৩১৩তম অধ্যায়
ধর্ম্মরাজসমীপে ধর্ম্মের পরিচয়-প্রদান
বৈশম্পায়ন কহিলেন, যক্ষ-বাক্যানুসারে পাণ্ডবগণ সকলেই গাত্ৰোখান করিলেন; তাহাদিগের ক্ষুৎপিপাসা ক্ষণমাত্রেই অপনীত হইল। এদিকে অপরাজিত যক্ষ এক চরণে সরোবরে দণ্ডায়মান রহিয়াছেন, রাজা যুধিষ্ঠির তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়! আপনি কে? আপনাকে যক্ষ বলিয়া বোধ হয় না, আপনি বসু, রুদ্র কিংবা মরুদগণের মধ্যে প্রধান একজন অথবা দেবরাজ হইবেন, সন্দেহ নাই; নতুবা এ প্রকার ব্যাপার ঘটিত না। এই ভূমণ্ডলে এমন যোদ্ধা দৃষ্টিগোচর হয় না যে, ঈদৃশ যুদ্ধকুশল ভ্রাতৃগণকে নিপতিত করে। ইহারা যেরূপ সুখস্বচ্ছন্দে প্রতিবোধিত হইয়াছেন এবং ইহাদিগের ইন্দ্ৰিয়সকল যেরূপ অবিকল রহিয়াছে, তাহাতে বোধ হয়, আপনি আমাদিগের সুহৃৎ বা পিতা হইবেন।”
যক্ষ কহিলেন, “তাত! আমি তোমার পিতা ভীমপরাক্রম ধর্ম্ম তোমাকে দেখিবার নিমিত্ত আগমন করিয়াছি। যশ, সত্য, দম, শৌচ, আর্জ্জব, হ্রী, আচাপল্য, দান, তপস্যা ও ব্রহ্মচৰ্য্যা আমার শরীর; অহিংসা, সমতা, শান্তি, তপ, শৌচ ও অমৎসরতা আমার ইন্দ্ৰিয়। হে যুধিষ্ঠির! তুমি আমার সাতিশয় প্রীতিভাজন, তুমি পঞ্চযজ্ঞে একান্ত অনুরক্ত হইয়াছ এবং পাপকারণ কাম, ক্ৰোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসৰ্য্য পরাজয় করিয়াছ। আমি তোমাকে পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত আগমন করিয়াছিলাম, এক্ষণে তোমার আনৃশংস্যদ্বারা পরমগ্ৰীতি লাভ করিয়াছি। তোমার মঙ্গল হউক, তুমি বর গ্রহণ করা। যে ব্যক্তি আমার ভক্ত, সে কখন দুৰ্গতি ভোগ করে না।’”
ধর্ম্মের নিকট যুধিষ্ঠিরের বরলাভ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “যে ব্রাহ্মণের অরণী-সহিত মন্থদণ্ড মৃগকর্ত্তৃক অপহৃত হইয়াছে, তাহার অগ্নিহোত্ৰসকল যেন বিলুপ্ত না হয়, ইহাই আমার প্রথম প্রার্থনা।”
ধর্ম্ম কহিলেন, “আমি তোমাকে পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত মৃগবেশে ব্রাহ্মণের অরণী-সহিত মন্থদণ্ড অপহরণ করিয়াছি, তাহা প্রদান করিতেছি, তুমি এক্ষণে অন্য বর প্রার্থনা কর।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “আমরা অরণ্যে দ্বাদশ বৎসর অতিবাহিত করিয়াছি; ত্ৰিয়োদশ বর্ষ সমুপস্থিত; অতএব এক্ষণে আমরা যে স্থানে বাস করিব, কেহ যেন উহা অবগত হইতে সমর্থ না হয়, এই বর প্রদান করুন।”
ভগবান ধর্ম্ম ‘প্রদান করিতেছি’ বলিয়া প্রত্যুত্তর করিলেন এবং আশ্বাস প্রদানপূর্ব্বক কহিলেন, “তাত! যদ্যপি ছদ্মবেশ পরিগ্রহ না করিয়া সমস্ত ধারামণ্ডল ভ্ৰমণ করা, তথাপি ত্ৰিলোকমধ্যে কোন লোকই তোমাকে অবগত হইতে সমর্থ হইবে না। হে পাণ্ডবগণ! তোমরা এই ত্রয়োদশ বৎসর আমার প্রসাদে গৃঢ়বেশে বিরাটনগরে অজ্ঞাতবাস করিবে, তোমাদিগের মধ্যে যিনি যে রূপ ধারণ করিতে সংকল্প করিয়াছেন, তিনি স্বচ্ছন্দে তাদৃশ বেশ পরিগ্রহ করিবেন; আর এই অরণীসংযুক্ত মন্থনদণ্ড ব্রাহ্মণকে প্রদান কর; আমি তোমাকে পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত মৃগবেশে ইহা হরণ করিয়াছিলাম। হে প্রিয়দর্শন! তুমি আমার আত্মজ; বিদুর আমার অংশজ, আমি তোমাকে বর প্রদান করিয়াও পরিতৃপ্ত হইতেছি। না; অতএব তৃতীয় বর প্রার্থনা কর।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে দেবদেব! আমি সাক্ষাৎ সনাতন দেবতাকে দৃষ্টিগোচর করিয়াছি। হে পিতঃ! এক্ষণে আপনি প্রীত হইয়া যে বর প্রদান করিবেন, তাহাই গ্রহণ করিব। হে তাত! আমি যেন লোভ, মোহ ও ক্রোধকে পরাজয় করিতে সমর্থ হই; আমার অন্তঃকরণ যেন তপ, দান ও সত্যে সতত অনুরক্ত থাকে।”
ধর্ম্ম কহিলেন, “হে পাণ্ডব! তুমি স্বভাবতঃই ঐ সকল গুণে বিভূষিত আছ, এক্ষণে পুনর্ব্বার যথোক্ত, ধর্ম্মভূষণে সমধিক শোভমান হইবে।” এই কথা বলিয়া ভূতভাবন ভগবান ধর্ম্ম সেই স্থানেই অন্তর্হিত হইলেন। সুখপ্রসুপ্ত পাণ্ডবগণও আশ্রমে আগমনপূর্ব্বক তপস্বী ব্রাহ্মণকে অরণীসনাথ মন্থদণ্ড প্রদান করিলেন। যে জিতেন্দ্ৰিয় ব্যক্তি পাণ্ডবগণের সমুত্থান এবং ধর্ম্ম ও ধর্ম্মপুত্রের সমাগম অধ্যয়ন করেন, তিনি পুত্রপৌত্রে পরিবৃত হইয়া শতবর্ষজীবিত থাকেন। এই আখ্যান অবগত হইলে মানবগণের অন্তঃকরণ কদাপি অধর্ম্ম, সুহৃদ্ভেদ, পরস্বাপহরণ, পরদারাভিমর্ষণ ও অন্যান্য কদৰ্য্য কর্ম্মে অনুরক্ত হয় না।