৩২৯. ব্যাসশিষ্যগণের বেদবিভাগ প্রস্তাব

৩২৯তম অধ্যায়

ব্যাসশিষ্যগণের বেদবিভাগ প্রস্তাব

ভীষ্ম কহিলেন, “মহাত্মা বেদব্যাস এই কথা কহিয়া তূষ্ণীম্ভাব, অবলম্বন করিলে, তাঁহার শিষ্যগণ পরমানন্দে পরস্পর আলিঙ্গন করিয়া কহিলেন, ‘গুরু উত্তরকাল বিবেচনা করিয়া আমাদিগকে যেরূপ উপদেশ প্রদান করিলেন, আমরা কখনই তাহা বিস্মৃত হইব না।’ শিষ্যগণ পরস্পর এইরূপ কৃতনিশ্চয় হইয়া পুনৰ্ব্বার বেদব্যাসকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘গুরো! যদি আপনি অনুমতি করেন, তাহা হইলে আমরা এই পর্ব্বত হইতে পৃথিবীতলে গমন করিয়া বেদসমুদয় বিবিধ প্রকারে বিভক্ত করি।’ তখন ভগবান্ ব্যাসদেব শিষ্যগণের সেই প্রার্থনা শ্রবণ করিয়া ধর্ম্মার্থযুক্ত হিতকর বাক্যে তাঁহাদিগকে কহিলেন, ‘বৎসগণ! কি ভূলোক, কি দেবলোক, তোমাদিগের যে স্থানে গমন করিতে ইচ্ছা হয়, সেই স্থানেই গমন কর; কিন্তু সর্ব্বদা সাবধান হইয়া কালযাপন করিবে। অতি অল্পকালমাত্র আলোচনা না করিলেই বেদশাস্ত্র স্মৃতিপথ হইতে বহির্গত হইয়া যায়।’

‘মহাত্মা বেদব্যাস এই কথা কহিলে, ‘তাঁহার শিষ্যগণ তাঁহাকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করিয়া অবনীতলে অবতীর্ণ হইলেন এবং অচিরাৎ গার্হস্থ্যধৰ্ম্মে নিরত হইয়া যজ্ঞানুষ্ঠান, অধ্যাপন এবং ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যগণের পৌরোহিত্যদ্বারা জনসমাজে বিখ্যাত ও দ্বিজাতিগণকর্ত্তৃক পূজিত হইয়া পরম সুখে কালাতিপাত করিতে লাগিলেন।

“শিষ্যগণ প্রস্থান করিলে ভগবান বেদব্যাস স্বীয় পুত্র শুকদেবের সহিত নিতান্ত চিন্তাকুল হইয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন পূৰ্ব্বক অবস্থান করিতে লাগিলেন। ঐ সময় তপোধনাগ্রগণ্য দেবর্ষি নারদ তাঁহার আশ্রমে আগমনপুৰ্ব্বক মধুরবাক্যে তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘মহর্ষে! আপনি বেদপাঠে বিরত হইয়া চিন্তাকুলের ন্যায় কি নিমিত্ত মৌনভাবে কালযাপন করিতেছেন? এই পর্ব্বত, বেদধ্বনিবিহীন হইয়া রাহুগ্রস্ত চন্দ্রের ন্যায় নিতান্ত শোভাশূন্য হইয়াছে। এই পৰ্ব্বতে দেবর্ষি, মহর্ষি, দেবতা ও গন্ধৰ্ব্বগণ বাস করিতেছেন বটে; কিন্তু বেদধ্বনি না থাকাতে ইহা ব্যাধমন্দিরের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে।’ দেবর্ষি নারদ এই কথা কহিলে মহর্ষি বেদব্যাস তাঁহাকে কহিলেন, ‘মহাত্মন! আপনি সৰ্ব্বদর্শী, সৰ্ব্বজ্ঞ, সর্ব্ববিষয়ে কৌতূহলসম্পন্ন। আপনি আমার প্রতি আমার অনুকূলবাক্যই প্রয়োগ করিতেছেন। ত্রিলোকমধ্যে যে সমস্ত ঘটনা হইয়াছে, তন্মধ্যে আপনার অবিদিত কিছুই নাই। এক্ষণে শিষ্যগণকে না দেখিয়া আমার মন অস্থির হইয়াছে। এই নিমিত্তই আমি মৌনভাবে অবস্থান করিতেছি। যাহা হউক, অতঃপর আপনি আমাকে যে কার্য্য করিতে আজ্ঞা করিবেন, আমি তাহাই করিতে প্রস্তুত আছি।’

“নারদ কহিলেন, ‘মহর্ষে! পণ্ডিতেরা অনাবৃত্তিকে [আবৃত্তি করিয়া মুখস্থ না করাকে] বেদের, অব্রতকে ব্রাহ্মণের, বাহ্লীকজাতিকে পৃথিবীর ও কৌতূহলকে স্ত্রীগণের কলঙ্ক বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। অতএব আপনি পুত্রের সহিত সমবেত হইয়া বেদ-নিনাদদ্বারা নিশাচরভয়জনিত [নিয়মনিষ্ঠাদি পরিত্যাগকে] মোহ নিরাকৃত করুন।

বায়ুর উৎপত্তি ও কার্য্যবিবরণ

‘মহাত্মা নারদ এইরূপ উপদেশ প্রদান করিলে, ধর্ম্মপরায়ণ মহর্ষি বেদব্যাস তাঁহার আজ্ঞা গ্রহণপূৰ্ব্বক পুত্রের সহিত উচ্চৈঃস্বরে বেদপাঠে প্রবৃত্ত হইয়া লোকসমুদয় প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিলেন। একদা তাঁহারা পিতাপুত্রে বেদ অভ্যাস করিতেছেন, এমন সময় সহসা শব্দায়মান প্রচণ্ড বায়ু প্রবাহিত হইতে লাগিল। তদ্দর্শনে মহাত্মা বেদব্যাস অনধ্যায়কাল উপস্থিত হইয়াছে বিবেচনা করিয়া পুত্রকে বেদপাঠ করিতে নিবারণ করিলেন। শুকদেব নিবারিত হইবামাত্র বেদপাঠে বিরত হইয়া পিতাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘মহাশয়! বায়ু কোথা হইতে উৎপন্ন হইল এবং উহার কার্য্য কিরূপ, আপনি তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।’

“মহর্ষি বেদব্যাস অনধ্যায়কালে বালক পুত্রের সেই বিজ্ঞানসম্পৰ্কীয় প্রশ্ন শ্রবণে নিতান্ত বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিলেন, ‘বৎস! তোমার দিব্যজ্ঞান উপস্থিত ও মন নিশ্চল হইয়াছে এবং তুমি রজঃ ও তমোগুণ হইতে সম্পূর্ণরূপে বিমুক্ত হইয়াছ। যেমন আদর্শে [আয়নায়] স্বীয় প্রতিবিম্ব দেখিতে পাওয়া যায়, তদ্রূপ তুমি আত্মাতেই আত্মাকে দর্শন করিতেছ। এক্ষণে স্বীয় বুদ্ধিপ্রভাবে বেদসমুদয় বিচার করিয়া এই বিষয়ের চিন্তা কর, তাহা হইলেই অবগত হইতে পারিবে। পণ্ডিতেরা সৰ্ব্বব্যাপী পরমাত্মার পথকে দেবযান ও তমোগুণসম্ভূত পথকেই পিতৃযান বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। দেহান্তে যাঁহারা দেবযানে আরোহণ করেন, তাঁহাদের অতি উৎকৃষ্ট গতিলাভ হইয়া থাকে, আর যাঁহারা পিতৃযানে আরোহণ করেন, তাঁহাদিগকে বারংবার অধঃপতিত হইতে হয়। পৃথিবী ও অন্তরীক্ষে যে সাত বায়ু ভিন্ন ভিন্ন গতিতে নিরন্তর বিচরণ করিতেছে, এক্ষণে তাহাদিগের বিষয় আনুপূৰ্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পণ্ডিতেরা দুর্জ্জয় সমান বায়ুকে ইন্দ্রিয়গণের, উদান-বায়ুকে সমানের, ব্যান-বায়ুকে উদানের, অপান-বায়ুকে ব্যানের এবং প্রাণ-বায়ুকে অপানের পুত্র বলিয়া থাকেন। দুর্দ্ধর্ষ প্রাণ-বায়ু অনপত্য [নিঃসন্তান]। সমান, উদান, ব্যান, অপান ও প্রাণ এই পাঁচটি বায়ুর অপর পাঁচটি নাম সংবহ, উদ্বহ, বিবহ, আবহ ও প্রবহ। এতদ্ভিন্ন পরিবহ ও পরাবহ নামে আর দুইটি বায়ু আছে।

“অতঃপর ঐ সাত বায়ুর পৃথক পৃথক কার্য্য সমুদয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। প্রবহনামক প্রথম বায়ু ধূমজ ও উষ্মজ [গরম হইতে জাত] মেঘজালকে সঞ্চালনপূর্ব্বক আকাশপথে বিদ্যুদগ্নি [অগ্নিময় বিদ্যুৎ] হইয়া অতুল তেজঃ ধারণ করে। ঐ বায়ু প্রাণীগণের শরীরস্থ সমুদয় চেষ্টা সম্পাদন করে বলিয়া প্রাণ নামে অভিহিত হয়। অবহ নামে দ্বিতীয় বায়ু ভীষণ গর্জ্জনপূর্ব্বক প্রবাহিত হইয়া নিরন্তর চন্দ্র প্রভৃতি জ্যোতিষ্কদিগের উদরক্রিয়া সম্পাদন করে। উহার অপর নাম অপান। উদ্বাহু নামক বেগবান্ তৃতীয় বায়ু চারি সমুদ্র হইতে সলিল গ্রহণপূৰ্ব্বক মেঘগণকে প্রদান করিয়া সেই মেঘসমুদয়কে বৃষ্টির অধিষ্ঠাত্রী দেবতার নিকট সমর্পণ করে। উহার আর একটি নাম উদান। সংবহ নামক চতুর্থ বায়ু মেঘসমুদয়কে পৃথক পৃথকরূপে সঞ্চালন ও আকাশমার্গে প্রাণীগণের বিমান বহন করে। মেঘমণ্ডল ঐ বায়ুর প্রভাবেই কখন বারিবর্ষণ ও কখন বা ঘনীভূত হইয়া জলবর্ষণ করিবার নিমিত্ত অবস্থান করিয়া থাকে। উহার অপর নাম সমান। বিবহ নামক পঞ্চম বায়ু প্রচণ্ডবেগে বৃক্ষসমুদয় উৎপাটিত এবং প্রলয়কালীন মেঘ ও ধূমকেতু প্রভৃতি লোকনাশসূচক বিবিধ উৎপাত উৎপাদিত করিয়া থাকে। উহার অপর নাম ব্যান। পরিবহ নামক যষ্ঠ বায়ু আকাশগঙ্গা মন্দাকিনীর জল অবষ্টম্ভন[স্তম্ভিত] করিয়া রাখিয়াছে। সেই নিমিত্ত ঐ জল ভূতলে নিপতিত না হইয়া আকাশমার্গেই বিচরণ করে। ঐ বায়ুর প্রভাবে জগৎপ্রকাশক সহস্রাংশু সূর্য্য একরশ্মির [বহুশাখায় প্রস্ফুরিত সূর্য্যকিরণ] ন্যায় লক্ষিত হইয়া থাকেন। ঐ বায়ু পরিক্ষীণ হইয়া চন্দ্রমণ্ডলকে প্রতিদিন পরিবর্ত্তিত করে। পরাবহ নামক দুর্নিবার্য্য সপ্তম বায়ু অন্তকালে প্রাণীগণের প্রাণ সংহার করে। মৃত্যু ও যম উহার অনুসরণ করিয়া থাকেন। বিশুদ্ধ বুদ্ধি দ্বারা উহাকে দর্শন করা অধ্যাত্মচিন্তাপরায়ণ পণ্ডিতদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। ঐ বায়ু ধ্যানস্থ মহাত্মাদিগের নিকট অমৃতরূপে পরিণত হয়। দক্ষ প্রজাপতির দশ সহস্র পুত্র ঐ বায়ুর বল আশ্রয় করিয়া ব্রহ্মাণ্ড ভেদপূৰ্ব্বক গমন করিয়াছিলেন। ঐ বায়ুকে স্পর্শ করিতে পারিলে আর সংসারসাগরে নিপতিত হইতে হয় না।

“এই অদ্ভুত সপ্তবায়ু দিতির পুত্র; ইহারা নিরন্তর সর্ব্বত্র প্রবাহিত হইয়া থাকে। দেখ, সেই সাত বায়ুর প্রভাবে এই ভূধরশ্রেষ্ঠ হিমাচল পর্য্যন্ত কম্পিত হইতেছে। যখন ঐ সমুদয় বায়ু বিষ্ণুর নিশ্বাসবায়ু দ্বারা প্রচণ্ডবেগে সঞ্চালিত হয়, তখন সমুদয় জগৎ এককালে ব্যথিত হইয়া উঠে। বায়ু ভীষণবেগে প্রবাহিত হইলে, ব্রহ্মবিদ পণ্ডিতেরা বেদাধ্যয়নে বিরত হয়েন। ঐ সময় বেদাধ্যয়ন করিলে বেদ নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া থাকে।’ ব্যাসদেব পুত্রকে ইহা কহিয়া বায়ুবেগ-নিবৃত্তির পর তাহাকে বেদাধ্যয়ন করিতে অনুমতি প্রদানপূর্ব্বক মন্দাকিনীতীরে প্রস্থান করিলেন।”