৩২৪তম অধ্যায়
শুকের জন্মবৃত্তান্ত—যোগসিদ্ধি প্রশ্ন
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! মহাতপস্বী ধৰ্ম্মাত্মা শুকদেবের মাহাত্ম শ্রবণ করিয়া আমার তৃপ্তিলাভ হয় নাই, অতএব উনি কিরূপে জন্মপরিগ্রহ এবং কিরূপেই বা সিদ্ধি লাভ করিলেন? উহার জননী কে? আর এই ভূমণ্ডলমধ্যে শৈশবাবস্থায় কোন ব্যক্তিই যে জ্ঞান লাভ করিতে পারে নাই, উনি বাল্যকালে কিরূপে তাদৃশ সূক্ষ্মজ্ঞান লাভ করিলেন? এই সমুদয় সবিস্তর শ্রবণ করিতে আমার একান্ত অভিলাষ জন্মিয়াছে; অতএব আপনি আনুপূৰ্ব্বিক ঐ সমুদয় বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! বয়স, পলিত, ধন বা বন্ধুবান্ধবদ্বারা মহর্ষিদিগের মাহাত্মলাভ হয় না, বেদাধ্যয়নদ্বারা তাঁহাদিগের মহত্ত্ব লাভ হইয়া থাকে। তুমি আমাকে শুকের জন্ম প্রভৃতি যে সমুদয় বিষয় জিজ্ঞাসা করিলে, তপস্যাই ঐ সমুদয়ের মূল কারণ। ইন্দ্রিয়সংযম ব্যতীত তপানুষ্ঠান হইবার সম্ভাবনা নাই। মানবগণ ইন্দ্রিয়সংযমনিবন্ধন বিবিধ দোষ সমাক্রান্ত হয়, সুতরাং ইন্দ্রিয়সংযম করিতে পারিলেই সিদ্ধিলাভের বিলক্ষণ সম্ভাবনা। যোগাভ্যাস করিলে যেরূপ ফললাভ হয়, সহস্র অশ্বমেধ বা শত বাজপেয়যজ্ঞের অনুষ্ঠানদ্বারা তাহার একাংশও লাভ হয় না। যাহা হউক, এক্ষণে আমি মহাত্মা শুকদেবের জন্ম, যোগফল ও সঙ্গতি কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
সৎপুত্রলাভার্থ ব্যাসের তপস্যা—বরলাভ
“পূৰ্ব্বকালে ভগবান ভূতনাথ ভূতগণে পরিবেষ্টিত হইয়া শৈলরাজদুহিতা পার্ব্বতীর সহিত কর্ণিকারবনপরিপূর্ণ সুমেরুশৃঙ্গে বাস. করিয়াছিলেন। মহর্ষি, রাজর্ষি, লোকপাল, সাধ্য, বসু, আদিত্য, রুদ্র, বায়ু, সরিৎ, সাগর, দেবতা, গন্ধৰ্ব্ব, সিদ্ধ ও অপ্সরাগণ এবং দিবাকর, নিশাকর, ইন্দ্র, নারদ, পর্ব্বত, বিশ্বাবসু ও অশ্বিনীকুমার ইঁহারা সকলে তাঁহার আরাধনায় নিযুক্ত ছিলেন। ঐ পৰ্ব্বতে তিনি বিচিত্র কর্ণিকার-মালা ধারণ করিয়া জ্যোৎস্নাপরিশোভিত নিশাকরের ন্যায় শোভমান হইয়াছিলেন। ঐ সময় যোগধর্ম্মপরায়ণ মহর্ষি বেদব্যাস সেই অসাধুজনদুর্ল্লভ ভগবানের সন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া তাঁহার প্রসাদে অগ্নি, বায়ু, জল, ভূমি ও আকাশের গুণসম্পন্ন পুত্ৰ লাভ করিবার বাসনায় ইন্দ্রিয়সমুদয় রুদ্ধ করিয়া বায়ুভক্ষণপূৰ্ব্বক ঘোরতর তপস্যা করিতে লাগিলেন। ঐরূপে দেবদেবের আরাধনা করিতে করিতে তাঁহার এক শত বর্ষ অতীত হইল; কিন্তু তথাপি তাঁহার বলের হ্রাস বা কোন প্রকার গ্লানি উপস্থিত হইল না। তদ্দর্শনে একেবারে ত্রিলোক চমকৃত হইয়া উঠিল। ঐ সময় তাঁহার জটাভার প্রজ্বলিত অগ্নিশিখার ন্যায় লক্ষিত হইতে লাগিল। ঐ তপঃপ্রভাবেই অদ্যাপি তাঁহার কেশকলাপ অনলশিখার ন্যায় বিরাজিত রহিয়াছে।
“অনন্তর ভগবান্ মহেশ্বর বেদব্যাসের সেই দৃঢ়তর ভক্তি ও কঠোর তপানুষ্ঠান দর্শনে সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া সহাস্যবদনে তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “দ্বৈপায়ন! তুমি অচিরাৎ অগ্নি, বায়ু, ভূমি, সলিল ও আকাশের ন্যায় বিশুদ্ধ পুত্ৰ লাভ করিবে। ঐ পুত্র ব্রহ্মপরায়ণ হইয়া মন, প্রাণ ও বুদ্ধি সমুদয়ই তাঁহাতে সমর্পণ করিবে। তাহার যশঃসৌরভে ত্রিলোক পরিপূর্ণ হইবে।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! আমি ভগবান্ মার্কণ্ডেয়ের নিকট এই বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়াছি, তিনি সর্ব্বদাই আমার নিকট দেবচরিতসকল কীৰ্ত্তন করিতেন।”