৩১৯. যাজ্ঞবষ্ক্যের বেদজ্ঞানবিবরণ

৩১৯তম অধ্যায়

যাজ্ঞবষ্ক্যের বেদজ্ঞানবিবরণ

“যাজ্ঞবল্ক্য কহিলেন, ‘হে মহারাজ! তুমি যে পরব্রহ্মের বিষয় জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে, এক্ষণে সেই গুহ্য বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, অনন্যমনে শ্রবণ কর। আমি প্রণতভাবে ঋষিনির্দ্দিষ্ট বিধি অনুসারে নিয়মানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক দিবাকর হইতে যজুর্ব্বেদ প্রাপ্ত হইয়াছি। পূৰ্ব্বে আমি ভগবান্ ভাস্করকে প্রসন্ন করিবার নিমিত্ত ঘোরতর তপানুষ্ঠান করিয়াছিলাম। একদা তিনি আমার পরিচৰ্য্যায় প্রীত হইয়া আমাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ব্ৰহ্মন্! আমাকে প্রসন্ন করা নিতান্ত দুঃসাধ্য, কিন্তু আমি তোমার অবিচলিত ভক্তি দর্শনে তোমার প্রতি সাতিশয় প্রীত হইয়াছি। এক্ষণে তুমি আমার নিকট অভিলষিত বর প্রার্থনা কর; উহা নিতান্ত দুর্ল্লভ হইলেও আমি তোমাকে প্রদান করিব।”

‘ভগবান্ প্রভাকর প্রসন্ন হইয়া এই কথা কহিলে আমি তাহাকে নমস্কার করিয়া কহিলাম, “ভগবন্! যজুর্ব্বেদ আমার অভ্যস্ত নাই; উহা জ্ঞাত হইতে আমার অতিশয় অভিলাষ হইয়াছে।” তখন সূর্য্যদেব কহিলেন, “আমি অচিরাৎ তোমাকে যজুৰ্ব্বেদ প্রদান করিব। তুমি অবিলম্বে আস্যদেশ বিবৃত কর; দেবী সরস্বতী তোমার শরীরমধ্যে প্রবেশ করিবেন।” দিবাকর এই কথা কহিলে আমি তাঁহার নির্দ্দেশানুসারে মুখব্যাদান করিলাম। মুখব্যাদান করিবামাত্র সরস্বতী আমার শরীরমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। বাগ্দেবী শরীরে প্রবিষ্ট হইলে আমি অন্তর্দ্দাহে নিতান্ত দগ্ধ হইয়া সলিলমধ্যে প্রবেশ করিলাম। তৎকালে সূর্য্যের প্রতি আমার অতিশয় অবজ্ঞা ও ক্রোধ উপস্থিত হইল। তখন সূর্য্যদেব আমাকে একান্ত সন্তপ্ত দেখিয়া কহিলেন, “ব্ৰহ্মন্! তুমি মুহূর্ত্তকাল দাহজনিত ক্লেশ সহ্য করিয়া থাক; অবিলম্বেই তোমার কলেবর শীতল হইবে।” ভগবান্ সূর্য্য এই কথা কহিয়া নিস্তব্ধ হইলে কিয়ৎক্ষণ পরেই আমার শরীর সুশীতল হইল। তখন তিনি আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ব্রহ্ম! পরশাখা [নিজ বেদ ব্যতীত অন্যান্য বেদের শাখাসমূদয়] ও উপনিষদের সহিত সমগ্র বেদ তোমার আয়ত্ত হইবে। উহা আয়ত্ত হইলে তোমার বুদ্ধি মুক্তিমার্গে প্রবেশ করিবে এবং তুমি সাংখ্যমতাবলম্বী ও যোগীদিগের অভিলষিত পদপ্রাপ্ত হইতে সমর্থ হইবে।” দিবাকর এই বলিয়া অস্তাচলে গমন করিলেন।

‘অনন্তর আমি গৃহে প্রত্যাগমনপূৰ্ব্বক হৃষ্টমনে দেবী সরস্বতীকে স্মরণ করিলাম। আমি স্মরণ করিবামাত্র বাগদেবী স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণে বিভূষিত হইয়া, ওঙ্কারকে অগ্রবর্ত্তী করিয়া আমার সর্ম্মুখে প্রাদুর্ভূত হইলেন। আমি তাঁহাকে দর্শন করিয়া অতিমাত্র ব্যগ্রচিত্তে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক তাঁহাকে ও সূর্য্যদেবকে অপ্রদান করিয়া উপবেশন করিলাম। আমি উপবিষ্ট হইলে রহস্য ও সংগ্রহশাস্ত্রের সহিত সমগ্র বেদ আমার হৃদয়ে আবির্ভূত হইল। তখন আমি শিষ্যপরিবৃত মাতুল বৈশম্পায়নের অপ্রিয়ানুষ্ঠান করিবার নিমিত্ত একশত শিষ্যকে ঐ বেদ অধ্যয়ন করাইলাম এবং অবিলম্বেই সেই শিষ্যগণে পরিবেষ্টিত হইয়া করজালমণ্ডিত মার্ত্তণ্ডের ন্যায় তোমার পিতার যজ্ঞে দীক্ষিত হইলাম। তথায় মহর্ষি দেবলের সমক্ষে মাতুল বৈশম্পায়নের সহিত বেদপাঠের দক্ষিণা লইয়া, আমার ঘোরতর বিবাদ উপস্থিত হইল। পরে আমি তাঁহাকে দক্ষিণার অর্দ্ধাংশ প্রদান করিব বলিয়া স্বীকার করিলাম। সুমন্তু, জৈমিনি, পৈল, তোমার পিতা এবং অন্যান্য মহর্ষিগণ আমার বাক্যে অনুমোদন করিলেন।

‘এইরূপে আমি সূর্য্যদেব হইতে পঞ্চদশ যজুঃসংহিতা প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। এতদ্ভিন্ন আমি মহর্ষি রোমহর্ষের নিকট পুরাণপাঠ করিয়াছি। অনন্তর আমি ভগবান্ ভাস্করের প্রভাবে সরস্বতীর অনুকম্পায় ঐ বেদের তাৎপর্য্য প্রকাশ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। শিষ্যগণকে সংগ্রহের সহিত সমস্ত বেদ উত্তমরূপে অধ্যয়ন করাইলাম। তাহারাও হৃষ্টমনে অধ্যয়ন করিয়া স্ব স্ব স্থানে গমন করিল। অগ্রে সূর্য্যদেবকর্ত্তৃক আদিষ্ট এই পঞ্চদশ শাখা অনুশীলন করিয়া পশ্চাৎ জ্ঞাতব্য বিষয় চিন্তা করা জ্ঞানবানের কর্ত্তব্য।

যাজ্ঞবল্ক্যর প্রকৃতি-পুরুষ বিবেক

‘একদা বেদবেদান্তবেত্তা গন্ধৰ্ব্বরাজ বিশ্বাবসু ব্রাহ্মণসমূহের হিতকর মোক্ষ ও উৎকৃষ্ট জ্ঞেয় পদার্থের বিষয় পর্য্যালোচনা করিতে করিতে আমার নিকট আগমন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘ব্রহ্মন! বিশ্ব, অবিশ্ব, অশ্বা, অশ্ব, মিত্র, বরুণ, জ্ঞান, জ্ঞেয়, অজ্ঞ, জ্ঞ, তপাঃ, অতপাঃ, সূৰ্য্যাদ, সূর্য্য, বিদ্যা, অবিদ্যা, বেদ্য, অবেদ্য, অচল, চল এবং অক্ষয় ও ক্ষয় এই কয়েকটি শব্দের প্রকৃত অর্থ কি? আর তর্কদ্বারা কি প্রকারে প্রকৃতি ও পুরুষের অক্ষয়ত্ব সপ্রমাণ করা যাইতে পারে?”

‘গন্ধৰ্ব্বরাজ এই সমস্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে আমি তাঁহাকে কহিলাম, “গন্ধৰ্ব্বরাজ! আমি এই কয়েকটি প্রশ্নের সিদ্ধান্ত স্থির করিতেছি, তুমি কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা কর।” আমি এই কথা কহিলে গন্ধৰ্ব্বরাজ আমার বাক্যে স্বীকার করিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া রহিলেন। তখন আমি দেবী সরস্বতীকে মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলাম। তাঁহাকে স্মরণ করিবামাত্র দধি হইতে ঘৃত যেমন উত্থিত হয়, সেইরূপ যে-যে শাস্ত্র আলোচনা করিলে ঐ সমুদয় প্রশ্নের উত্তরপ্রদান করা যায়, তৎসমুদয় আমার স্মৃতিপথে উত্থিত হইল। তখন আমি সমগ্র উপনিষদ ও আন্বীক্ষিকী শাস্ত্র [তর্কবিদ্যা] পর্য্যালোচনা করিতে লাগিলাম। ঐ আন্বীক্ষিকী বিদ্যা জ্ঞাণিগণের মোক্ষোপযোগী, উহাকে চতুর্থী বিদ্যা বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়।

‘অনন্তর আমি বিশ্বাবসুকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম, “গন্ধৰ্ব্বরাজ! তুমি আমার নিকট যে প্রশ্ন করিলে, আমি তাহার প্রত্যুত্তর প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর। এই জন্মভয়যুক্ত ত্রিগুণসম্পন্ন বিশ্বকে প্রকৃতি এবং অবিশ্বকে নির্গুণ পুরুষ বলিয়া কীৰ্ত্তন করা যায়। ঐরূপ অশ্বা প্রকৃতি ও অশ্ব পুরুষ, বরুণ প্রকৃতি ও মিত্র পুরুষ, জ্ঞান প্রকৃতি ও জ্ঞেয় পুরুষ, অজ্ঞ প্রকৃতি ও জ্ঞ পুরুষ, তপাঃ প্রকৃতি ও অতপাঃ পুরুষ, অবিদ্যা প্রকৃতি ও বিদ্যা পুরুষ, অবেদ্য প্রকৃতি ও বেদ্য পুরুষ, সূৰ্য্যাদ প্রকৃতি ও সূর্য্য পুরুষ এবং চল প্রকৃতি ও অচল পুরুষনামে কীৰ্ত্তিত হয়েন। মতভেদে প্রকৃতিকে বেদ্য ও পুরুষকে অবেদ্য বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকে। প্রকৃতি ও পুরুষ ইঁহারা উভয়েই অজ্ঞ, নিত্য, অক্ষয় ও জন্ম মৃত্যুবিহীন হইয়া অভিহিত হইয়া থাকেন। উহাদের জন্ম নাই বলিয়া উহারা অজ ও ক্ষয় না থাকাতে অক্ষয় নামে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছেন। সত্ত্বাদি গুণের আশ্ৰয়ত্ব ও জগৎকর্ত্তৃত্বনিবন্ধন প্রকৃতিকে অক্ষয় বলিয়া কীৰ্ত্তন করা যায়। এই আমি তোমার নিকট বেদমতানুসারে বিশ্বাবিশ্ব প্রভৃতি শব্দের প্রকৃত অর্থ এবং তর্কদ্বারা প্রকৃতি ও পুরুষের অক্ষরত্ব যেরূপে সপ্রমাণ হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করিলাম।”

‘গুরুর উপাসনাদ্বারা বেদের তাৎপর্য্য অবগত হইয়া নিত্যক্রিয়াসাধনান্তে বেদের আলোচনা করা অবশ্য কর্ত্তব্য। যাহারা সাঙ্গ বেদাধ্যয়নে একান্ত আসক্ত থাকে, অথচ আকাশাদি মহাভূতসমুদয়ের সৃষ্টি-সংহার-কৰ্ত্তা বেদপ্রতিপাদ্য পরমাত্মাকে অবগত হইতে না পারে, তাহাদিগের বেদাধ্যয়ন কেবল বিড়ম্বনামাত্র। ঘৃতার্থী হইয়া গভীর দুগ্ধ মন্থন করিলে তাহা হইতে ঘৃতোপযোগী নবনীত উৎপন্ন হয় না; প্রত্যুত বিষ্ঠাতুল্য দুর্গন্ধ পদার্থই সমুৎপন্ন হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি বেদবিদ্যা অভ্যাস করিয়া প্রকৃতি ও পরব্রহ্মকে লাভ করিতে না পারে, সে নিতান্ত মূঢ় ও তাহার জ্ঞানোপার্জ্জন একান্ত নিষ্ফল। যত্নপূৰ্ব্বক প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়ের সহিত সাক্ষাৎ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। তাহা হইলে আর পুনরায় সংসারমধ্যে জন্মমৃত্যুর বশবর্ত্তী হইতে হয় না। কৰ্ম্মকাণ্ড-বেদোক্ত নশ্বর ধর্ম্ম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অক্ষয় ধৰ্ম্মে নিরত হইয়া যত্নসহকারে অহরহঃ জীবাত্মাকে বিশুদ্ধরূপে দর্শন করিতে পারিলেই প্রকৃতিকে অতিক্রম ও পরমাত্মার সহিত সাক্ষাৎকার লাভ করা যায়। মূঢ়ব্যক্তিরা শাশ্বত পরমাত্মাকে জীবাত্মা হইতে পৃথক বলিয়া বোধ করে; কিন্তু সাধুব্যক্তিরা তাঁহাকে জীবাত্মা হইতে অভিন্ন বলিয়া জ্ঞান করিয়া থাকেন। যোগী ও সাঙ্খ্যমতাবলম্বীরা অবিনশ্বর জীবাত্মার সহিত পরমাত্মার অভেদজ্ঞানকেই সবিশেষ প্রশংসা করিয়া থাকেন।’

‘তখন বিশ্বাবসু পুনরায় কহিলেন, “ব্রহ্ম! আপনি জীবাত্মাকে অবিনশ্বর বলিয়া কীৰ্ত্তন করিলেন; কিন্তু জীবাত্মা বস্তুতঃ অবিনশ্বর কিনা, তাহা কীৰ্ত্তন করুন। আমি যদিও ধীমান্ জৈগীষব্য, অসিতদেবল, পরাশর, বার্ষ্যগণ্য, ভৃগু, পঞ্চশিখ, কপিল, শুক, গৌতম, আরর্ক্টিষেণ, গর্গ, নারদ, আসুরি, পুলস্ত্য, সনকুমার, শুক্রাচার্য্য, পিতা কশ্যপ, রুদ্র, বিশ্বরূপ দেবতা, পিতৃলোক ও দৈতেয়গণের নিকট এই বিষয় অবগত হইয়াছি, তথাপি আপনার প্রমুখাৎ ঐ সমুদয় শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ হইয়াছে। আপনি বাগ্বিশ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমান ও শ্রুতিনিপুণ, আপনার অবিদিত কিছুই নাই; দেবলোক, পিতৃলোক ও ব্রহ্মলোকগত। মহর্ষিগণ এবং ভগবান্ ভাস্কর সতত আপনার প্রশংসা করিয়া থাকেন; আপনি সাংঙ্খ্যতত্ত্ব, যোগশাস্ত্র ও এই চরাচর বিশ্বের বিষয় সম্যকরূপ অবগত আছেন; এই নিমিত্তই আপনার নিকট এই অত্যুৎকৃষ্ট জ্ঞানলাভ করিতে আমার একান্ত বাসনা হইয়াছে।”

‘তখন আমি কহিলাম, ‘হে গন্ধৰ্ব্বরাজ! তুমি শ্রুতিধর; অতএব যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছ, তাহা সাধ্যানুসারে কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। জীবাত্মা জড়ুরূপা প্রকৃতিকে অবগত হইতে সমর্থ হয়েন, কিন্তু প্রকৃতি কখন তাঁহাকে অবগত হইতে পারেন 
না। সাঙ্খ্য ও যোগবিৎ পণ্ডিতগণ জীবাত্মার জ্ঞান আছে বলিয়াই উঁহাকে শ্রেষ্ঠ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। জীবাত্মা দেহের সহিত অভিন্নভাবে অবস্থান করিলে কখনই পরমাত্মাকে অবলোকন করিতে পারেন না; কিন্তু দেহ হইতে ভিন্ন হইলেই অনায়াসে তাঁহাকে পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ হয়েন। পরমাত্মা কি জীব, কি দেহ, উভয়কেই সতত সন্দর্শন করিতেছেন। জ্ঞানবান্ ব্যক্তিরা কখনই চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্বযুক্ত দেহকে আত্মা বলিয়া স্বীকার করেন না। সলিলমধ্যস্থ মৎস্যকে কেহ খাদ্যদ্রব্য প্রদান করিলে সে যেমন তাহাতে আসক্ত হয়, তদ্রূপ জীবাত্মা পরমাত্মার প্রেরণানিবন্ধন বিবিধ বিষয়ে আসক্ত হইয়া থাকেন। জীব-যখন দেহের সহিত একত্র বাস ও অভেদবুদ্ধিনিবন্ধন স্নেহপরবশ হইয়া আপনার সহিত পরমাত্মার একত্ব অনুধাবন করিতে অসমর্থ হয়, তখন সে সংসারসাগরে নিমগ্ন হইয়া থাকে; আর যখন সে আপনার সহিত পরমাত্মাকে অভিন্ন জ্ঞান করে, তখন সে সংসারসাগর হইতে উত্থিত হয়। যখন জীব আপনাকে দেহ হইতে স্বতন্ত্র বলিয়া অনুমান করে,
তখন সে পরমাত্মাকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হয়। পরমাত্মা ও জীবাত্মা উভয়েই স্বতন্ত্র; কিন্তু সাধুব্যক্তিরা উঁহাদিগকে অভিন্ন বলিয়া অনুমান করিয়া থাকেন। যখন জীব আপনাকে দেহ হইতে স্বতন্ত্র বিবেচনা করে এবং পরমতত্ত্ব পরমাত্মাকে দ্রষ্টা ও দৃশ্য, ভিন্ন ও অভিন্ন, জগতের কারণ ও জীবরূপে দর্শন না করিয়া তাহাকে জ্ঞানদ্বারা নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হয়, তখন সে সৰ্ব্বজ্ঞ হইয়া মুক্তিলাভ করিয়া থাকে। জীবাত্মা এইরূপে পরমাত্মার সহিত একীভাব প্রাপ্ত হয়েন বলিয়া উহাকে অবিনশ্বর নির্দ্দেশ করা যায়। হে গন্ধৰ্ব্বরাজ! এই আমি শাস্ত্রানুসারে প্রকৃতি, জীব ও ব্রহ্মের কীৰ্ত্তন করিলাম।

বিশ্বাবসুকর্ত্তৃক যাজ্ঞবল্ক্য মতের প্রচার

‘আমি এইরূপ জ্ঞানগর্ভ বাক্য কীৰ্ত্তন করিলে গন্ধৰ্ব্বরাজ বিশ্বাবসু আমার প্রতি একান্ত সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, “ভগবন্‌! আপনি সৰ্ব্ববেদপ্রধান ব্রহ্মের বিষয় বুদ্ধিপূৰ্ব্বক কীৰ্ত্তন করিলেন; অতএব আপনার মঙ্গল হউক। এক্ষণে আমি স্বস্থানে প্রস্থান করি।” দিব্যরূপধারী গন্ধৰ্ব্বরাজ এই বলিয়া পরম প্রীতিসহকারে আমাকে অভিনন্দন ও প্রদক্ষিণ করিয়া দেবলোকে প্রস্থান করিলেন এবং অচিরাৎ ভূলোক, দ্যুলোক ও নাগলোকে সৎপথাবলম্বী ব্যক্তিদিগের নিকট সেই সদুপদিষ্ট উপদেশ প্রচার করিতে লাগিলেন।

‘হে মহারাজ! সাঙ্খ্যমতাবলম্বী, যোগধর্ম্মনিরত ও অন্যান্য মোক্ষাভিলাষী ব্যক্তিদিগের এই বিজ্ঞানপূর্ণ উপদেশ অতিশয় শ্রেয়স্কর। জ্ঞানই মোক্ষলাভের কারণ; জ্ঞান না জন্মিলে কদাচ মোক্ষলাভের সম্ভাবনা নাই। অতএব প্রকৃত জ্ঞানের অনুসন্ধান করাই সৰ্ব্বতোভাবে শ্রেয়ঃ । জ্ঞানদ্বারাই মনুষ্য জন্মমৃত্যুর দুর্ভেদ্য শৃঙ্খল হইতে মুক্তিলাভ করিতে সমর্থ হয়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের কথা দূরে থাকুক, অতি নীচ শূদ্রাদি হইতেও জ্ঞানোপদেশ প্রাপ্ত হইলে তাহাতে শ্রদ্ধা করা অবশ্য কর্ত্তব্য। শ্রদ্ধাবান্ পুরুষ কদাচ জন্মমৃত্যুকর্ত্তৃক আক্রান্ত হয়েন না। সকল বর্ণই ব্রহ্ম হইতে সদ্ভূত হইয়াছে। অতএব সকল বর্ণকেই ব্রাহ্মণ বলিয়া গণ্য করা যায় এবং সকল বর্ণেরই বেদপাঠে অধিকার আছে। ফলতঃ সমস্ত বিশ্বই ব্রহ্মময়। ব্রহ্মার আস্যদেশ হইতে ব্রাহ্মণ, বাহুযুগল হইতে ক্ষত্রিয়, নাভি হইতে বৈশ্য ও পদতল হইতে শূদ্র সমুৎপন্ন হইয়াছে। মনুষ্য অজ্ঞানতানিবন্ধন বারংবার জন্মমৃত্যু লাভ করিয়া থাকে। অতএব জ্ঞানানুসন্ধান করা সৰ্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য। জ্ঞান সকল কালেই সৰ্ব্বত্র আপনার আধিপত্য বিস্তার করিয়া আসিতেছে। দেখ, অতি পূৰ্ব্বকালেও অনেকানেক ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়াদি মহাত্মারা জ্ঞাননিষ্ঠ হইয়া মুক্তিলাভ করিয়াছিলেন; সুতরাং মোক্ষ যে নিত্যসিদ্ধ, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। হে মহারাজ! তুমি আমাকে যেসমস্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে, আমি তৎসমুদয়ের প্রকৃত প্রত্যুত্তর প্রদান করিলাম, এক্ষণে তুমি এই সমস্ত সবিশেষ অনুধাবন করিয়া প্রীতিলাভ ও ইহার অনুষ্ঠান কর, তাহা হইলেই তোমার মঙ্গললাভ হইবে।’ ”

ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! ধীমান্ যাজ্ঞবল্ক্য এইরূপে মিথিলাধিপতি দেবরাজতনয়কে উপদেশ প্রদান করিলে, তিনি সাতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে প্রদক্ষিণ করিয়া বিদায় করিলেন এবং অবিলম্বে তথায় আসীন হইয়া ব্রাহ্মণগণকে এক-এক কোটি গোধন, এক-এক কোটি সুবর্ণ ও এক-এক অঞ্জলি রত্ন প্রদান করিতে লাগিলেন। তৎপরে তিনি স্বীয় পুত্রকে বিদেহরাজ্য সমর্পণপূৰ্ব্বক অজ্ঞানমূলক ধৰ্ম্মাধৰ্ম্মের নিন্দা করিয়া যতিধৰ্ম্ম অবলম্বন করিলেন এবং সাঙ্খ্য ও যোগশাস্ত্র অধ্যয়নপূর্ব্বক আপনাকে সর্ব্বব্যাপী জ্ঞান করিয়া ধৰ্ম্ম, অধৰ্ম্ম, পাপ, পুণ্য, সত্যমিথ্যা ও জন্মমৃত্যু সমুদয়ই বৃথা বলিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! সাঙ্খ্য ও যোগজ্ঞানসম্পন্ন পণ্ডিতগণ এই বিশ্বকার্য্য প্রকৃতি ও পুরুষের কৃত বলিয়া জ্ঞান করিয়া থাকেন। বিদ্বান্ ব্যক্তিরা পরাৎপর পরমব্রহ্মকে ইষ্টানিষ্টবিনির্ন্মুক্ত, নিত্য ও শুচি বলিয়া নির্দ্দেশ করেন; অতএব তুমিও পবিত্রভাব অবলম্বন কর। দাতা, দেয়, দান ও প্রতিগ্রহীতা সকলকেই আত্মা বলিয়া অবগত হইবে। আপনার আত্মাই অদ্বিতীয় পদার্থ এবং তাহা হইতে উৎকৃষ্ট আর কিছুই নাই; ইহাই সতত চিন্তা করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। যাহারা ব্ৰহ্মতত্ত্ব কিছুমাত্র অবগত নহে, তাহাদিগের তীর্থপর্য্যটন ও যজ্ঞানুষ্ঠান করাই শ্রেয়ঃ। বেদাধ্যয়ন, তপস্যা বা যজ্ঞদ্বারা মোক্ষ লাভ করা যায় না। সেই অব্যক্ত পরমব্রহ্মকে অবগত হইতে পারিলেই মোক্ষলাভ হইয়া থাকে। যাঁহারা মহত্তত্ত্বের উপাসনা করেন, তাঁহারা অহঙ্কারের স্থান প্রাপ্ত হয়েন, কিন্তু যাঁহারা প্রকৃতি হইতে উৎকৃষ্ট পরমব্রহ্মাকে অবগত হইতে পারেন, তাঁহারা মায়াতীত অতি উৎকৃষ্ট স্থানলাভে সমর্থ হইয়া থাকেন।

“হে ধৰ্ম্মরাজ! পূৰ্ব্বে মহাত্মা জনক যাজ্ঞবল্ক্যের নিকট এই জ্ঞান লাভ করেন, তৎপরে আমি জনকের নিকট ইহা প্রাপ্ত হইয়াছি। জ্ঞান যজ্ঞ অপেক্ষা সমধিক উৎকৃষ্ট, জ্ঞান-প্রভাবে অনায়াসে সংসারসাগর হইতে উত্তীর্ণ হওয়া যায়; কিন্তু যজ্ঞবলে তাহা হইবার সম্ভাবনা নাই। জ্ঞানবান্ ব্যক্তিরা কহিয়া থাকে যে, দুঃখ ও জন্মমৃত্যু নিরাকৃত করা পুরুষাকারসাধ্য নহে। যজ্ঞ, তপস্যা, ব্রত ও নিয়মদ্বারা স্বর্গলাভ হইলে পুনরায় পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিতে হয়। অতএব তুমি পবিত্রমনে পরমপাবন সুনির্ম্মল শান্তিজনক পরমব্রহ্মের উপাসনা কর; তাহা হইলেই তুমি সেই পরমাত্মার স্বরূপ হইতে পারিবে। হে ধৰ্ম্মরাজ! মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য জনকরাজার নিকট শাশ্বত অব্যয়তত্ত্ব কীৰ্ত্তনপূৰ্ব্বক যে জ্ঞানগর্ভ উপদেশ প্রদান করিয়া গিয়াছেন, সেই উপদেশানুসারে কার্য্য করিতে পারিলেই অনায়াসে শোকশূন্য অমৃতময় মোক্ষলাভ করা যায়, সন্দেহ নাই।”