৩১১তম অধ্যায়
যোগপ্রসঙ্গে সৃষ্টিতত্ত্ব—যাজ্ঞবল্ক্য-জনকসংবাদ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! যিনি ধৰ্ম্মাধর্ম্মবিমুক্ত, সৰ্ব্বসংশয়বিরহিত, জন্মমৃত্যুশূন্য, মঙ্গলস্বরূপ, নিত্য, অবিনাশী, বিশুদ্ধস্বভাব ও আয়াসবর্জ্জিত, আপনি তাঁহার বিষয় কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আমি এই স্থলে যাজ্ঞবল্ক্য-জনক সংবাদ নামক এক প্রাচীন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা জনকবংশীয় দেবরাজতনয় মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্যকে কহিলেন, ‘তপোধন! ইন্দ্রিয় ও প্রকৃতি কয় প্রকার? সগুণ ও নির্গুণ কি এবং জন্ম, মৃত্যু ও কালসংখ্যাই বা কি? আপনি অনুগ্রহ করিয়া, তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করুন। আপনি জ্ঞানের আকর। আমি অজ্ঞানবশতঃ আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি, আপনি অনুকূল হইয়া আমার সংশয় ছেদন করিয়া দিন।
‘যাজ্ঞবল্ক্য কহিলেন, “মহারাজ! যোগশাস্ত্র ও সাঙ্খ্যশাস্ত্রের বিষয় তোমার কিছুমাত্র অবিদিত নাই। তথাপি জিজ্ঞাসা করিলে প্রত্যুত্তর প্রদান করাই সনাতন ধর্ম্ম। এই বিবেচনা করিয়া আমি তোমার প্রশ্নের সিদ্ধান্ত করিয়া দিতেছি, শ্রবণ কর।
‘প্রকৃতি আট ও বিকার যোড়শ প্রকার। অধ্যাত্মবিদ্যাবিশারদ পণ্ডিতেরা মূলপ্রকৃতি, মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার, পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, সলিল ও জ্যোতি এই আটটিকে প্রকৃতি; আর শ্রোত্র, ঋক্, চক্ষু, জিহ্বা, ঘ্রাণ, শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ, বাক্, পাণি, পাদ, পায়ু, মেঢ্র মল এই যোলটিকে বিকার বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। তন্মধ্যে পঞ্চ কৰ্ম্মেন্দ্রিয় ও শব্দাদি পঞ্চতন্মাত্র বিশেষ এবং পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় ও মন এই ছয়টি সবিশেষ নামে অভিহিত হইয়া থাকে। বিশেষ ও সবিশেষসমুদয় পঞ্চমহাভূতেই অবস্থান করে। হে মহারাজ! এক্ষণে আমি যাহা কীৰ্ত্তন করিলাম, ইহা তোমার ও অন্যান্য তত্ত্ববুদ্ধিবিশারদ পণ্ডিতদিগের অনুমোদিত।
‘অব্যক্ত হইতে মহৎ উৎপন্ন হইয়াছে। পণ্ডিতেরা মহতের সৃষ্টিকে প্রাকৃতিক প্রথম সৃষ্টি বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। মহৎ হইতে অহঙ্কার উৎপন্ন হইয়াছে। ইহা বুদ্ধ্যাত্মক দ্বিতীয় সৃষ্টি বলিয়া কীৰ্ত্তিত হইয়া থাকে। অহঙ্কার হইতে মন উৎপন্ন হইয়াছে এবং ইহাকে আহঙ্কারিক তৃতীয় সৃষ্টি বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। মন হইতে মহাভূতসমুদয় উৎপন্ন হইয়াছে এবং ইহার নাম মানস চতুর্থ সৃষ্টি। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ এই পাঁচটি পঞ্চম সৃষ্টি। ভূতজ্ঞ ব্যক্তিরা উহাকে ভৌতিক বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। শ্ৰোত্র, ত্বক, চক্ষু, জিহ্বা ও ঘ্রাণ এই পাঁচটি ষষ্ঠ সৃষ্টি; ইহাকে বহুচিন্তুাত্মক সৃষ্টি বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। তৎপরে পাঁচ কৰ্ম্মেন্দ্রিয় উৎপন্ন হয়; পণ্ডিতগণ ইহাকে সপ্তম সৃষ্টি ও ঐন্দ্রিয়ক সৃষ্টি বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। বৃক্ষ ও আরণ্যক পশুপক্ষ্যাদির সৃষ্টির নাম অষ্টম সৃষ্টি এবং গ্রাম্য পশুপক্ষ্যাদি ও মনুষ্যের সৃষ্টির নাম নবম সৃষ্টি। এই উভয় সৃষ্টিকেই আর্জ্জব সৃষ্টি বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। হে মহারাজ! এই আমি শাস্ত্রদৃষ্টান্তানুসারে নয় প্রকার সৃষ্টি ও চতুর্ব্বিংশতিতত্ত্বের বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম। অতঃপর সাধুজন-কীৰ্ত্তিত কালসংখ্যা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।’ ”