিহিত হইয়া থাকেন। ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গ অতি সুখকর এবং জীবন ও মৃত্যু এই উভয় নিতান্ত দুঃখাবহ। যিনি যথার্থরূপে এই সমুদয় বিষয় অবগত হইতে পারেন, নিত্য ও অনিত্য উভয় বস্তুই তাঁহার হৃদয়ঙ্গম হয়। জ্ঞেয় পদার্থসমুদয় পারম্পর্য্যক্রমেই [পর-পর ক্রমে] পরিজ্ঞাত হওয়া কর্ত্তব্য। ইন্দ্রিয়গোচর পদার্থকে ব্যক্ত এবং ইন্দ্রীয়াতীত অনুমেয় পদার্থকে অব্যক্ত বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়।

‘জ্ঞানবান ব্যক্তি ইন্দ্রিয়সংযম করিতে পারিলেই পরম পরিতৃপ্ত হইয়া আত্মাকে সৰ্ব্বলোকে পরিব্যাপ্ত ও আত্মার মধ্যে সৰ্ব্বলোক নিহিত অবলোকন করেন। তাঁহার জ্ঞান শক্তি কখনই বিনষ্ট হয় না। তিনি সেই শক্তিপ্রভাবে সৰ্ব্বদা সমুদয় জীবকে সন্দর্শন করেন। যিনি জ্ঞানবলে মোহজনিত বিবিধ ক্লেশ অতিক্রম করিতে পারেন, তাঁহাকে কখনই অশুভ সন্দর্শন করিতে হয় না এবং তিনিই স্বীয় বুদ্ধি প্রকাশদ্বারা চিরাচরিত মার্গ অতিক্রম করেন না। মোক্ষতত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিরা পরমাত্মাকে জন্মমৃত্যুবিহীন, শরীরস্থিত, নিরাকার ও নির্লিপ্ত পদার্থ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। লোকে একবার দুষ্কর্ম্মের অনুষ্ঠানপূৰ্ব্বক নিতান্ত দুঃখিত হইয়া সেই দুঃখ দূরীকৃত করিবার নিমিত্ত নানাপ্রকার জীবহিংসাদ্বারা বিবিধ যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়া থাকে। তন্নিবন্ধন তাহাকে পুনরায় বিবিধ নূতন নূতন দুষ্কর্ম্মে লিপ্ত হইয়া অপথ্যসেবী আতুরের [পীড়িতের] ন্যায় নিতান্ত ক্লেশভোগ করিতে হয়। মোহান্ধ ব্যক্তিরাই বিবিধ দুঃখকে সুখজ্ঞান করিয়া স্ব স্ব কৰ্ম্মফলে সৰ্ব্বদা নিবদ্ধ হইয়া অশেষবিধ ক্লেশ ভোগ করে। তাহাদিগকে স্ব স্ব কৰ্ম্মানুরূপ যোনিতে জন্মপরিগ্রহপূর্ব্বক সংসারমধ্যে চক্রের ন্যায় বারংবার পরিভ্রমণ করিতে হয়। অতএব তুমি সংসারবন্ধবিহীন ও কৰ্ম্ম হইতে নিবৃত্ত হইয়া সৰ্ব্বজ্ঞ, সৰ্ব্ববিজয়ী ও সিদ্ধ হও। পূৰ্ব্বকালে অনেক মহাত্মা তপোবলে সংসারবন্ধ হইতে বিমুক্ত হইয়া অনন্ত সুখসংবর্দ্ধিনী [সুখবৃদ্ধিকারিণী] সিদ্ধি লাভ করিয়া গিয়াছেন।’ ”