৩০৫তম অধ্যায়
কুন্তীকর্ত্তৃক দ্বিজদত্তবরপরীক্ষা—সূর্য্যাহ্বান
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! একদা কুন্তিুভোজকন্যা দ্বিজপ্রদত্ত মন্ত্র-সমূহের প্রতি সন্দিহান হইয়া চিন্তা করিলেন, “মহাত্মা ব্রাহ্মণ আমাকে যে সকল মন্ত্র প্রদান করিয়াছেন, তাহা অবিলম্বেই পরীক্ষা করিয়া দেখি।” এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে সহসা আপনার ঋতুলক্ষণ নিরীক্ষণপূর্ব্বক কন্যাবস্থায় রাজস্বলা হইয়াছেন বলিয়া অত্যন্ত লজ্জিত হইলেন।
অনন্তর সুমধ্যমা কুন্তী প্রাসাদতলে রমণীয় শয্যায় উপবেশনপূর্ব্বক তরুণোদিত [সবোদিত] অরুণের প্রতি নেত্রপাত করিবামাত্র দিব্যদৃষ্টি প্রাপ্ত হইলেন, এই নিমিত্ত ভানুমানের রূপে সন্তাপিত না হইয়া তাঁহার কবচ ও কুণ্ডলযুগলমণ্ডিত দিব্যমূর্ত্তি দৃষ্টিগোচর করিয়া বিমোহিত হইলেন। ঐ সময়ে তাঁহার অন্তঃকরণে ব্রাহ্মণপ্রদত্ত মন্ত্র-সকলের বলাবলপরীক্ষার কৌতুহল আবির্ভূত হইল। তিনিও তৎক্ষণাৎ আচমনপূর্ব্বক দিবাকরকে আহ্বান করিলেন।
মধুর ন্যায় পিঙ্গলবৰ্ণ কম্বূগ্ৰীবাবিশিষ্ট মহাবাহু দিবাকর তৎক্ষণাৎ যোগপ্রভাবে আত্মাকে দ্বিধাবিভক্ত করিয়া মূর্ত্তিদ্বয় ধারণ করিলেন, এক মূর্ত্তিদ্বারা পূর্ব্ববৎ তাপ প্ৰদান করিতে লাগিলেন এবং অঙ্গদ ও মুকুট-মণ্ডিত অন্যমূর্ত্তি অবলম্বনপূর্ব্বক দিকসকল প্ৰজ্বলিত করিয়া সত্বরে পৃথাসমীপে আগমন করিয়া কহিলেন, “কল্যাণি! আমি মন্ত্রপ্রভাবে তোমার নিতান্ত বশংবদ হইয়াছি, এক্ষণে তোমার কি করিব, বল।”
কুন্তী কহিলেন, “ভগবন! যে স্থান হইতে আগমন করিয়াছিলেন, সেই স্থানেই প্ৰতিগমন করুন। আমি কৌতুহলপরতন্ত্র হইয়া আপনাকে আহ্বান করিয়াছি, অতএব আমার প্রতি প্ৰসন্ন হউন।”
সূৰ্য্য কহিলেন, “সুমধ্যমে! তুমি যে প্রকার কহিতেছ, তাহাতে আমি অবশ্যই গমন করিব; কিন্তু দেবতাকে বৃথা আহ্বান করিয়া প্রেরণ করা ন্যায়ানুগত নহে। হে গজগামিনি! আমি বুঝিয়াছি, আমা হইতে অপ্রতিম-শৌৰ্য্যশালী কবচকুণ্ডলধারী সন্তান উৎপাদন করা তোমার অভিসন্ধি; অতএব এক্ষণে আত্মদান কর; তোমার অভিলষিত পুত্র উৎপন্ন হইবে। হে সম্মিতমুখি! আমি তোমার মনোরথ পরিপূর্ণ করিয়া গমন করিব। যদ্যপি তুমি অদ্য আমার প্ৰিয়াচরণ না কর, তাহা হইলে তোমাকে, তোমার পিতাকে ও সেই ব্ৰাহ্মণকে অভিশাপ প্ৰদান করিয়া নিশ্চয়ই তোমার নিমিত্ত সকলকে ভস্মীভূত করিব। যখন তোমার পিতা তোমার দুনীর্ত্তিদোষ অবগত হইতেছেন না, এবং যখন সেই ব্ৰাহ্মণ তোমার স্বভাব ও চরিত্র পরীক্ষা না করিয়াই তোমাকে মন্ত্র প্ৰদান করিয়াছেন, তখন আমি অবশ্যই তাহাদিগের দণ্ডবিধান করিব। হে ভাবিনি! তুমি আমার প্রদত্ত দিব্যদৃষ্টিদ্বারা ঐ অন্তরীক্ষস্থিত ইন্দ্রাদি দেবগণকে অবলোকন কর, দেখ, তাঁহারা বিস্ময়াবিষ্টের ন্যায় তোমার প্রতারণা পৰ্য্যবেক্ষণ করিতেছেন।” রাজদুহিতা কুন্তী ভাস্করের ন্যায় ভাস্করমূর্ত্তি দেবগণ আকাশে স্বস্ব স্থানে অবস্থান করিতেছেন। অবলোকনপূর্ব্বক লজ্জিত ও ভীত হইয়া কহিলেন, “ভগবন! আপনি বিমানে আরোহণ করুন, আমি বালস্বভাবসুলভ অপরাধে আপনাকে দুঃখ প্ৰদান করিয়াছি। পিতা, মাতা প্রভৃতি গুরুজনেরাই আমার দেহদানে অধিকারী। অতএব আমি তাহার অন্যথা করিয়া ধর্ম্মলোপ করিতে অসমর্থ। লোকসমাজে স্ত্রীলোকের দেহরক্ষীরূপ ধর্ম্মই পূজনীয়। হে দিনকর! আমি বালিকা, কেবল মন্ত্রবলপরীক্ষা করিবার নিমিত্ত আপনাকে আহ্বান করিয়াছি; অতএব আমার এই অপরাধ ক্ষমা করুন।”
সূৰ্য্য কহিলেন, “হে কুন্তি! আমি তোমাকে বালিকা মনে করিয়াই অনুনয় করিতেছি, অন্য রমণী আমার অনুনয়লাভে সমর্থ নহে, অতএব আমাকে আত্মপ্ৰদান কর, তোমার শান্তিলাভ হইবে। হে ভীরু! আমি তোমার মন্ত্রে আহূত হইয়া আগমন করিতেছি, অতএব অসম্পূর্ণ-মানসে প্রতিনিবৃত্ত হওয়া কোনক্রমেই উচিত নহে, তাহা হইলে আমি লোকের উপহাসাম্পদ ও দেবগণের নিকট নিন্দনীয় হইব। হে সর্ব্বাঙ্গ সুন্দরি! তুমি আমার ঔরসে মাদৃশ পুত্ৰলাভ কর; লোক-সমাজে বিশিষ্টা বলিয়া প্ৰতিপন্ন হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”