৩১৬তম অধ্যায়
প্রকৃতি-পুরুষের তত্ত্বনিরূপণ
“যাজ্ঞবল্ক্য কহিলেন, ‘রাজর্ষে! কেহই নিষ্ঠুণকে সগুণ করিতে সমর্থ হয় না। আমি নির্গুণ ও সগুণ পদার্থের বিষয় তোমার নিকট সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। তত্ত্বদর্শী মুনিগণ পুরুষ জবাপুস্পাদির আভাযুক্ত স্ফটিকের ন্যায় গুণের আভাযুক্ত হইলে তাঁহাকে সগুণ, আর সেই আভাবিহীন হইলে তাঁহাকে নির্গুণ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। প্রকৃতি গুণাত্মক। সুতরাং গুণকে কখনই অতিক্রম করিতে সমর্থ হয় না। উহা স্বাভাবিক অনভিজ্ঞতাদোষেই গুণসমুদয় আশ্রয় করিয়া থাকে। পুরুষ স্বভাবতঃ জ্ঞানী। তিনি আপনাকে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া জ্ঞান করেন। নিত্যত্ব ও অক্ষরত্বপ্রযুক্ত পুরুষকে সচেতন এবং ক্ষরত্বপ্রযুক্ত প্রকৃতিকে অচেতন বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। যখন পুরুষ অজ্ঞানবশতঃ বারংবার গুণসঙ্গ আশ্রয় করেন, তখন তিনি আপনাকে পরিজ্ঞাত হইতে না পারিয়া মুক্তিলাভে অসমর্থ হয়েন। পুরুষ যখন সৃষ্টি করেন, তখন তাঁহাকে স্বর্গধর্ম্মাবলম্বী, যখন যোগানুষ্ঠান করেন, তখন তাঁহাকে প্রকৃতিধর্ম্মাবলম্বী এবং যখন স্থাবর পদার্থের সৃষ্টি করেন, তখন তাঁহাকে বীজধর্ম্মাবলম্বী বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। তিনি গুণসমুদয়ের সৃষ্টি ও সংহারকর্ত্তা, নিঃসঙ্গ, সর্ব্বময় এবং দেহাদি হইতে পৃথক্; এই নিমিত্ত অধ্যাত্মবিদ্যাবিশারদ পণ্ডিতেরা তাঁহাকে অদ্বিতীয় ও নিত্য এবং প্রকৃতিকে অনিত্য ও নানা প্রকার বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। কোন কোন ব্যক্তি প্রকৃতিকে এক এবং পুরুষকে অসংখ্য বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। তাঁহাদিগের মতে পুরুষ সৰ্ব্বভূতে দয়াবান্ হইয়া কেবল জ্ঞানাবলম্বনপূৰ্ব্বক অবস্থান করিয়া থাকেন।
হে মহারাজ! এই আমি তোমার নিকট পুরুষের অস্তিত্ব ও একত্বের বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম। এক্ষণে প্রকৃতি-পুরুষের পৃথগ্ভাব কহিতেছি, শ্রবণ কর। যেমন ঈষিকা ও শরমুঞ্জ, উড়ুম্বর ও মশক, মৎস্য ও জল, চুল্লী ও অগ্নি এবং পদ্মপত্র ও সলিল একত্র অবস্থিত হইলেও পরস্পর নির্লিপ্ত থাকে, তদ্রূপ অনিত্য প্রকৃতি ও নিত্যস্বরূপ পুরুষ উভয়ে একত্র অবস্থান করিলেও পৃথক বলিয়া পরিগণিত হয়েন। যাহারা সম্যকরূপে প্রকৃতি-পুরুষের পৃথগ্ভাব পরিজ্ঞাত হইতে না পারে, সেই অধম ব্যক্তিদিগকে বারংবার ঘোর নরকে নিপতিত হইতে হয়। এই আমি তোমার নিকট সমুদয় সাঙ্খ্যতত্ত্ব সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম। সাঙ্খ্যবিদ পণ্ডিতেরা এইরূপ প্রকৃতি-পুরুষের তত্ত্ব পরিজ্ঞাত হইয়াই মোক্ষলাভ করিয়া থাকেন। যাঁহারা তত্ত্ব-বিষয়ে কুশল, তাঁহারা সাঙ্খ্যমতদ্বারা অনায়াসেই সিদ্ধি লাভ করিতে পারেন।’ ”