৩২৭তম অধ্যায়
শুককর্ত্তৃক পিতার অভিপ্রায় জ্ঞাপন
ভীষ্ম কহিলেন, “পরদিন প্রাতঃকালে রাজর্ষি জনক স্বয়ং মস্তকে অর্ঘ্য গ্রহণপূৰ্ব্বক অমাত্য ও অন্তঃপুরিকাগণ সমভিব্যাহারে গুরুপুত্র শুকদেবের সমীপে যাত্রা করিলেন। তাঁহার পুরোহিত উৎকৃষ্ট আস্তরণে সমাস্তৃত আসন ও বিবিধ রত্নগ্রহণপূৰ্ব্বক তাঁহার অগ্রে, অগ্রে গমন করিতে লাগিলেন। অনন্তর সকলে তথায় উপস্থিত হইলে মহারাজ জনক পুরোহিতের নিকট হইতে সেই সৰ্ব্বোৎকৃষ্ট আসন গ্রহণপূৰ্ব্বক মহাত্মা শুকদেবকে প্রদান করিলেন এবং তিনি সেই আসনে উপবিষ্ট হইলে তাঁহাকে পাদ্য, অর্ঘ্য ও গোদানপূর্ব্বক শাস্ত্রানুসারে তাঁহার যথোচিত সৎকার করিতে লাগিলেন। তখন তেজঃপুঞ্জকলেবর মহাত্মা শুকদেব যথাবিধি জনকের পুজাগ্রহণপুৰ্ব্বক তাঁহাকে যথোচিত সম্মান ও তাঁহার কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসা করিয়া উপবেশন করিতে অনুমতি করিলেন। রাজর্ষি জনক গুরুপুত্রের আজ্ঞাক্রমে অনুচরবর্গের সহিত ভূতলে উপবেশনপূৰ্ব্বক তাঁহাকে, কৃতাঞ্জলিপুটে আপনার কুশল সমাচার নিবেদন করিয়া কহিলেন, ‘ভগবন্! আপনার আগমনের কারণ পরিজ্ঞাত হইতে নিতান্ত বাসনা হইয়াছে, আপনি উহা আমার নিকট ব্যক্ত করুন।’
“তখন মহাত্মা শুকদেব তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘মহারাজ! আমার পিতা বেদব্যাস আমাকে কহিয়াছেন, “বৎস! প্রবৃত্তিমার্গে যদি তোমার সংশয় থাকে, তাহা হইলে তুমি আমার যজমান মোক্ষধৰ্ম্মবিশারদ বিদেহরাজ জনকের নিকট গমন কর। তিনি তোমার সমুদয় সংশয় ছেদন করিয়া দিবেন।” আমি পিতার আদেশানুসারে সংশয়নাশের নিমিত্ত আপনার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। ইহলোকে ব্রাহ্মণের কৰ্ত্তব্য কি? মোক্ষতত্ত্ব কিরূপ এবং জ্ঞান ও তপস্যা এই দুইটির মধ্যে কোন্ উপায়দ্বারা মোক্ষলাভে সমর্থ হওয়া যায়, এই সমুদয় বিষয় আমার অপরিজ্ঞাত রহিয়াছে; অতএব আপনি অনুগ্রহ করিয়া ঐ সমুদয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।’
শুকের প্রতি রাজর্ষি জনকের যোগ-উপদেশ
“জনক কহিলেন, ‘ভগবন্! ব্রাহ্মণের জন্মাবধি যে যে কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। উপনয়নের পর বেদাধ্যয়ন, তপস্যা, অসূয়া-পরিত্যাগ, গুরুর প্রতি ভক্তি প্রদর্শন এবং ব্রহ্মচর্য্য দ্বারা দেবঋণ ও পুত্রোৎপাদন দ্বারা পিতৃঋণ পরিশোধ করা ব্রাহ্মণগণের অবশ্য কর্ত্তব্য। তাহারা প্রথমতঃ গুরুগৃহে বেদাধ্যয়ন করিয়া গুরুকে দক্ষিণা প্রদান ও তাহার অনুজ্ঞা গ্রহণপূর্ব্বক তথা হইতে প্রত্যাগত হইবেন। তৎপরে গাৰ্হস্থ্যাশ্রম অবলম্বনপূর্ব্বক অসুয়াবিহীন, আহিতাগ্নি, স্বারনিরত হইয়া পুত্রোৎপাদন করিবেন। তদনন্তর বনবাসী হইয়া শাস্ত্রানুসারে প্রতিনিয়ত অতিথিদিগের সৎকার ও হোমকার্য্যে নিরত থাকিবেন এবং পরিশেষে ক্রমে ক্রমে বিষয়রাগবিহীন ও সুখদুঃখপরিবর্জ্জিত হইয়া জীবাত্মাতে অগ্নিসংস্থাপনপূর্ব্বক সন্ন্যাসধৰ্ম্ম আশ্রয় করিবেন।’
“শুকদেব কহিলেন, ‘মহারাজ! যদি ব্রহ্মচর্য্যগ্রহণের পূৰ্ব্বেই হৃদয়ে মোক্ষধৰ্ম্মের মূল সনাতনজ্ঞান ও অনুভব উৎপন্ন হয়, তাহা হইলেও কি ব্রহ্মচর্য্যাদি আশ্রমত্রয়ে বাস করা কর্ত্তব্য?’
“জনক কহিলেন, ‘ভগবন্! যেমন জ্ঞান ও বিজ্ঞান ব্যতীত মোক্ষলাভ হয় না, তদ্রূপ গুরুসম্বন্ধ ভিন্ন কখনই জ্ঞানলাভের সম্ভাবনা নাই। পণ্ডিতেরা আচার্য্যকে সংসারসাগরের কর্ণধার ও জ্ঞানকে প্লবস্বরূপ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। অতএব গুরুর নিকট জ্ঞানলাভপূৰ্ব্বক সংসারসাগর হইতে উত্তীর্ণ হইয়া পরিশেষে জ্ঞান ও গুরু উভয়কেই পরিত্যাগ করা মনুষ্যের কর্ত্তব্য। পূর্ধ্বতন পণ্ডিতগণ লোকসমুদয়ের ধর্ম্মশিক্ষা ও কর্ম্মকাণ্ডের অনুচ্ছেদের নিমিত্ত ব্রহ্মচর্য্যাদি আশ্রমচতুষ্টয়ের ধৰ্ম্ম সংস্থাপন করিয়া গিয়াছেন। মনুষ্য সেই নিয়মানুসারে ধর্ম্মানুষ্ঠান করিয়া বহু জন্মের পর কর্ম্মের শুভাশুভ ফল পরিত্যাগপূৰ্ব্বক মোক্ষলাভ করিতে পারে। যে ব্যক্তি বহু জন্মের সাধনদ্বারা ইন্দ্রিয়সমুদয় বশীভূত ও বুদ্ধিকে পরিশোধিত করিতে পারেন, তাঁহার ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমেই মোক্ষলাভ হইয়া থাকে। ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমে মোক্ষলাভ করিতে পারিলে গার্হস্থ্যাদি আশ্রমগ্রহণের কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। সৰ্ব্বদা রজঃ ও তমোগুণ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সত্ত্বগুণসম্পন্ন হইয়া পরমাত্মাতে জীবাত্মাকে নিবেশিত করা অবশ্য কর্ত্তব্য।
‘জলচর যেমন সলিলে অবস্থান করিয়াও উহাতে লিপ্ত হয় না, তদ্রূপ মনুষ্য সমুদয় প্রাণীতে আপনাকে ও আপনাতে সমুদয় প্রাণীকে অবস্থিত দেখিয়াও নির্লিপ্তভাবে কালযাপন করিবে। যে মহাত্মা ইহলোকে সুখদুঃখপরিত্যাগী ও দেহ হইতে বিমুক্ত হইয়া শান্তিলাভ করিতে পারেন, তিনি পরলোকে পক্ষীর ন্যায় ঊর্ধ্বগামী হইয়া অনন্তসুখ অনুভব করিয়া থাকেন। মহারাজ যযাতি যেরূপ মোক্ষবিষয়ক বাক্য কহিয়াছেন, মোক্ষবিশারদ ব্রাহ্মণগণ যাহা সবিশেষ অবগত আছেন, আপনার নিকট সেই কথা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। সমাহিতচিত্ত মহাত্মারাই আত্মবুদ্ধিতে সমুদয় প্রাণীর অন্তর্গত একমাত্র পরমাত্মাকে দর্শন করিতে পারেন। মনুষ্য যখন অন্যকে ভয়-প্রদর্শন অথবা অন্য হইতে আপনার ভয়ের আশঙ্কা না করিয়া কামনা ও দ্বেষ এককালে পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হয়, যখন কায়মনোবাক্যে প্রাণীগণের কোন অনিষ্টাচরণ না করে, যখন কাম, ক্রোধ ও মোহকারিণী ঈর্ষা পরিত্যাগ করিয়া মনের সহিত জীবাত্মাকে সংযোজিত করিতে পারে, যখন প্রিয় ও অপ্রিয় কথা শ্রবণ এবং প্রিয় বা অপ্রিয় বস্তুদর্শনে কিছুমাত্র আহ্লাদিত বা শোকান্বিত না হয় এবং যখন স্তুতি, নিন্দা, কাঞ্চন, লৌহ, সুখ, দুঃখ, শীত, গ্রীষ্ম, অর্থ, অনর্থ, প্রিয়, অপ্রিয় ও জীবন-মরণ সমান বলিয়া জ্ঞান করে, তখনই তাহার পরমার্থ ব্রহ্মপদার্থলাভ হইয়া থাকে। কূৰ্ম্ম যেমন আপনার অঙ্গ-সমুদয় প্রসারিত করিয়া পুনৰ্ব্বার সঙ্কুচিত করে, তদ্রূপ সন্ন্যাসী মন ও ইন্দ্রিয়সমুদয়কে সঙ্কুচিত করিবে। যেমন দীপদ্বারা অন্ধকারাবৃত গৃহ প্রকাশিত হয়, তদ্রূপ জ্ঞানদ্বারা পরমাত্মা লক্ষিত হইয়া থাকেন।
‘হে ব্ৰহ্মন্! আমি এক্ষণে মোক্ষোপযোগী যে যে কৰ্ম্মগুণ কীৰ্ত্তন করিলাম, তৎসমুদয় আপনি পরিজ্ঞাত আছেন। গুরু বেদব্যাসের প্রসাদে আমার দিব্যজ্ঞান জন্মিয়াছে। আমি সেই জ্ঞানবলে আপনার আগমন-বৃত্তান্ত ও আপনাকে পরিজ্ঞাত হইয়াছি। আপনি সমধিক বিজ্ঞান, উৎকৃষ্ট গতি ও অণিমাদি ঐশ্বর্য্যসম্পন্ন হইয়াও আপনার প্রভাব অবগত হইতে অসমর্থ রহিয়াছেন। বিজ্ঞান উৎপন্ন হইলেও বালকত্ব, সংশয় বা ভয়প্রযুক্ত আপনার পরমগতি লাভ হইতেছে না। মোক্ষলাভার্থী ব্যক্তিগণ মাদৃশ ব্যক্তি কর্ত্তৃক ছিন্নসংশয় হইয়া দেহাভিমান পরিত্যাগপূর্ব্বক বিশুদ্ধ আচারদ্বারা পরম গতি লাভ করিতে পারেন। আপনি বিজ্ঞানসম্পন্ন, স্থিরবুদ্ধি ও লোভবিহীন হইয়াছেন; কেবল অনুষ্ঠানের অভাববশতঃ আপনার ব্রহ্মপদার্থ লাভ হইতেছে না। সুখ, দুঃখ, লোভ, নৃত্যগীতে অনুরাগ, বন্ধুস্নেহ, শত্রুভয় ও ভেদবুদ্ধি আপনার অন্তর হইতে একেবারে তিরোহিত হইয়া গিয়াছে, তাহা আমার ও অন্যান্য মনীষিগণের বিশেষরূপে হৃদয়ঙ্গম হইয়াছে। ব্রাহ্মণের কৰ্ত্তব্য ও মোক্ষতত্ত্ব বিষয়ে আপনার কিছুই অবিদিত নাই। এক্ষণে অন্য যাহা শ্রবণ করিতে অভিলাষ থাকে, তাহা ব্যক্ত করুন।”