৩২২. শুকের প্রতি ব্যাসের জ্ঞান উপদেশ

৩২২তম অধ্যায়

শুকের প্রতি ব্যাসের জ্ঞান উপদেশ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! পূর্ব্বে বেদব্যাসতনয় শুকদেব কিরূপে বৈরাগ্য লাভ করিয়াছিলেন? কার্য্যকারণ, বুদ্ধি ও ব্রহ্মের যথার্থ তত্ত্ব কি এবং ভগবান্ নারায়ণের লীলাই বা কিরূপ? তৎসমুদয় শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত কৌতূহল হইয়াছে; আপনি আমার নিকট ঐ সমুদয় কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! পূৰ্ব্বে মহর্ষি বেদব্যাস স্বীয় পুত্র শুকদেবকে সামান্য লোকের ন্যায় অকুতোভয়ে পরিভ্রমণ করিতে দেখিয়া তাঁহাকে সমুদয় বেদবেদাঙ্গ অধ্যয়ন করাইয়া কহিয়াছিলেন, বৎস! তুমি জিতেন্দ্রিয় হইয়া সুতীক্ষ্ণ হিমাতপ [শিশির ও রৌদ্র], বায়ু ও ক্ষুৎপিপাসাপরাজয়পূৰ্ব্বক ধৰ্ম্মের আলোচনা, বিধিপূৰ্ব্বক সত্য, সরলতা, অক্রোধ, অনসূয়া, দম, তপস্যা, অহিংসা ও অনৃশংসতাদি সদ্‌গুণসমুদয় প্রতিপালন এবং সত্য ও ধৰ্ম্মে অনুরক্ত হইয়া দেবতা ও অতিথিদিগের প্রসাদলব্ধ ভক্ষ্যদ্বারা প্রাণযাত্রা নির্ব্বাহ কর। দেহ ফেনের ন্যায় ক্ষণভঙ্গুর; জীবাত্মা তথায় বৃক্ষস্থিত পক্ষীর ন্যায় নির্লিপ্তভাবে অবস্থান করিতেছেন এবং প্রিয়সহবাস কখনই চিরস্থায়ী হইবার নহে; অতএব তুমি কি নিমিত্ত পুরুষার্থসাধনে প্রবৃত্ত হইতেছ না? কামাদিরিপুসমুদয় সৰ্ব্বদা অপ্রমত্ত, জাগরিত ও উদ্বেগশীল হইয়া ছিদ্র অন্বেষণ করিতেছে। তুমি বালকত্ব প্রযুক্ত উহা বুঝিতে পরিতেছ না। দিনসমুদয় বিগত ও প্রতিদিন পরমায়ু পরিক্ষীণ হইতেছে, তথাপি তুমি কি নিমিত্ত দেবতা বা গুরুর শরণাপন্ন হইতেছ না?

‘নাস্তিকেরাই ইহলোকে মাংসশোণিতবর্দ্ধনে মনঃসংযোগ পূৰ্ব্বক পারলৌকিক কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করে। যাহারা নিতান্ত মূঢ় ও ধৰ্ম্মদেষ্টা, তাহাদের সহবাস করিলেও যারপরনাই ক্লেশ ভোগ করিতে হয়। অতএব তুমি ধৰ্ম্মপথারূঢ়, নিত্যসন্তুষ্ট, বেদজ্ঞ, বৃদ্ধ মহাত্মাদিগের উপাসনা করিয়া তাঁহাদিগের নিকট ধর্ম্মোপদেশ গ্রহণপূৰ্ব্বক উৎকৃষ্ট বুদ্ধিবলে আপনার কুপথগামী চিত্তকে শাসন কর। যাহারা কেবল বর্ত্তমানদর্শিনী বুদ্ধি অবলম্বন করিয়া পরদিনের চিন্তা পরিত্যাগ করে, খাদ্যাখাদ্য বিষয়ে যাহাদের কিছুমাত্র বিবেচনা নাই, সেই হতভাগ্য নাস্তিকেরাই এই ভারতবর্ষকে কর্ম্মভূমি বলিয়া অবগত হইতে পারে না। অতঃপর ধৰ্ম্মসোপান অবলম্বনপূৰ্ব্বক ক্রমে ক্রমে উহাতে আরোহণ করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। এক্ষণে তুমি জ্ঞানবিহীন হইয়া ধৰ্ম্মসোপান অবলম্বনপূর্ব্বৰ্ক ক্রমে ক্রমে উহাতে আরোহণ কর। কোষকার কীটের ন্যায় আপনি আপনাকে বৃদ্ করিয়া অবস্থান করিতেছ; অচিরাৎ কুলান্তক নিয়মহীন নাস্তিকদিগকে বেণুর ন্যায় উদ্ধত ও অশ্রদ্ধেয় জ্ঞান করিয়া পরিত্যাগ করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য।

‘তুমি যোগময় পোত প্রস্তুত করিয়া তদ্বারা পাঁচ ইন্দ্রিয়রূপ সলিলে সমাকীর্ণ কামক্রোধাদিরূপ জলজন্তুসঙ্কুল ও জন্মরূপ বিষম দুর্গসংযুক্ত সংসারনদী উত্তীর্ণ হও। প্রতিদিনই লোকের আয়ুঃক্ষয় হইতেছে এবং লোকসমুদয় নিরন্তর জরা-মৃত্যুতে সমাক্রান্ত হইতেছে, অতএব ধৰ্ম্মপোত আশ্রয় করিয়া সংসারসাগর উত্তীর্ণ হওয়া তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। মৃত্যু যখন কি শয়ান, কি উপবিষ্ট সকলকেই অন্বেষণ করিতেছে, তখন সকলেই অকস্মাৎ মৃত্যুগ্রাসে পতিত হইতে পারে; অতএব মনুষ্যের নিবৃতিসম্ভাবনা কোথায়? বৃকী যেমন, মেষ লইয়া পলায়ন করে, তদ্রূপ মৃত্যু অর্থসঞ্চয়নিরত কামাসক্তচিত্ত ব্যক্তিদিগকে গ্রহণপূর্ব্বক প্রস্থান করিয়া থাকে। অতএব তুমি যত্নপূর্ব্বক ধৰ্ম্মবুদ্ধিময় জ্ঞানদীপ ধারণ কর। নতুবা তোমাকে অচিরাৎ অন্ধকারময় সংসারে প্রবিষ্ট হইয়া কষ্টভোগ করিতে হইবে।

‘প্রাণীগণ অসংখ্য যযানিতে ভ্রমণ করিয়া পরিশেষে অতিকষ্টে ব্রাহ্মণ-যোনি লাভ করে। তুমি এক্ষণে সেই দুর্ল্লভ ব্রাহ্মণযোনিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছ, অতএব তদনুরূপ কার্য্য করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। ব্রাহ্মণগণ বিষয়বাসনা চরিতার্থ করিবার নিমিত্ত দেহ ধারণ করেন না। তাঁহারা ইহলোকে ক্লেশকর তপস্যার অনুষ্ঠান করিয়া পরলোকে অনন্তসুখ অনুভব করিয়া থাকেন। জন্মান্তরীণ বিবিধ তপানুষ্ঠানদ্বারা ব্রাহ্মণ্য লাভ করিয়া বিষয়বোধের অনুরোধে উহাতে অবজ্ঞা করা নিতান্ত মূঢ়ের কার্য্য। অতএব তুমি কুশলপরায়ণ, মঙ্গলার্থী ও উদ্যোগশীল হইয়া সৰ্ব্বদা বেদাধ্যয়ন, তপস্যা ও দমগুণের অনুশীলন করিতে যত্নবান্ হও। মানবগণের অব্যক্ত স্বভাব নিতান্ত সূক্ষ্ম, বয়ঃক্রমরূপী অশ্ব নিরন্তর প্রচ্ছন্নভাবে ধাবমান হইতেছে। দণ্ডমুহূর্ত্তাদি ঐ অশ্বের শরীর, মাস উহার অঙ্গ, কৃষ্ণ ও শুক্লপক্ষ উহার নেত্রদ্বয় এবং ক্ষণ, রুটি ও নিমেষাদি উহার রোম। যদি তুমি ঐ অশ্বকে নিরন্তর বেগে ধাবমান হইতে দেখিয়া জ্ঞানচক্ষুবিহীন না হও, তাহা হইলে নিশ্চয়ই পরলোক পরিজ্ঞাত হইয়া ধর্ম্মবিষয়ে আসক্ত হইবে সন্দেহ নাই।

‘যাহারা ইহলোকে সর্ব্বদা কামাসক্ত ও অনিষ্টসংসর্গে প্রবৃত্ত হয়, তাহারা বিবিধ অধৰ্ম্মক্রয়নিবন্ধন পরলোকে যাতনাদেহ ধারণ করিয়া অশেষ কষ্টভোগ করিয়া থাকে। ধর্ম্মপরায়ণ নরপতিগণ ইহলোকে উত্তম ও অধম ব্যক্তিদিগের যথোচিত বিচার ও বিবিধ সৎকার্য্যের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক পরলোকে পুণ্যলোক লাভ করিয়া। পরম সুখ অনুভব করেন। যাহারা ইহলোকে পিতামাতা প্রভৃতি গুরুদিগের বাক্যে অশ্রদ্ধা করে, পরলোকে ভীষণাকার কুক্কুর, অয়োমুখ, বল ও গৃধ্র প্রভৃতি পক্ষী এবং শোণিতলোলুপ কীটগণ তাহাদিগকে আক্রমণপূৰ্ব্বক বিবিধ যন্ত্রণা প্রদান করিয়া থাকে। যাহারা ইহলোকে শৌচ, সন্তোষ, তপস্যা, স্বাধ্যায়, স্বরপ্রণিধান, অহিংসা, সত্য, অচৌর্য্য, ব্রহ্মচর্য্য ও অপরিগ্রহ এই দশবিধ বেদমৰ্য্যাদা অতিক্রম করে, পরলোকে সেই পাপাত্মাদিগকে যমালয়স্থ অসিপত্ৰনামক নরকে বিষম যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয়। যাহারা ইহলোকে লুব্ধ, মিথ্যাপ্রিয়, কপটতাপরায়ণ ও চৌর্য্য প্রবঞ্চনা প্রভৃতি নীচকর্ম্মে নিরত হয়, তাহাদিগকে পরলোকে উষ্ণ বৈতরণীনদীতে নিমগ্ন, অসিপত্ৰনরকে প্রবিষ্ট ও পরশুবননরকে শয়ান হইয়া যারপরনাই ক্লেশ ভোগ করিতে হয়, সন্দেহ নাই।

‘তুমি ব্ৰহ্মদি দেবগণের পদ দর্শন করিয়া আপনাকে কৃতার্থ বোধ করিতেছ, কিন্তু ব্রহ্মের প্রতি দৃষ্টিপাত করিতেছ না এবং যাহার প্রভাবে মৃত্যু উপস্থিত হইবে, সেই অনুপস্থিত জরার বিষয়েও তোমার কিছুমাত্র অনুধাবন নাই। এক্ষণে মোক্ষপথে গমন কর; কেন নিশ্চেষ্ট হইয়া অবস্থান করিতেছ? অচিরাৎ সুখনাশক মহাভয় উপস্থিত হইবে; অতএব অবিলম্বে মুক্তিসুখলাভের নিমিত্ত যত্নবান হও। তুমি যমরাজের শাসনানুসারে দেহান্তে যমপুরে নীত হইবে; অতএব পরকালের সুখসাধন নিমিত্ত কৃচ্ছ্রোপবাসাদিদ্বারা মুক্তিলাভের চেষ্টা কর। পরদুঃখানভিজ্ঞ কৃতান্ত নিশ্চয়ই তোমার ও তোমার বন্ধুবান্ধবের প্রাণ হরণ করিবে, কেহই তাহাকে নিবারণ করিতে সমর্থ হইবে না। অতএব অচিরাৎ পরলোকহিতকর কার্য্যে প্রবৃত্ত হও। তুমি যখন নিতান্ত ব্যাকুল ও যমদূতে বশীভূত হইয়া দশদিক বিঘূর্ণ্যমান দেখিতে দেখিতে যমলোকে গমন করিবে, তৎকালে তোমার শাস্ত্রজ্ঞান বিলুপ্ত হইয়া যাইবে; অতএব এক্ষণে উৎকৃষ্ট সমাধিতে মনোনিবেশ কর। তুমি অচিরাৎ জ্ঞানসঞ্চয়ে যত্নবান হও, তাহা হইলে তোমাকে পরলোকে প্রমাদপরিপূর্ণ পূর্ব্বকৃত শুভাশুভ কার্য্য স্মরণ করিয়া সন্তপ্ত হইতে হইবে না। বল, অঙ্গ ও মনোহররূপিণী জরা তোমার কলেবর জর্জ্জরীভূত করিবে; অতএব কদাপি জ্ঞানসঞ্চয়ে আলস্য করিও না।

‘কৃতান্ত রোগকে সহচর করিয়া তোমার প্রাণনাশের নিমিত্ত বলপূর্ব্বক দেহভেদ করিবে; অতএব অচিরাৎ তপানুষ্ঠানে যত্নবান্ হও। দেহস্থ কামাদি রিপু তোমাকে নানাবিষয়ে প্রলোভন প্রদর্শন করিবে। অতএব প্রযত্নসহকারে পুণ্যসঞ্চয় কর। অতি অল্পদিনের পরে তোমাকে একাকী অন্ধকার দর্শন ও পৰ্ব্বতশিখরে সুবর্ণময় বৃক্ষসকল নিরীক্ষণ করিতে হইবে; অতএব সৰ্ব্বতোভাবে সকার্য্যানুষ্ঠানে যত্নবান হও। যেসকল ইন্দ্রিয় তোমার নিকট আপনাদিগকে মিত্র বলিয়া পরিচয় দেয় তাহারা তোমার শত্রু; উহারা অনায়াসে তোমার বুদ্ধিভ্রংশ করিয়া দিবে; অতএব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়া পরমপদার্থের অন্বেষণ কর। যাহাতে রাজভয় ও চৌরভয় নাই, দেহান্তেও যাহাতে অধিকার থাকে, সেই ধন উপার্জ্জন করা সৰ্ব্বতোভাবে বিধেয়। ঐ ধন কেহই বিভাগ করিয়া লইতে পারে না। যদ্বারা পরলোকে জীবিকানির্ব্বাহ হয়, সাধারণকে সেই জ্ঞানরত্ন প্রদান কর এবং যাহা অনশ্বর, স্বয়ং সেই ধন উপার্জ্জন করিতে যত্নবান্ হও।

‘তুমি বিবেচনা করিয়াছ যে, বিষয়ভোগ করিয়া পশ্চাৎ মুক্তিপথাবলম্বী হইবে, কিন্তু তোমার ঐরূপ অভিলষিত নিষ্ফল। কারণ, বিষয়ভোগ করিতে করিতেই তোমার মৃত্যু উপস্থিত হইবার সম্ভাবনা; অতএব তুমি অচিরাৎ সৎকৰ্ম্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হও। লোকের পরলোকগমনসময়ে মাতা, পুত্র, বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্য প্রিয় পরিবারবর্গ কখনই তাহার সহগমন করে না; কেবল শুভাশুভ কৰ্ম্মসমুদয়ই ঐ সময় সহচর হইয়া থাকে। সমুপার্জ্জিত ধন-রত্নাদি কখনই লোকান্তরিত ব্যক্তির কার্য্যসাধক হয় না। আত্মাই পরলোকগত মনুষ্যের পুণ্যপাপের সাক্ষিস্বরূপ হইয়া থাকে। আত্মার তুল্য সাক্ষী আর কেহই নাই। মনুষ্য দেহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পরলোকগমনে প্রবৃত্ত হইলে তাহার জীবাত্মা ভোগদেহমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া তৎকৃত শুভাশুভ কার্য্যসমুদয় সন্দর্শন করিয়া থাকেন। শরীরস্থিত সূর্য্য, অগ্নি, বায়ু ইহারাও মনুষ্যের পাপপুণ্যের সাক্ষিস্বরূপ। প্রকাশশীল দিবা ও গোপনশীল রাত্রি প্রতিনিয়ত সৰ্ব্বত্র পরিভ্রমণ করিয়া সকল লোকের আয়ুক্ষয় করিতেছে; অতএব তুমি অনন্যমনে স্বধর্ম্ম প্রতিপালন কর।

‘পরলোকমার্গে নানাবিধ ভয়ানক শত্রু বিদ্যমান রহিয়াছে; অতএব তুমি আপনার কর্ত্তব্যকাৰ্য্যের অনুষ্ঠানে যত্নবান হও। একমাত্র কার্য্যই পরলোকে অনুগমন করিয়া থাকে। সেস্থলে কেহ কাহারও কাৰ্য্যের অংশগ্রহণ করিতে সমর্থ হয় না। যে যেরূপ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করে, সে তদনুরূপ ফললাভ করিয়া থাকে। মহর্ষি ও অপ্সরাগণ স্ব স্ব কাৰ্য্যের অনুসারে বিমানচারী হইয়া নানাবিধ সুখসম্ভোগ করিতেছেন। নিষ্পাপকলেবর পুণ্যাত্মা ব্যক্তিরা ইহলোকে যেরূপ শুভকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করেন, পরলোকে তাঁহাদের তদনুরূপ উৎকৃষ্ট গতিলাভ হয়। মহানুভব গৃহস্থেরা উত্তমরূপে গার্হস্থ্যধর্ম্ম প্রতিপালন করিয়া কেহ কেহ প্রজাপতিলোক, কেহ কেহ বৃহস্পতিলোক এবং কেহ কেহ বা ইন্দ্রলোক লাভ করিয়াছেন। হে পুত্র! আমি সহস্র সহস্রবার বলিতে পারি যে, একমাত্র ধর্ম্মই মনুষ্যকে সৎপথে নীত করিয়া থাকে। এক্ষণে তুমি চতুর্ব্বিংশতিবর্ষ হইতে উত্তীর্ণ হইয়া পঞ্চবিংশতিবর্ষে সমুপস্থিত হইয়াছ; অতঃপর আর বৃথা কালাতিপাত করা তোমার উচিত হইতেছে না। কৃতান্তু তোমার ইন্দ্রিয়বর্গকে ভোগবিহীন না করিতে করিতে তুমি স্বধর্ম্মপ্রতিপালনে সত্বর হও। অচিরাৎ আত্মজ্ঞান লাভ কর। দেহ বা পুত্রাদিতে তোমার প্রয়োজন কি? ভয়নিবারণ পরলোকহিতকর ধৰ্ম্ম অবলম্বন করাই শ্রেয়। কাল সকলকেই সমূলে নির্মূল করিয়া থাকে। কেহই তাহাকে নিবারণ করিতে পারে না। হে পুত্র! আমি এক্ষণে আপনার সাধ্যানুসারে তোমাকে যে সদুপদেশ প্রদান করিলাম, তুমি তাহার অনুবর্ত্তী হও।

‘যে ব্যক্তি স্বকার্য্যসাধনার্থ ব্রহ্মে চিত্তসমাধান ও সমুদয় বস্তু পরিত্যাগ করে, তাহাকে আর অজ্ঞান বা মোহজনিত দুঃখাদি ভোগ করিতে হয় না। পুণ্যাত্মা ব্যক্তিরা এই পুরুষার্থজ্ঞান শ্রবণ করিলে তাঁহাদিগের উপদেশবলে ইহা ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী হইয়া উঠে। কৃতজ্ঞ ব্যক্তিকে উপদেশ প্রদান করিলে তাহা কখনই নিস্ফল হয় না। গৃহস্থাশ্রমে বাস করিতে একান্ত অনুরক্ত হইলে মায়াপাশে বদ্ধ থাকিতে পাপাত্মারা কখনই ঐ পাশ হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারে না; কিন্তু পুণ্যাত্মা ব্যক্তিই অনায়াসে উহা ছেদন করিয়া অভিলষিত স্থানে গমন করেন। যখন তোমাকে নিশ্চয়ই কালকবলে নিপতিত হইতে হইবে, তখন তোমার পুত্র-বন্ধুবান্ধব ও বৈভবের প্রয়োজন কি? তোমার পিতামহ প্রভৃতি পুরাতন পুরুষেরা কোথায় গমন করিয়াছেন? এক্ষণে পরম যত্নে পরমাত্মার সহিত সাক্ষাৎ করিতে বাসনা কর। কল্য যাহা করিতে হইবে, তাহা অদ্যই সুসম্পন্ন করা কর্ত্তব্য; অপরাহ্নের কার্য্য পূৰ্ব্বাহ্ণেই সম্পাদন করা উচিত। কারণ, মৃত্যু মানুষের কার্য্য সুসম্পন্ন হউক বা না হউক, কিছুমাত্র বিচার না করিয়াই তাহাকে লইয়াই প্রস্থান করে। মনুয্যের প্রাণবিয়োগ হইলেই জ্ঞাতি ও বন্ধুবান্ধব তাহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাপন করিয়া স্ব স্ব গৃহে গমন করিয়া থাকে; কেহই তাহার সহগমন করে না। অতএব তুমি পাপমতাবলম্বী নির্দ্দয় নাস্তিকদিগকে পরিত্যাগপূর্ব্বক আলস্যশূন্য হইয়া স্থিরচিত্তে পরমাত্মার অন্বেষণ কর। যখন সমুদয় লোকই কালকর্ত্তৃক নিপীড়িত হইতেছে, তখন আর কেন বৃথা কালক্ষেপ করিতেছ? দৃঢ়তর ধৈর্য্যসহকারে স্বধর্ম্ম প্রতিপালন কর।

পিতার উপদেশে শুকের মোক্ষলাভার্থ সঙ্কল্প

‘যে মহাত্মা পরমাত্মার সহিত সাক্ষাৎ করিবার উপায় সম্যকরূপে অবগত হয়েন, তিনি ইহলোকে স্বধর্ম্ম প্রতিপালন করিয়া পরলোকে অনন্ত সুখসম্ভোগের অধিকারী হইয়া থাকেন। যাঁহারা দেহান্তরে আর মৃত্যু নাই বলিয়া অবগত হইয়াছেন, তাঁহাদের পদবীতে পদার্পণ করিলে আর মৃত্যুযন্ত্রণা সহ্য করিতে হয় না। যাঁহারা উত্তরোত্তর ধৰ্ম্মের শ্রীবৃদ্ধিসাধনে তৎপর হয়েন, তাঁহারাই যথার্থ পণ্ডিত; আর যাঁহারা ধৰ্ম্মপরিভ্রষ্ট হয়, তাহারা নিতান্ত মূর্খ। সঙ্কর্ম্মে প্রবৃত্ত ব্যক্তিরা স্ব স্ব অনুষ্ঠিত কাৰ্য্যানুসারে স্বর্গাদি ফললাভ করিয়া থাকেন; কিন্তু পাপানুষ্ঠাননিরত ব্যক্তিদিগকে নিশ্চয়ই নিরয়গামী হইতে হয়। স্বর্গের সোপানভূত দুর্ল্লভ মনুষ্যদেহ লাভ করিয়া যাহাতে উহা হইতে আর পরিভ্রষ্ট হইতে না হয়, তদ্বিষয়ে যত্নশীল হইয়া ব্রহ্মে চিত্তসমাধান করা অবশ্য কর্ত্তব্য। যে ব্যক্তি ধৰ্ম্মপথ অতিক্রম না করিয়া স্বর্গলাভের উপায় অনুধাবন করেন, পণ্ডিতেরা তাঁহাকে পুণ্যকৰ্ম্মা বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। চরমকালে তাঁহার নিমিত্ত শোক করা পুত্ৰাদির কর্ত্তব্য নহে। চঞ্চল না হইয়া দৃঢ়রূপে কর্ত্তব্য কার্য্যে মনঃসমাধান করিলে নিশ্চয়ই স্বর্গলাভ হয় এবং ভয়ের লেশমাত্রও থাকে না। যাহারা তপোবলে জন্মপরিগ্রহপূর্ব্বক ভোগের আস্বাদ গ্রহণ না করিয়া তথায় উপরত হয়, তাহাদিগের অল্পমাত্র ধর্ম্মলাভ হইয়া থাকে; কিন্তু যাহারা গৃহাশ্রমে জন্মপরিগ্রহ করিয়া ভোগের আস্বাদ গ্রহণপূৰ্ব্বক উহা পরিত্যাগ ও তপানুষ্ঠান করিতে পারে, তাহাদের নিশ্চয়ই সমধিক ধর্ম্মলাভ হয় এবং কোন বস্তুই অপ্রাপ্য থাকে না।

ইহলোকে মানবগণের সহস্র সহস্র পিতা, মাতা ও শত শত স্ত্রী-পুত্র সমুৎপন্ন হইয়াছে, হইতেছে ও হইবে; কিন্তু বিশেষ বিবেচনা করিয়া দেখিলে কাহারও সহিত কাহার কোন সম্পর্ক নাই। আমি কাহারও নহি এবং কেহই আমার নহে। সকলেই যেমন স্ব স্ব কার্য্য অনুসারে ফললাভ করে, তুমিও তদ্রূপ আপনার কার্য্যানুসারে ফললাভ করিবে; সুতরাং অন্যের সহিত সংস্রবে প্রয়োজন কি? ইহলোকে যাহারা ঐশ্বর্য্যশালী, তাহাদিগেরই সহিত সকলে আত্মীয়তা করে; কিন্তু যাহারা দরিদ্র, তাহাদিগের সহিত কেহই আত্মীয়তা করে না। অতএব ঐশ্বর্য্য পরিত্যাগপূৰ্ব্বক দরিদ্র হওয়াই শ্রেয়ঃ। মানবগণ স্ত্রীপরতন্ত্র হইয়া তাহার সন্তোষসাধনার্থ নানাবিধ অবৈধকার্য্যের অনুষ্ঠান, করে; কিন্তু তন্নিবন্ধন তাহাদিগকে উভয়লোকে অশেষবিধ, ক্লেশ ভোগ করিতে হয়। অতএব দারপরিগ্রহ না করাই বিধেয়। ফলতঃ এই জীবলোক ক্ষণবিনশ্বর [ক্ষণকালমধ্যেই নষ্ট হয়]; অতএব আমি যেরূপ উপদেশ প্রদান করিলাম, তুমি তদনুসারে কাৰ্য্যানুষ্ঠান কর। যাহার পরলোকে মঙ্গললাভের বাসনা আছে, শুভকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করা তাহার অবশ্য কর্ত্তব্য। কাল, মাস ও ঋতুরূপ দৰ্ব্বী, সূর্য্যরূপ অগ্নি, দিবারাত্ররূপ কাষ্ঠদ্বারা সমুদয় জীবকে পাক করিতেছে। যাহা হউক, যদি ধন থাকিতেও উহা দান ও উপভোগ, যদি অপরিসীম শক্তি থাকিতেও শত্ৰুসংহার, যদি শাস্ত্রজ্ঞান থাকিতেও ধৰ্ম্মকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান এবং যদি জীবনসত্ত্বেও জিতেন্দ্রিয়বৃত্তি অবলম্বন না করা যায়, তাহা হইলে ঐ বৃথা ধন, বল, শাস্ত্রজ্ঞান ও জীবনে প্রয়োজন কি?’

“হে ধৰ্ম্মরাজ! মহাত্মা বেদব্যাস এই কথা কহিলে, শুকদেব তাঁহার উপদেশানুসারে মোক্ষলাভে কৃতসঙ্কল্প হইয়া তাঁহাকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক প্রস্থান করিলেন।”